আজও অম্লান তাঁর কণ্ঠমাধুর্য। তাঁর গাওয়া হিন্দি, বাংলা বা রবিঠাকুরের গানে সেই সুরেলা মাদকতা আজও আচ্ছন্ন করে শ্রোতার মন। সে কালের অন্যতম গায়ক-অভিনেতাদের মধ্যে তিনি আজও এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। রেকর্ড, ক্যাসেট সিডির যুগ পেরিয়েও তিনি প্রবাদপ্রতিম — কুন্দনলাল সায়গল।
অবাঙালি হলেও তিনি বাঙালির সংস্কৃতির সঙ্গে গভীর ভাবে মিশে গিয়েছিলেন। তিনিই বোধ হয় বাংলা ছবির সবচেয়ে সার্থক গায়ক অভিনেতা। তাঁর অভিনীত চরিত্রগুলিতে বার বার ফুটে উঠেছে গভীর বিষাদবোধ এবং পেয়ে হারানোর যন্ত্রণা। তবু শেষ পর্যন্ত হেরেও জিতে গিয়েছেন সায়গল অভিনীত চরিত্ররা। অভিনয়ে গানে নিজেও জিতে নিয়েছিলেন অগণিত মুগ্ধ দর্শক ও শ্রোতা সমাজকে।
কুন্দনলাল সায়গলের জন্ম ১১ এপ্রিল ১৯০৪-এ জম্মুর মস্তগড়ে। তাঁর বাবা অমরচন্দ সায়গল জম্মুর মহারাজার দরবারে কাজে নিযুক্ত ছিলেন। ছোট থেকেই সঙ্গীতের প্রতি তাঁর আগ্রহ ছিল। সেই সময়ে তিনি ‘রামলীলা’য় অংশগ্রহণ করতেন। স্কুলে তাঁর প্রথামিক শিক্ষা বেশি দূর না এগোলেও ছোট বয়স থেকেই তিনি অর্থ উপার্জন শুরু করেন রেলের টাইম কিপার হিসেবে। পরে একটি টাইপ রাইটার কোম্পানির সেল্সম্যানের চাকরি নেওয়ায় তাঁকে দেশের বিভিন্ন স্থানে যেতে হত। এমনই এক বার লাহৌরে তাঁর সঙ্গে পরিচয় হয় মেহেরচন্দ জৈনের। পরে তাঁর সঙ্গেই কলকাতায় এসে সঙ্গীতের প্রতি তাঁর আকর্ষণটা বেড়ে গিয়েছিল। একটি হোটেলে কাজ করার পাশাপাশি তাঁর গন্তব্য ছিল শহরের বিভিন্ন মেহফিল ও মুশায়রা। ধ্রুপদীসঙ্গীতে প্রথাগত তালিম না থাকলেও কুন্দনলাল ভাল গজল-গীত গাইতে পারতেন।
কেএল সায়গল এবং কাননদেবী
নিউ থিয়েটার্স-এর সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ করিয়ে দিয়েছিলেন প্রখ্যাত সঙ্গীত পরিচালক রাইচাঁদ বড়াল। সেই নিয়ে শোনা যায় এক কাহিনি। এক দিন বেতার কেন্দ্র থেকে ফেরার সময় সন্ধ্যাবেলা রাইচাঁদ বড়াল ধর্মতলায় মেট্রো সিনেমার উল্টোদিকে গাড়ি দাঁড় করিয়ে সিগারেট কিনছেন, এমন সময় ওই দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে এক তরুণকে গুনগুন করতে দেখে সেই সুরের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে তাকাতেই সায়গল থেমে গিয়েছিলেন। কাকতালীয় হলেও ঠিক পরের দিন প্রখ্যাত ধ্রুপদী শিল্পী পণ্ডিত হরিশচন্দ্র বালি কুন্দনলালকে নিয়ে হাজির হয়েছিলেন রাইচাঁদবাবুর বৈঠকখানায়। হরিশচন্দ্র আগেই বলে বসলেন, যুবকটির উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের কোনও তালিম নেই, শুধুই গজল গাইতে পারে। এতে রাইচাঁদ কিছুটা আশঙ্কা প্রকাশ করায় হরিশচন্দ্র অনুরোধ করেছিলেন সেই যুবকের একটা গান শুনে দেখতে। গান ধরার আগে কুন্দনলাল গুনগুন করে উঠতেই রাইচাঁদ চমকে উঠেছিলেন। অবিকল সেই আগের দিনের সুরটা! গান শোনার পরে অবশ্য কুন্দনলালের জীবনে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়েছিল।
এর পরে রাইচাঁদ বড়াল কুন্দনলালকে নিয়ে গিয়েছিলেন নিউ থিয়েটার্স-এর বি এন সরকারের কাছে। তিনি তার প্রতিষ্ঠানে ২০০টাকা বেতনের এক চাকরিতে কুন্দনলালকে বহাল করেছিলেন। এর পরে আর ফিরে তাকাতে হয়নি। চলচ্চিত্র জীবনে কুন্দনলালের পদার্পণ ১৯৩২-এ, নিউ থিয়েটার্সের ব্যানারে। তাঁর অভিনীত প্রথম ছবি ‘মহব্বত কে আঁশু।’ তেমনই ‘পরিচয়’ ছবির মুক্তির তারিখ ঘোষণা হয়ে গেলেও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ গানটির রেকর্ডিং তখনও হয়নি সায়গলের ভাঙা গলা ও অসুস্থতার কারণে। এমনই অবস্থায় রাইচাঁদ সায়গলকে ফোন করে স্টুডিওয় আসতে বললেন। তিনি এলেও চড়া গলায় গান গাইতে পারছিলেন না। তাই রাইচাঁদের পরামর্শে তিনি কিছুটা নিচু স্বরে, খাদে গানটি ধরলেন এবং গানটি রেকর্ডও করা হয়েছিল। সেই বিখ্যাত গানটি হল, ‘যখন রব না আমি দিন হলে অবসান’।
গার্স্টিন প্লেসের স্টুডিওয় কুন্দনলালের সঙ্গে আলাপ হয়েছিল পঙ্কজকুমার মল্লিকের। তিনিই রেডিওর নৃপেন মজুমদারের সঙ্গে কুন্দনলালের যোগাযোগ করিয়ে দিয়েছিলেন। এর পরে গানের অডিশন উতরে সেই রাতেই সম্প্রচারিত হয়েছিল তাঁর গাওয়া গজল। এর পর অবশ্য তিনি রেডিওর স্থায়ী শিল্পী হয়ে গিয়েছিলেন।
কানন দেবীর স্মৃতিচারণ থেকে জানা যায় কত বড় মাপের শিল্পী ছিলেন সায়গল। তখন গান রেকর্ডিং এর সময় একটি মাত্র মাইক্রোফোন ব্যবহার করা হত। ‘সাথী’ ছবির ডুয়েট গানের রেকর্ডিং-এর সময় সায়গল বার বার মাইকের দিকে কানন দেবীকে ঠেলছিলেন যাতে কানন দেবীর গলাটা ভাল ভাবে আসে। তেমনই শোনা যায়, এক বার শ্যুটিং-এ সবাই অপেক্ষা করছিলেন অথচ সায়গলের দেখা নেই। অবশেষে অনেক খোঁজ নিয়ে জানা গেল তিনি স্টুডিওর একটি ঘরে ঘুমোচ্ছেন। সকলেই বুঝে গেলেন ব্যাপারটা কী। আসলে সায়গলের মদ্যপানের অভ্যাসটা সম্পর্কে সকলেই জানতেন। কানন দেবীকে তিনি ‘বহিন’ বলে ডাকতেন, খুব স্নেহও করতেন। তাই সকলে কানন দেবীকে বললেন গিয়ে সায়গলকে ডেকে আনতে। ডাকতে গিয়ে প্রথমে কানন দেবীর ভাগ্যে জুটে ছিল বেজায় বকুনি! কিছুতেই সেটে আসতে চাইছিলেন না সায়গল। তার পরে অবশ্য স্নান সেরে একদম ফিট হয়ে এসে অভিনয় করেছিলেন।
১৯৪১-এর ডিসেম্বরে কুন্দনলাল মুম্বই পাড়ি দিয়েছিলেন। সেখানেই বেশ কিছু ছবিতে তাঁর অভিনয় ও গান আজও স্মরণীয় হয়ে আছে। তার মধ্যে ‘ভক্ত সুরদাস’, ‘তানসেন’ উল্লেখ্য। তাঁর পরোপকার ও সাহায্যের কথা আজও স্মরণীয়। এক বার জুহু থেকে গভীর রাতে বাড়ি ফেরার সময় রাস্তায় এক ভিখারিকে কাঁপতে দেখে গাড়ি দাঁড় করিয়ে নিজের কোটটা খুলে সেই ভিখারিকে পরিয়ে দিয়েছিলেন। তেমনই মুম্বই থাকাকালীন তাঁর বাড়িওয়ালা আর্থিক সমস্যাজনিত কারণে তাঁর কাছে চল্লিশ হাজার টাকায় বাড়ি বিক্রি করার প্রস্তাব রেখেছিলেন। সায়গল তাঁর দুঃসময়ে কম দাম না দিয়ে বাজার দাম পঁয়তাল্লিশ হাজার টাকা দিয়েই বাড়িটি কিনেছিলেন। তবে অতিরিক্ত মদ্যপান তাঁর কর্মজীবন ও স্বাস্থ্যের উপর প্রভাব ফেলেছিল।
শিল্পীর প্রিয় হারমনিয়ম
তাঁর অভিনীত চরিত্রে সব সময়ে গানের ভূমিকা প্রাধান্য পেয়েছে। তা সে ‘দেশের মাটি’ ছবির আধুনিক কৃষিবিদ কিংবা ‘সাথী’ ছবির সেই পথগায়ক সেগুলির মধ্যে ধরা পড়েছে এক উদাসী বাউলের ছাপ। তাঁর অভিনীত শেষ ছবি ‘পরওয়ানা’। সারা জীবনে তিনি ২৮টি হিন্দি ছবি, আটটি বাংলা ও একটি তামিল ছবিতে অভিনয় করেছিলেন।
তাঁর অভিনীত ছবিগুলির মধ্যে ‘মাই সিস্টার’, ‘জিন্দেগি’, ‘সুরদাস’, ‘দেবদাস’, ‘চণ্ডীদাস’, ‘ধরিত্রীমাতা’, ‘স্ট্রিট সিংগার’, ‘জীবনমরণ’, ‘পরিচয়’ উল্লেখযোগ্য। তাঁর গাওয়া রবীন্দ্রনাথের গানও সে যুগে দারুণ জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল। অনেকেরই অজানা কুন্দনলাল ভাল রান্নাও করতে পারতেন। ১৯৩৫-এ তাঁর বিবাহ হয় আশারানির সঙ্গে। তাঁদের একটি পুত্র ও দু’টি কন্যা।
১৮ জানুয়ারি ১৯৪৭ সালে মাত্র ৪২ বছর বয়সে তাঁর জীবনাবসান হয়।