কোমরের বন্দুক ছিনিয়ে হোমগার্ডকেই খুন

পারিবারিক বিবাদ ও মারামারির খবর পেয়ে তা থামাতে গিয়েছিলেন এলাকায় টহলরত এক হোমগার্ড ও কনস্টেবল। পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হওয়ার পরে অভিযুক্তকে যখন থানায় নিয়ে যাওয়ার তোড়জোড় চলছে, তখনই ঘটল ঘটনাটি। এক ঝটকায় হাত ছাড়িয়ে নিয়ে হোমগার্ডের কোমরের খাপ থেকে সার্ভিস রিভলভার ছিনিয়ে তাঁকেই গুলি করে দিল অভিযুক্ত ব্যক্তি।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ২৯ জুন ২০১৪ ০০:৩৯
Share:

(বাঁ দিকে) নিহত হোমগার্ডের স্ত্রী বেবি গোয়ালা। (ডান দিকে) খুনে অভিযুক্ত অশোক দাসের স্ত্রী স্বপ্না। শনিবার। ছবি: অরুণ লোধ ও শশাঙ্ক মণ্ডল।

পারিবারিক বিবাদ ও মারামারির খবর পেয়ে তা থামাতে গিয়েছিলেন এলাকায় টহলরত এক হোমগার্ড ও কনস্টেবল। পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হওয়ার পরে অভিযুক্তকে যখন থানায় নিয়ে যাওয়ার তোড়জোড় চলছে, তখনই ঘটল ঘটনাটি। এক ঝটকায় হাত ছাড়িয়ে নিয়ে হোমগার্ডের কোমরের খাপ থেকে সার্ভিস রিভলভার ছিনিয়ে তাঁকেই গুলি করে দিল অভিযুক্ত ব্যক্তি। ওই ঘটনায় হোমগার্ড তো নিহত হয়েছেনই, সেই সঙ্গে তাঁর বুক ফুঁড়ে বেরিয়ে যাওয়া গুলিটি স্থানীয় বাসিন্দা এক যুবকের চোয়ালে গিয়ে বিঁধেছে। জখম ওই যুবক এখন ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিত্‌সাধীন।

Advertisement

শুক্রবার রাত ১০টা নাগাদ ঘটনাটি ঘটেছে দক্ষিণ শহরতলির হরিদেবপুর থানা এলাকার সোদপুর ব্রিকফিল্ড রোড এলাকায়। পুলিশ জানিয়েছে, নিহত হোমগার্ডের নাম রাজু গোয়ালা (৩৩)। একই ঘটনায় গুলিতে আহত যুবকের নাম বিবেক যাদব। ওই ঘটনায় এলাকার একদল লোক অভিযুক্ত অশোক দাসকে বেধড়ক প্রহার করে। আহত অবস্থায় তাকে এম আর বাঙুর হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়েছে।

ডেপুটি কমিশনার (দক্ষিণ-পশ্চিম) রশিদ মুনির খান জানান, অশোকের বিরুদ্ধে খুন, পুলিশের অস্ত্র ছিনতাই ও খুনের চেষ্টা-সহ একাধিক অভিযোগে মামলা করা হয়েছে।

Advertisement

কিন্তু হোমগার্ড কী করে আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে ডিউটি করছিলেন, এই ঘটনায় প্রশ্ন উঠেছে পুলিশের অন্দরেই।

লালবাজারের কর্তারা অবশ্য বলছেন, কোনও হোমগার্ডের আগ্নেয়াস্ত্র চালানোর প্রশিক্ষণ থাকলে রিভলভার নিয়ে তাঁর ডিউটি করা বেআইনি বা অবৈধ নয়। রাজু নামে ওই হোমগার্ডের সেই প্রশিক্ষণ ছিল বলেই পুলিশের একাংশের দাবি। তবে লালবাজারের এক শীর্ষকর্তার বক্তব্য, “বেআইনি না হলেও হোমগার্ডদের আগ্নেয়াস্ত্র না দেওয়াই সাধারণ প্রথা।” তাই কেন ওই হোমগার্ডকে রিভলভার দিয়ে ডিউটিতে পাঠানো হয়েছিল, তা খতিয়ে দেখছে লালবাজার।

সেই সঙ্গে পুলিশের অন্দরে প্রশ্ন উঠেছে, গোলমালের খবর পেয়েও থানার ডিউটি অফিসার নিজে ঘটনাস্থলে না গিয়ে কেন শুধু এলাকায় টহলরত কনস্টেবল ও হোমগার্ডকে পাঠালেন? তবে পুলিশকর্তাদের একাংশের যুক্তি, পারিবারিক কলহের খবর মিলেছিল বলেই প্রাথমিক ভাবে খোঁজ নিতে ওই দু’জনকে পাঠানো হয়েছিল। “বড় ঘটনার খবর পেলে ডিউটি অফিসার নিশ্চয়ই যেতেন,” দাবি এক পুলিশকর্তার।

কিন্তু রাত ১০টা নাগাদ মোটরবাইকে টহলরত কনস্টেবল মহম্মদ ওয়াহিদ আলম ও হোমগার্ড রাজু গোয়ালা ডিউটি অফিসারের নির্দেশ মতো ঘটনাস্থলে পৌঁছে দেখেন, অশোক দাস হাতে ছুরি নিয়ে উন্মত্ত অবস্থায় দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। পুলিশ দেখে তেড়েও যায় সে।

পুলিশ সূত্রের খবর, উন্মত্ত অশোককে মাত্র দু’জনে মিলে বাগে আনা যাবে না, তা আঁচ করে স্থানীয় বাসিন্দা বিবেককে সাহায্যের জন্য ডাকেন পুলিশকর্মীরা। কনস্টেবল ওয়াহিদ অশোকের ডান হাত পিছন দিকে মুচড়ে ধরেন। আর বিবেক অশোকের বাঁ হাত চেপে ধরেন। অশোকের বাড়ি গলির ভিতরে। দু’জনে অশোককে চেপে ধরে গলির মুখে নিয়ে যান। সেই সময়ের মধ্যে রাজু অটো ডেকে আনেন অশোককে থানায় নিয়ে যাওয়ার জন্য।

তবে অশোককে নিয়ে গলির মুখে পৌঁছনোর পরে হাতের রাশ আলগা করেছিলেন বিবেক। সেই সুযোগই নেয় অশোক। ওই সময়ে অশোকের উল্টো দিকে ছিলেন রাজু। অশোক এক ঝটকায় বাঁ হাত ছাড়িয়ে নিয়ে রাজুর কোমরের বাঁ দিকের খাপ থেকে সার্ভিস রিভলভারটি তুলে নেয়। তার পরেই ‘পয়েন্ট ব্ল্যাঙ্ক রেঞ্জ’ থেকে গুলি করে রাজুকে। রাজুর বুক এফোঁড়-ওফোঁড় করে গুলিটি বিবেকের চোয়ালের নীচে ঢুকে যায়। কিন্তু গুলিবিদ্ধ হয়েও অশোকের কলার চেপে ধরেন রাজু। অশোকের হাত থেকে রিভলভারও পড়ে যায়।

তদন্তকারীরা জানান, পুলিশের রিভলভারের সঙ্গে একটি দড়ি লাগানো থাকে। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, অশোক এমন জোরে টেনেছিল যে রাজুর রিভলভারে লাগানো দড়ি পর্যন্ত ছিঁড়ে যায়। আর মুহূর্তের মধ্যে অশোক যে ভাবে সেফটি ক্যাচ খুলে গুলি ছুড়ল, তা-ও ভাবাচ্ছে পুলিশকে।

অশোককে থানায় নিয়ে যাওয়ার জন্য ডাকা অটোতেই রাজু ও বিবেককে চাপিয়ে বাঙুর হাসপাতালে নিয়ে যান স্থানীয়েরা। হাসপাতালে চিকিত্‌সকেরা রাজুকে মৃত বলে ঘোষণা করেন। বিবেককে ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে স্থানান্তরিত করা হয়। পুলিশ সূত্রের খবর, ঘটনার পরে স্থানীয় এক যুবক রাস্তা থেকে রাজুর রিভলভার কুড়িয়ে পালানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু ওয়াহিদ তাঁকে পাকড়াও করে রিভলভার উদ্ধার করেন।

কেন এমন করল অশোক?

শনিবার অশোকের ছেলে জানায়, তার বাবা বেহালায় গ্যারাজ ভাড়া নিয়ে গাড়ি রঙের কাজ করত। গত ১১ জুন বাড়ি ফিরে সে অসুস্থ হয়ে পড়ে। তার পর থেকেই সে অস্বাভাবিক আচরণ করছিল।

পুলিশ জানায়, রাজু বছর দুয়েক আগে হরিদেবপুর থানায় যোগ দিয়েছিলেন। আদতে রাঁচির বাসিন্দা রাজু দীর্ঘদিন ধরেই পর্ণশ্রীর ননীগোপাল সাহা রোডে বসবাস করছিলেন। তাঁর বাড়িতে বৃদ্ধ বাবা ছাড়াও স্ত্রী বেবি ও আড়াই বছরের মেয়ে ঈশিকা রয়েছে। বেবি জানান, শুক্রবার দুপুর বারোটা নাগাদ রাজু থানায় যান। শনিবার দুপুরে তাঁর বাড়ি ফেরার কথা ছিল।

বেবি বলেন, ডিউটি থাকলে রাত সাড়ে এগারোটা-বারোটা নাগাদ বাড়িতে ফোন করে খোঁজ নিতেন রাজু। কিন্তু শুক্রবার রাতে ফোন না আসায় বেবিই রাজুর মোবাইলে ফোন করেন। প্রথম বার কেউ ফোন না ধরলেও দ্বিতীয় বার এক অপরিচিত ব্যক্তি ফোন ধরে বলেন, “রাজু দুর্ঘটনায় আহত হয়ে বাঙুর হাসপাতালে ভর্তি।” কিন্তু কী হয়েছে, তা না জানতে পেরে রাত তিনটে নাগাদ বৃদ্ধ শ্বশুর ও কয়েক জন প্রতিবেশীকে নিয়ে ওই হাসপাতালে গিয়ে স্বামীর মৃত্যু সংবাদ পান বেবি। তাঁর অভিযোগ, থানা থেকে স্বামীর খবর জানিয়ে কোনও ফোন করা হয়নি।

ডিসি (দক্ষিণ-পশ্চিম) রশিদ মুনির খান বলেন, “রাতে মৃত্যু সংবাদ দিলে রাজুর স্ত্রী ও বৃদ্ধ বাবা অসুস্থ হয়ে পড়তে পারেন, সেই আশঙ্কা করেই দুর্ঘটনার কথা জানানো হয়েছিল।” পুলিশকর্তারাও জানান, যত দ্রুত সম্ভব রাজুর স্ত্রীর চাকরির ব্যবস্থা করা হবে। বিকেলে রাজুর রাঁচির বাড়ি থেকে তাঁর মা কলকাতায় আসেন। মর্গ থেকে রাজুর দেহ হরিদেবপুর থানায় নিয়ে গিয়ে গার্ড অফ অনার দেওয়া হয়। রাজুর দেহে মালা দিতে গিয়ে অজ্ঞান হয়ে যান কনস্টেবল ওয়াহিদ।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন