যে শহরের প্রথম আলো ফুটফুটে শিশু কোলে দিয়ে দেয় মা হওয়ার অনাবিল আনন্দ, যে শহর প্রথম দেয় স্বোপার্জনের স্বাদ, যে শহরে সুতোর শেষটান পড়ে বহু দিনের কলেজ পড়ানোর স্বপ্ন বোনা কাঁথার, সে শহর আমার নয়তো, সে শহর কার? জন্ম-শহর না হলেই বা কি? যে শহরে প্রতি বার প্লানেটোরিয়াম দেখতে গিয়ে তারা-ভরা আকাশের নীচে ঘুমন্ত আমার শৈশব, যে শহরে নাট্য রঙ্গমঞ্চ বিশ্বরুপায় একদল অচেনা নাট্যপ্রেমী সহযোদ্ধাদের সঙ্গে তাদেরই এক জন হয়ে রেভলভিং স্টেজে ‘মেরি-গো-রাউন্ড’-এ ‘ষড়শী’ দেখা ৭০ এর দশকে, যে শহরে দশ মাসের ছানা বগলে গুঁজে সল্টলেকের বিডি ব্লকে দশ দিনের নাট্যত্সবে চাক্ষুষ হয়ে যায় ডাকসাইটে সব শহর কাঁপানো নাট্যদল, যে শহরে সদ্যজাত স্বামী, বকলমে আইনত মঞ্জুর বয়ফ্রেন্ড নিয়ে শহর আবিষ্কারে বেড়িয়ে পড়া। এ শহর যে ‘সিটি অফ জয়’, নেই সংশয়। সমাজসিদ্ধ বয়ফ্রেন্ড পেয়ে প্রথমেই যে বহু ইপ্সিত অ্যাডভেন্চার যাত্রা করেছিলাম তা হল, ভিক্টোরিয়ার ময়দানে অমূলক কথার ভিড়ে কানের পাশ দিয়ে কাঁধের ও-পারে বাদামের খোসা ওড়াতে আর আলতো হাতে ঘাস ছিড়ে ‘ডেট’ করতে কেমন লাগে। এ ভাবেই খণ্ড খণ্ড পাজেল-টুকরো জুড়ে হঠাত্ই এক দিন ভেসে ওঠে চেনা শহরের মুখ ছবি। গাঙ্গুরাম, নাহুম, আমিনিয়া, ট্যাংরা... নখদর্পনে এসে যায় রসগোল্লা, কাবাব, বিরিয়ানি, চাউ-এর ঠিকুজি-ঠিকানা।
যে শহর বোকা বানায়, আবার বোকামো ঘুচিয়ে ফুটিয়ে তোলে চোখ, সেই ‘শহরটার এই গোলক ধাঁধায়’ পাকলো সোনার মন। শুরুর গল্প কিন্তু অন্য। যে শহরে অনভিজ্ঞ পায়ে রাস্তা পেরোতে কতবার বাসে চাপা পড়তে পড়তে হাতের মুঠোয় প্রাণ নিয়ে ফিরে আসা। ‘জীবন মৃত্যু পায়ের ভৃত্য’ করে রাস্তা পার হওয়ার আর্ট ফর্ম রপ্ত করার দমবন্ধ সেই দিনগুলো! যে শহরে হারিয়ে যাওয়ার ভয়ে চল্লিশ মিনিট বাস স্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে দেড় ঘণ্টায় সারা দুনিয়া ঘুরে যাওয়া সরাসরি পৌঁছনো বাসে চেপে, কোনও ঝুঁকি না নিয়ে নব্বই-এর দশকে সব ঘাম-ক্লান্তি উড়ে যেত, যখন সামনে দেখতাম ফুলের জলসা থেকে ফুঁড়ে ওঠা বিদ্যার স্বর্গীয় সোপান ‘ন্যাশনাল লাইব্রেরি’। জন্ম-শহর না হয়েও সে শহর জীবনের-মনের ষোলো আনা চাহিদা মিটিয়ে হয়ে যায় আমার শহর। এ শহর তাই বেঁচে আছে নানা রঙ্গে রঙ্গিমায়, নানা মায়ামহিমায়।
এই মিস্টিক শহরে সবুজ ছেঁটে, বহুতল-বাসিন্দা হয়ে মানুষগুলো খুপরিতে ক্রমশ অন্তর্মুখী হয়ে উঠলেও, কেমন করে যেন সার্বিক ভাবে শহরটির মনে ঘাটতি নেই সবুজের। কিছুতেই যেন তা হতে দেন না বাসিন্দারা!
যে শহরে আমরাই শেষ দেখেছিলাম খোলা আকাশের নীচে, ধুলোর ঝড়ের বইমেলা যা শহরকে টেনে নেয় বুকের মাঝে। মেলা প্রাঙ্গন হয়ে ওঠে মিনি কলকাতা। আমরাই ছিলাম তার শেষ সাক্ষীর প্রজন্ম। এ শহরেই খেলার মাঠ, বক্তৃতার ময়দান, রাজনীতি, দেওয়াল লিখন জড়ানো থাকে অহেতুক আবেগে। ইলিশ-চিংড়ি-টোম্যাটো-ডিম যেন কেমন করে জড়িয়ে যায় এতে। ছ্যাকরা বাস, আজ ‘এল’ বাস তো কাল ‘এম’ বাস, ‘এস’ বাস, ‘দুরন্ত’ বাস, শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বাস, সদ্য বিলীন হওয়া দোতলা বাস, ট্রাম, সঙ্গে ঝাঁচকচকে বিএমডাব্লিউ, মার্সেডিজ, টয়োটা, টানা রিকশা— যেন বিগত ও বর্তমান শতকের সহাবস্থানের ঝিলিক। যে কোনও ট্রামের আওয়াজের বিষণ্ণ দীর্ঘশ্বাসে মনে পড়ে জীবনানন্দকে।
এই শহরেই লোটে-তোপসে ইত্যাদি এক্সট্রা মাছের জন্য বাঙালি আত্মীয়েরা ছুটে আসেন দূর-দূরান্ত থেকে। রোল-চপের সঙ্গে বিকেলের মিটমিটে আলোর পথে জ্বলজ্বল করে তিব্বতীয় মোমো। সাতসাগর আর তেরো নদীর পার থেকে খবর পাই এই হকার উঠে গেল তো, এই বা উড়ন্ত সেতুতে শহর চেনাই নাকি দায় হয়ে উঠেছে। আত্মীয়েরা চোখ মটকে বলেন, তাঁদের নাকি আবার বাঙালকে হাইকোর্ট দেখানোর মতো, দ্বিতীয় বার শহর দেখানোর দায় কাঁধে পড়ল। আমি পৌঁছবার আগেই অবশ্য হকাররা ফিরে আসে স্বস্থানে, শুন্যোদ্যানের মতো গোটা শহর জুড়ে ঝুলছে শুধু সেতুরা।
এ শহরে কত বার বইপাড়ায় সকাল থেকে সন্ধে ঘুরে জুতো ছিঁড়ে নতুন জুতো কিনে ফিরেছি কলেজ স্ট্রিট থেকে। মফস্সলে শুধুই মনের পাড়া বেড়াতে আসতেন যে কবি-শিল্পী-সাহিত্যিকরা, তাঁরা জলজ্যান্ত হয়ে ধরা দেন হাতের নাগালে, কফি হাউসে, শহরের ইতি-উতি আনাচে-কানাচে।
আমার বর্তমান আবাস রাজ্য জর্জিয়ার বিখ্যাত হলিউড অভিনেত্রী জুলিয়া রবার্ট এর সঙ্গে কখনও ফক্স থিয়েটারে কোনও গ্রুপ থিয়েটার দেখার সুযোগ আকাশ কুসুম হলেও, এক ছাউনির তলায় অ্যাকাডেমিতে ‘ম্যাকবেথ’ দেখার সুযোগ হয় অপর্ণা সেন-মৃনাল সেনের সঙ্গে। এই রাজ্যে গ্ল্যামার-নায়ক সৌমিত্র পান ‘রাজা লিয়ার’ করার প্রেরণা।
এ শহরই তৈরি করে উভচরী মন, যা তাজ-ক্যালকাটা ক্লাব-কেনিলওয়ার্থ-নিজাম পর্ব সেরে ঠেলে পাঠায় উল্টোডাঙার বস্তিতে থাকা বারো বছরের পুরনো কাজের মাসির নাতনির মুখেভাতে হাজিরা দিতে। নতুন কোন ‘মল’ গজালো তার খোঁজে নয়, গুটি কয় উড়োজাহাজে আকাশের পর আকাশ ভেঙে, মেঘ ডিঙিয়ে ছুটে আসি বুক ভরা ফুসফুসে কলকাতার গন্ধ-ওম নিতে। পথের ধুলো ভরা আঁখের রস-ফুচকা, রবীন্দ্রসদন-নন্দন-গ্লোব যেন ক্লান্তিময় জীবনের মৃতসঞ্জীবনী। এত দিনের ডাকা ‘মামাবাড়ি’-‘শ্বশুড়বাড়ি’কে ‘দূর ছাই’ বলে এ শহর নিজের অজান্তে কখন যেন হয়ে যায় ‘আমার শহর’। এ শহরে সামাজিক নেটওয়ার্ক এত সচল যে সরকারি হাসপাতাল থেকে ঠিকানা জোগাড় করে নতুন বাচ্চা বরণে বাড়ি খুঁজে হাজির হয় হিজড়েরা। এ ভাবেই সামাজিক উদ্যাপনের অংশীদার হয়ে অর্জন হয় জীবিকা।
যে শহরে বয়স্ক কোনও বাবা যদি রাস্তায় মাথা ঘুরে পড়ে যান, তাঁর বুক পকেট থেকে ঠিকানা খুঁজে কোনও অজানা পথচারী স্বজন, তাঁকে পৌঁছে দেন হাসপাতালে, রক্ত দিতে এগিয়ে আসেন, বাড়িতে খবর পৌঁছে দেন, সেই শহরের হৃদপিণ্ডের ভাঁজে ভাঁজে জড়িয়ে থাকে আমার প্রাণের গল্প ও গর্বের উপাখ্যান।
আপিসপাড়া ডালহৌসি, প্রাইভেট শিল্পায়নের ঝাঁ চকচকে পার্ক স্ট্রিট, মহাকরণের মহামেজাজ, উত্তর দক্ষিণ, ঘটি-বাঙাল, ইলিশ-চিংড়ি, যানজট, মিছিল-মার্চ, বর্ষায় জল-অতল রাস্তা— ঊন কোটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান— এই সমস্ত কিছু নিয়ে কলকাতা আছে কলকাতাতেই। যেখানে বিয়ের কার্ড, মেনু, পুজোর প্যান্ডেল সবেতেই থাকে শিল্পরুচির ছাপ-ভাষার কারুকাজ। যে শহরে মুঠো মুঠো প্রতিভার— তাতে ফোটে শিল্পসত্তা-বুদ্ধিজীবী— এ শহর তাই আমায় হাতছানি দেয়, আর আমার ছেলেপুলেদের হাতছানি দেয় সেন্ট্রাল পার্কের আবোলতাবোলের চরিত্ররাও।
জন্মভূমি অসম, কর্মভূমি আটলান্টা। পেশা শিক্ষকতা— শুরু হয়েছিল কলকাতা ও আমেরিকার কলেজে অধ্যাপনা দিয়ে, এখন কচিকাঁচাদের পড়িয়েই সময় কাটে। কাগজ-কলম নিয়ে বসতে না পারলে হাত কেমন নিশপিশ করে। শখ, কাগজের গায়ে কলমের ফুলঝুরি ছড়ানো। নিজস্ব ভাবনাকে মঞ্চে তুলে ধরাও আর এক নেশা। অনুষ্ঠান উপস্থাপনার সূত্রে দর্শকদের সঙ্গে আলাপচারিতাও বেশ পছন্দের। জীবনে বৈচিত্র আনতে মাঝে মাঝেই ছুটে যাওয়া চাই অন্য কোনওখানে অন্য কোনও দেশে।