তাঁর ঠিকানা তাই...

রাস্তার ধারে ভাঙা তক্তপোষে শুয়ে যন্ত্রণায় ছটফট করতে-করতে মৃত্যুর প্রতীক্ষা করছেন বৃদ্ধা। ক্যানসারের ক্ষত পচে দুর্গন্ধ বার হতে শুরু করেছে, অনবরত রক্তক্ষরণ হচ্ছে, কিডনি বিকল। চার প্রাপ্তবয়স্ক ছেলেমেয়ে রয়েছে। তবু ওষুধ দূর অস্ত্, দু’বেলা খাবার দেওয়ার লোকও জোটে না। মানিকতলা বাজারের পিছন দিকে বিডন স্ট্রিট থেকে শ্রীমানী কলোনি নামে একটা গলতা রাস্তা খন্না-র দিকে গিয়েছে।

Advertisement

পারিজাত বন্দ্যোপাধ্যায়

কলকাতা শেষ আপডেট: ১২ মার্চ ২০১৪ ০২:৩১
Share:

উল্লাসী মাজির আস্তানা। —নিজস্ব চিত্র।

রাস্তার ধারে ভাঙা তক্তপোষে শুয়ে যন্ত্রণায় ছটফট করতে-করতে মৃত্যুর প্রতীক্ষা করছেন বৃদ্ধা। ক্যানসারের ক্ষত পচে দুর্গন্ধ বার হতে শুরু করেছে, অনবরত রক্তক্ষরণ হচ্ছে, কিডনি বিকল। চার প্রাপ্তবয়স্ক ছেলেমেয়ে রয়েছে। তবু ওষুধ দূর অস্ত্, দু’বেলা খাবার দেওয়ার লোকও জোটে না।

Advertisement

মানিকতলা বাজারের পিছন দিকে বিডন স্ট্রিট থেকে শ্রীমানী কলোনি নামে একটা গলতা রাস্তা খন্না-র দিকে গিয়েছে। সেখানেই একটা পুরনো পলেস্তারা খসা বাড়ির নীচে ছেঁড়া নাইটিতে শুয়ে রয়েছেন উল্লাসী মাজি। পাড়ার এক জন একটা কম্বল গায়ে দিয়ে গিয়েছে। তক্তপোষ ঘেঁষে সমানে গাড়ি-মোটরবাইক যাচ্ছে। বৃদ্ধার চোখের দৃষ্টি ঘোলাটে, কাছে গেলেই নাকে আসছে ক্ষতে পচনের গন্ধ। মাছি উড়ছে। যন্ত্রণার চোটে কথা বলতে গিয়েই কেঁদে ফেলছেন। এর মধ্যে আবার শরীর ছাড়পোকার কামড়ে ক্ষতবিক্ষত। “আর যে সহ্য করতে পারছি না মা। আমাকে কোনও হাসপাতালে দিয়ে দাও। ছেলেমেয়েরা তো কেউ রাখবে না। ওদের বাড়িতে জায়গা নেই। আমি থাকলে অসুবিধা হবে। কোনও রাগ নেই ওদের উপরে। পেটের ছেলেপুলের উপর কী রাগ করব!” গালে গড়িয়ে আসা চোখের জল মুছে বলেন বৃদ্ধা।

এই রাস্তার উপরেই উল্লাসী আর তাঁর স্বামী দু’কড়ি মাজি-র চায়ের দোকান ছিল। চার ছেলেমেয়ে কার্তিক মাজি, দিলীপ মাজি, ঝুনু মাজি, রুনু মাজি। দু’কড়ি মারা যাওয়ার পর চায়ের দোকান চালিয়ে সংসারের হাল ধরেছিলেন উল্লাসী। ছেলেমেয়েদের বিয়েও দেন। বছর দেড়েক আগে যোনিদ্বারে ক্যানসার ধরা পড়ে। চিকিৎসকেরা জানিয়ে দেন ‘লাস্ট স্টেজ।’ মাস দু’য়েক মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ফ্রি বেডে ভর্তি ছিলেন। তারপর সেখানকার চিকিৎসকেরাও জানিয়ে দেন, এই ধরনের রোগীদের আর হাসপাতালে রাখা যায় না, কারণ আর কোনও চিকিৎসা কাজ করবে না। এখন দরকার বাড়ির লোকের সাহচর্য ও পরিচর্যা।

Advertisement

কিন্তু বাড়ি ফেরার পরে?

মানিকতলার পেয়ারাবাগানে উল্লাসী যে ভাড়াবাড়িতে থাকতেন, সেখানে এখন থাকেন বড় ছেলে কার্তিক আর তাঁর স্ত্রী খ্যান্ত মাজি। কার্তিকের কথায়, “বাড়িতে একটা ঘর। মায়ের সব সময়ে শুয়ে থাকার দরকার। এত জায়গা কোথায়? দেখাশোনা করাও সম্ভব নয়।” মেজ ছেলে দিলীপের বিবাহবিচ্ছেদ হয়ে গিয়েছে। সারাদিন রাস্তাঘাটে ঘুরে বেড়ান আর নেশা করে পড়ে থাকেন। বললেন, “আমার নিজেরই বাড়ি নেই। মাকে কোথায় রাখব? তা-ও রোজ এসে মাথা ধুয়ে দিই, বাথরুম পরিষ্কার করি। কিন্তু মা-র অনেক খাবার আর ওষুধ দরকার। সেগুলো আমি দিতে পারব না।” দুই মেয়ে ঝুনু ও রুনু মাজিও জানিয়ে দিয়েছেন, তাঁদের শ্বশুরবাড়িতে মা-কে রাখার সমস্যা রয়েছে। এক ধাপ এগিয়ে ঝুনু-র স্বামী তপন রায় বলেন, “এই চায়ের দোকানটাই শাশুড়িমায়ের বাড়িঘর। এই জায়গাটা ছেড়ে অন্য কোথাও উনি থাকতে পারবেন না।”

উল্লাসী মেয়েদের কাছে থাকতে চেয়েছিলেন কি না জিজ্ঞাসা করাতে ক্ষীণ গলায় উত্তর আসে, “চেয়েছিলাম, ওরা নিল না। আসলে শরীর থেকে রক্ত-পুঁজ বেরোয়, গন্ধ বেরোয়। কে আর আমাকে রাখবে?” স্থানীয় একটি স্কুলের অভিভাবকেরা উল্টো দিকের একটা দোকানে চা খেতে এসে উল্লাসীকে দেখতে পান। বৃদ্ধার অবস্থা দেখে থাকতে না-পেরে তাঁদেরই এক জন হাজরার এক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থায় ফোন করেন। ওই সংস্থাটি ফুটপাথবাসীদের ওষুধ দেওয়ার কাজ করে। এর প্রধান অরুন্ধতী রায়ের কথায়, “মেডিক্যাল কলেজের প্রেসক্রিপশনে যে ওষুধগুলি বাড়িতে খাওয়াতে বলা হয়েছিল তার কিছুই এত দিন দেওয়া হয়নি। গত চার দিন ধরে আমরা সব কিনে দিয়েছি। তার পরেও যখন ছেলেমেয়েদের খাওয়াতে বলছি, ওঁরা সেটুকুও করে উঠতে পারছেন না।” আরও বললেন, “ভদ্রমহিলা এত দিন কার্যত একবেলা খেয়ে বেঁচে আছেন।”

সমাজতাত্ত্বিক প্রদীপ বসু বিষয়টা শুনে অবাক হননি। বলেন, “পারিবারিক মুল্যবোধ, ন্যায়-অন্যায় বোধ সব বদলে গিয়েছে। পরিবারের বৃদ্ধদের দেখাশোনা করাটা অধিকাংশই কর্তব্য বলে মনে করেন না। অসুস্থ বৃদ্ধরা তাঁদের কাছে ফালতু বোঝা। দূর করতে পারলে বাঁচেন।” তাঁর আরও বক্তব্য, “অনেকের কাছে এখন শুধু নিজের স্বার্থটাই মূল। বৃদ্ধ বাবা-মায়ের থেকে বিপুল টাকাপয়সা পাওয়ার সম্ভাবনা থাকলে তাঁদের দেখব, না-হলে শুধু শুধু তাঁদের দায়িত্ব নিতে চান না।” বৃদ্ধদের অধিকার বিষয়ে কাজ করা জেরেন্টোলজিস্ট ইন্দ্রাণী চক্রবর্তী এ ব্যাপারে বৃদ্ধাশ্রমে, গঙ্গাসাগর মেলায় কিংবা হাসপাতালে বৃদ্ধ বাবা-মাকে ফেলে আসার উদাহরণ দেন। তাঁর মতে, “নীতি বা দায়িত্বের কথা বলে মানুষকে দিয়ে পরিবারের বয়স্কদের দায়িত্ব নেওয়ানো যাবে না। আইনি চাপ দিয়ে বাধ্য করতে হবে।”

তিনি জানান, বৃদ্ধা বাবা-মাকে এ ভাবে বাড়ির বাইরে বার করে দেওয়া আইনের নিরিখে অপরাধের পর্যায়ে পরে। ‘মেনটেন্যান্স অ্যান্ড ওয়েলফেয়ার অব পেরেন্টস অ্যান্ড সিনিয়ার সিটিজেন্স অ্যাক্ট ২০০৭’ অনুযায়ী প্রত্যেক জেলায় একটি করে মেনটেন্যান্স ট্রাইব্যুনাল রয়েছে। সেখানে কোনও বৃদ্ধ-বৃদ্ধার হয়ে দেশের যে কোনও নাগরিক বা সংগঠন মামলা করতে পারেন। এর জন্য কোনও আইনজীবীও লাগবে না। কিন্তু বাস্তবে সমাজে প্রান্তবাসী উল্লাসীদের হয়ে কেউ এগোবে কি?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন