প্রতিবন্ধী শিশুদের তাড়িয়ে চোখে জল নবান্ন-পুলিশের

খাস কলকাতা-সহ রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে শাসক দলের হাতে মার খাচ্ছে পুলিশ। কর্ত্যব্যের তাগিদে সেই পুলিশকেই এ বার এক দল প্রতিবন্ধী ছেলেমেয়ের সামনে বিক্রম দেখাতে হল। বৃহস্পতিবার নবান্ন চত্বরে। এ দিন সাড়ে ১২টা নাগাদ পূর্ব মেদিনীপুরের নিমতৌড়ি তমলুক উন্নয়ন সমিতি (স্পেশ্যাল স্কুল)-এর শিক্ষক-শিক্ষিকারা ৬০ প্রতিবন্ধী ছাত্রছাত্রীকে নিয়ে নবান্নে পৌঁছন। ওই আবাসিক বিদ্যালয়টি রাজ্য সরকার অনুমোদিত হলেও চার বছর ধরে কেন শিক্ষক-শিক্ষিকারা বেতন পাচ্ছেন না, তা জানাতেই তাঁরা এসেছিলেন।

Advertisement

সোমনাথ চক্রবর্তী

শেষ আপডেট: ১২ ডিসেম্বর ২০১৪ ০৪:০৬
Share:

স্পেশ্যাল স্কুলের পড়ুয়াদের চোখের জল আটকাতেও ব্যর্থ পুলিশ। বৃহস্পতিবার নবান্ন-চত্বরে। ছবি: সুদীপ আচার্য।

খাস কলকাতা-সহ রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে শাসক দলের হাতে মার খাচ্ছে পুলিশ। কর্ত্যব্যের তাগিদে সেই পুলিশকেই এ বার এক দল প্রতিবন্ধী ছেলেমেয়ের সামনে বিক্রম দেখাতে হল। বৃহস্পতিবার নবান্ন চত্বরে।

Advertisement

এ দিন সাড়ে ১২টা নাগাদ পূর্ব মেদিনীপুরের নিমতৌড়ি তমলুক উন্নয়ন সমিতি (স্পেশ্যাল স্কুল)-এর শিক্ষক-শিক্ষিকারা ৬০ প্রতিবন্ধী ছাত্রছাত্রীকে নিয়ে নবান্নে পৌঁছন। ওই আবাসিক বিদ্যালয়টি রাজ্য সরকার অনুমোদিত হলেও চার বছর ধরে কেন শিক্ষক-শিক্ষিকারা বেতন পাচ্ছেন না, তা জানাতেই তাঁরা এসেছিলেন। স্কুল কমিটির সম্পাদক যোগেশ সামন্তর বক্তব্য, ওই স্কুলের সমস্ত ব্যয়ভার বহন করে জনশিক্ষা প্রসার ও গ্রন্থাগার দফতর। তারা ছাত্রছাত্রীদের বই-খাতা কেনার খরচ, পুজোর পোশাক, এমনকী ভ্রমণ খরচ দিলেও শুধু শিক্ষক-শিক্ষিকাদের বেতন দিচ্ছে না। এ নিয়ে ওই জেলার মন্ত্রী সৌমেন মহাপাত্র নিজে চিঠি লিখেছেন সংশ্লিষ্ট দফতরের মন্ত্রী করিম চৌধুরীকে। একাধিক বার সরকারের কাছে দরবার করেছেন স্থানীয় তৃণমূল সাংসদ শুভেন্দু অধিকারীও। সুরাহা না হওয়ায় তাঁরা নবান্নে আসার সিদ্ধান্ত নেন।

পুলিশ জানায়, তাঁরা যোগেশবাবুদের মুখ্যমন্ত্রীর ওএসডি বিনয় ঘোষ চৌধুরীর কাছে নিয়ে যান। মিনিট পাঁচেক কথা বলার পরে ওই অফিসার চলে যান আর যোগেশবাবুরা নিজেদের দাবি-দাওয়া সম্বলিত স্মারকলিপি জমা দিয়ে বাইরে বেরিয়ে এসে নবান্নের সামনে একটি শেডের নীচে বাচ্চাকাচ্চাদের নিয়ে বসে পড়েন। ছেলেমেয়েদের কেউ চোখে দেখে না, কেউ হাঁটতে পারে না, কেউ বা আবার মানসিক প্রতিবন্ধী। পুলিশের বক্তব্য, নবান্নের চারপাশে ১৪৪ ধারা রয়েছে। তাই নবান্নের সামনে কেউ বসতে পারবেন না। হাওড়া সিটি পুলিশের অফিসাররা যোগেশবাবুদের উঠে যাওয়ার আবেদন করেন। পুলিশের সেই আবেদন যোগেশবাবুরা মানতে অস্বীকার করায় এক অফিসার তাঁদের বলেন, “এ বার আপনাদের গ্রেফতার করব।” শিক্ষিকারা সমস্বরে বলে ওঠেন, “তাই করুন স্যার।” সেই শুনে এক পা পিছিয়ে আসে পুলিশ। এর পরে নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা বলে শিক্ষকদের নবান্ন ছেড়ে যেতে ফের চাপ সৃষ্টি করেন পুলিশকর্তারা। তার পর পুলিশ যোগেশবাবুদের নিয়ে মন্দিরতলার দিকে রওনা দেয়। পিছু পিছু হাঁটতে থাকে প্রতিবন্ধী শিশুরাও, কেউ হামাগুড়ি দিয়ে, কেউ বা মায়ের হাত ধরে। সেই দেখে কর্তব্যরত এক পুলিশকর্মী বলেন, “সুন্দরবনের বাঘের জন্য সরকার কোটি টাকা খরচ করতে পারে, আর এই ছেলেমেয়েগুলোর জন্য ভাঁড়ার ফাঁকা?” তাঁর আক্ষেপ, “চাকরি বাঁচানোর তাগিদে কত অন্যায় করছি...।” চোখ ছলছল পুলিশকর্মীটির গলা বুজে আসে।

Advertisement

পুলিশ যখন মন্দিরতলা থেকে স্কুলের আট জনকে ভ্যানে তুলে শিবপুরের দিকে রওনা দেয়, বাচ্চাগুলো তখন হাউহাউ করে কাঁদছে। দু-এক জন পুলিশকর্মী তাদের ভোলানোর চেষ্টা করেন। গায়ে-মাথায় হাত বুলিয়ে তাদের শান্ত করেন অভিভাবকেরা। যোগেশবাবু জানান, দুই দিদিমণি-সহ তাঁদের আট জনকে পুলিশ শিবপুর থানায় নিয়ে যায়। সেখান থেকেই ব্যক্তিগত জামিনে মুক্তি পান সকলে। সন্ধে সাড়ে পাঁচটায় পুলিশ ওই আট জনকে ফের ভ্যানে চাপিয়ে মন্দিরতলায় পৌঁছে দেয়। বাচ্চাগুলো তখনও দাঁড়িয়ে। এক মূক কিশোরের মা পরভিন বেগম বলেন, “যদি কোনও সাহায্য মেলে, সেই আশায় শীতের সকালে বাচ্চাগুলোকে নিয়ে এসেছিলাম। তা তো মিললই না, উল্টে পুলিশ ঘাড় ধাক্কা দিচ্ছে।”

প্রতিবন্ধীদের জন্য দীর্ঘদিন কাজ করছেন বাম আমলের সুন্দরবন উন্নয়ন মন্ত্রী কান্তি গঙ্গোপাধ্যায়। তাঁর বক্তব্য, “রাজ্যের এ রকম আটটি স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষিকারা সরকারি অনুদান থেকে বঞ্চিত। সরকারে কাছে বহু দরবার করেও সমস্যা সেই তিমিরেই।” আর এই জমানার মন্ত্রী সৌমেনবাবু বলেছেন, “আমি জনশিক্ষা দফতরের মন্ত্রীকে একাধিক চিঠি লিখেছি। এখনও কেন মাস্টারমশাইরা বেতন পাচ্ছেন না, আবার খোঁজ নেব।” যে দফতরের বিরুদ্ধে যোগেশবাবুদের অভিযোগ, সেই জনশিক্ষা মন্ত্রী করিম চৌধুরীকে বৃহস্পতিবার রাতে বারবার ফোন করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন