শোভাবাজার বেনিয়াটোলা স্ট্রিটের বি কে পালের বাড়ির প্রতিমা।
সে কালের বাবুবিলাসের কলকাতায় বাগদেবীর আরাধনাতেও জাঁকজমকের কোনও খামতি ছিল না। সরস্বতী পুজোতে চলত একে অপরকে টেক্কা দেওয়ার প্রতিযোগিতা। সে দিন সন্ধ্যায় কোনও কোনও বাড়িতে বসত ধ্রুপদী সঙ্গীতের আসর। কোথাও বসত কবি গানের লড়াই তো কোথাও বা খেমটার আসর। কোথাও আবার সে দিন সম্মান জানানো হত বিদগ্ধ পণ্ডিতদের। কোনও কোনও বাড়িতে সরস্বতী পুজোর দিন হত ছোটদের হাতেখড়ি বা বিদ্যারম্ভ।
শোনা যায় ব্রাহ্মধর্ম গ্রহণ করার আগে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর নাকি এমন জাঁকজমক করে সরস্বতী পুজো করতেন যে, কলকাতা শহরে গেঁদা ফুল ও সন্দেশের আকাল দেখা দিত।
চোরবাগান রামচাঁদ শীলের পরিবারে সে কালে ছোটদের মধ্যে হুড়োহুড়ি পড়ে যেত এই নিয়ে যে, কার খাতা-বই মা সরস্বতীর পদতলে থাকবে। এ ব্যাপারে ছোটদের উৎসাহের কমতি ছিল না। ১৬০ বছরের পুরনো এই পরিবারে সরস্বতী পুজোর আর এক আকর্ষণ সাদা তিল, খোয়াক্ষীর আর সন্দেশের মিশ্রণে তৈরি ‘তিলকুটো’ নামের একটি মিষ্টি। শোনা যায় এই মিষ্টিতে ব্যবহৃত সাদা তিল এক সময় আসত বাংলাদেশ থেকে। আজও জোড়াসাঁকোর নতুন বাজারের একটি মিষ্টির দোকানে এই ‘তিলকুটো’ তৈরি হয়। এ ছাড়া পরিবারের সদস্যদের কাছে ওই দিন খিচুড়ি, নানা রকম ভাজার পাশাপাশি সাদা সিম আর বেগুন দিয়ে রান্না গোটাসেদ্ধর একটা আলাদা আকর্ষণ আছে।
সে কালে সরস্বতী পুজোর দিন বি কে পালের পাঠশালায় শিক্ষার্থীদের মধ্যে সরা বিলি করা হত। এতে থাকত লুচি, নানা রকমের মিষ্টি ও ফল। সেই পাঠশালা আজ না থাকলেও ১১৬ বছরের পুরনো শোভাবাজার বেনিয়াটোলা স্ট্রিটের বি কে পালের বাড়ির পুজোটি ঐতিহ্যে অটুট। অতীতের সরস্বতী পুজোর নানা কথা বলছিলেন এই পরিবারের অমিত পাল। তিনি জানালেন, কাঠের সিংহাসনের উপর দেবী এখানে পদ্মাসনে দাঁড়িয়ে। দু’পাশে চারটি সখি পরিবেষ্টিত। সরস্বতীর হাতে থাকে রুপোর বীণা। বিশেষ উল্লেখযোগ্য এখানে কিন্তু দেবীর বাহন হাঁস থাকে না।
তবে শুধু অভিজাত পরিবারেই নয়। সরস্বতী পুজোর অন্য গন্ধ মিলত উত্তর কলকাতার মধ্যবিত্ত পাড়াগুলিতে। উত্তর কলকাতার শ্যামচাঁদ মিত্র স্ট্রিটের বাসিন্দা নব্বই বছরের সুশীলকুমার চট্টোপাধ্যায় স্মৃতি হাতড়ে বলছিলেন সে কালের মধ্যবিত্ত পাড়ার সরস্বতী পুজোর কথা। তখন রাস্তায় প্যান্ডেল করে যত্রতত্র পুজো হত না। পুজো হত বাড়িতে কিংবা পাড়ার বিভিন্ন ক্লাবে। সেই সব ক্লাবগুলিতে নিয়মিত শরীরচর্চা হত। সেখানেই বাঁশ ও দরমা দিয়ে মণ্ডপ তৈরি করে প্রতিমা বসানো হত।
পুজোর আগের দিন রাত জেগে নানা রঙের কাগজ কেটে, শিকল তৈরি করে সেই মণ্ডপ সাজানো হত। মণ্ডপে জ্বলত হ্যাজাকের আলো। সরস্বতী পুজো উপলক্ষে পাড়ায় পাড়ায় হত নাটক কিংবা থিয়েটার। প্রতি বছর সরস্বতী পুজোর সময় শিকদার বাগানের একটি ক্লাবে আসতেন ছবি বিশ্বাস। ১৯৩৫ নাগাদ কুমোরটুলির প্রখ্যাত শিল্পী এন সি পালের তৈরি প্রতিমার দাম ছিল ৩৫ টাকা। পুজোর দিন সকালে যখন ছোট ছেলেমেয়েরা ধুতি-পাঞ্জাবি আর লাল পেড়ে বাসন্তী রঙের শাড়ি পরে রাস্তায় বেরতো, দেখে মনে হত এ যেন অন্য কলকাতা। সে কালেও পুজোয় বাজানো হত গান। ছোট ছোট ক্লাবে বাড়ি থেকে গ্রামোফোন আর রেকর্ড নিয়ে এসে বাজানো হত। আর অবস্থাপন্ন ক্লাবগুলিতে ভাল্ভ অ্যামপ্লিফায়ার দিয়ে গান বাজনো হত। দুপুরে খিচুড়িভোগ পাওয়ার জন্য হুড়োহুড়ি পড়ে যেত। আর ছিল কুলের চাটনি। পুজোর পরের দিন পাড়ায় পাড়ায় হত ছোটদের ভুরি ভোজ। পাড়ার কোনও এক জন পয়সাওয়ালা লোক এ দিনের খাওয়াদাওয়ার খরচ দিতেন।
বিসর্জনের দিন কোন ক্লাবের প্রতিমা আগে যাবে এই নিয়ে মাঝেমধ্যেই মারপিট বেঁধে যেত এক পাড়ার সঙ্গে অন্য পাড়ার ছেলেদের। সন্ধেবেলা মুটের কাঁধে প্রতিমা নিয়ে বেরত বিসর্জনের শোভাযাত্রা। এই শোভাযাত্রায় থাকত কারবাইড গ্যাসের আলো। আর থাকত নানা রকমের সঙ। তার পর এক দিন সব কিছুই আধুনিক হতে লাগল। হারিয়ে গেল বাঙালির পুজো পার্ব্বনের অনেক কিছুই। আর ক্রমেই সরস্বতী পুজোও হয়ে গেল বাঙালির ভ্যালেনটাইন্স ডে।