চাবিই হতে পারে আসল রহস্য উন্মোচনের চাবিকাঠি।
অন্তত এমনটাই মনে করছেন পুলিশকর্তারা। বৃহস্পতিবার সকালে গার্ডেনরিচ থানার রামনগর লেনে জহুরা খাতুন নামে এক বৃদ্ধা ও তাঁর নাতনি ফারিয়াকে রক্তাক্ত ও ক্ষতবিক্ষত অবস্থায় উদ্ধার করেছিল পুলিশ। তাঁদের হাসপাতালে নিয়ে গেলে সেখানেই জহুরাকে মৃত ঘোষণা করা হয়। আশঙ্কাজনক অবস্থায় একবালপুরের একটি বেসরকারি নার্সিংহোমে ভর্তি রয়েছে ফারিয়া। তদন্তে নেমে ওই দিনই জহুরার ফ্ল্যাটের মূল দরজার পাশ থেকে খোলা একটি তালা এবং রান্নাঘর থেকে একটি চাবি উদ্ধার করে পুলিশ। তা থেকেই পুলিশের অনুমান, আততায়ীরা চাবি দিয়ে তালা খুলেই ওই ফ্ল্যাটে ঢোকে। তবে কারা, কী উদ্দেশে বৃদ্ধাকে খুন করল, তা নিয়ে এখনও অন্ধকারে রয়েছে পুলিশ।
পুলিশ জেনেছে, বৃহস্পতিবার নাতি আরশাদ খাবার কেনার টাকা চাইতে ঠাকুরমা জহুরার ঘরে যায় এবং সেখানে ঠাকুরমা ও বোন ফারিয়াকে ক্ষতবিক্ষত, রক্তাক্ত অবস্থায় দেখতে পায়। এর পরে জহুরার বড় ছেলে রহমতউল্লাহ গার্ডেনরিচ থানায় খুনের অভিযোগ দায়ের করেন। তবে খুনের কোনও অস্ত্র এখনও উদ্ধার হয়নি। এ ছাড়া, জহুরা ও ফারিয়া যে খাটের উপর পড়েছিলেন, সেখানে ছাড়া আর কোথাও রক্তের দাগও মেলেনি। ময়না তদন্তে জানা গিয়েছে, জহুরাকে খুন করা হয় ভোর ৪টে নাগাদ। এ দিকে হাসপাতাল সূত্রে খবর, ফারিয়ার বেশ কয়েক বার অস্ত্রোপচার হয়েছে। তার একটি চোখ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এখনও তার অবস্থা আশঙ্কাজনক। তবে ফারিয়াই যেহেতু খুনিকে দেখেছে, তাই মূলত তার জবানবন্দির জন্যই অপেক্ষা করছে পুলিশ।
বৃহস্পতিবার রাতেই ঘটনাস্থল পরিদর্শনে যান কলকাতা পুলিশের যুগ্ম কমিশনার (অপরাধ দমন) পল্লবকান্তি ঘোষ-সহ লালবাজারের গোয়েন্দারা। বৃহস্পতিবার ও শুক্রবার দফায় দফায় পুলিশকর্তারা কথা বলেন জহুরার পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে। তাঁরা পুলিশকে জানিয়েছিলেন, জহুরার উচ্চ রক্তচাপ, থাইরয়েড এবং সুগারের সমস্যা ছিল। তিনি রাতে ঘুমের ওষুধ খেতেন। তিনি ঘুমিয়ে পড়লে ফারিয়া তা পরিবারের লোকেদের জানাত এবং তাঁরা ওই ফ্ল্যাটের কোলাপসিব্ল গেটে তালা দিয়ে আসতেন। ভিতরে কাঠের দরজাটি অবশ্য খোলা থাকত বলে জেনেছে পুলিশ।
পরিবারের তরফে পুলিশকে জানানো হয়েছে, বুধবার রাতে ওই ফ্ল্যাটের তালা বন্ধ করেন জহুরার মেজো ছেলে এবং তাঁর স্ত্রী। শুক্রবার ওই ফ্ল্যাটের সামনে দাঁড়িয়ে মেজ ছেলে আহমেদউল্লাহের স্ত্রী শেহনাজ বেগম বলেন, “রাতে মায়ের পায়ে তেল মালিশ করে আমরা নিজেদের ফ্ল্যাটে চলে আসি। রাত ১টা নাগাদ আমার স্বামী কোল্যাপসিব্ল গেটে তালা দেন।” তাঁর দাবি, জহুরার কাছে ডুপ্লিকেট চাবি থাকত। থাকত মোবাইলও। ঘটনাস্থল থেকে দু’টি মোবাইল এবং বেশ কয়েক হাজার টাকা উদ্ধার হয়েছে বলে জানিয়েছে পুলিশ।
তদন্তকারীদের দাবি, রান্নাঘরে পাওয়া চাবিটি বৃদ্ধার ডুপ্লিকেট চাবি হতে পারে। আবার সেটি আততায়ীর ব্যবহার করা আলাদা ডুপ্লিকেট চাবিও হতে পারে বলে অনুমান পুলিশের। পুলিশের দাবি, জহুরার পরিজনেরাই যেহেতু শেষ বার চাবি দিয়েছিলেন, তাই সেটি তাঁদের কাছেও থাকার কথা। কিন্তু তাঁরা পুলিশকে যে চাবি দিয়েছেন, তা দিয়ে ওই তালা খোলা যাচ্ছে না। তাঁদের কাছে আসল চাবি চাওয়া হয়েছে। যদিও এখনও সেটি পুলিশের কাছে জমা পড়েনি।
একই সঙ্গে আরও একটি বিষয় ভাবাচ্ছে পুলিশকে। জহুরার পরিবারের তরফে পুলিশকে বৃহস্পতিবার জানানো হয়, তাঁদের এবং সামনের ফ্ল্যাটের দরজা আটকে দিয়েছিল আততায়ীরা। যদিও পরিবারেরই অনেকে আলাদা জেরায় জানান, তাঁদের ঘরের দরজা বন্ধ ছিল না। আরশাদই এসে তার কাকাদের ডাকে।
শুক্রবার গার্ডেনরিচের ওই পাড়ায় গিয়ে দেখা যায় পরিস্থিতি থমথমে। কেউই তেমন কথা বলতে চাইছেন না। বহুতলের বাইরে বসে এক পুলিশকর্মী। তবে ওই পরিবারের সদস্যেরা জানান, বৃহস্পতিবার চার বার পুলিশ এলেও শুক্রবার কেউ পরিদর্শনে আসেননি। এ দিন বৃদ্ধার ছোট মেয়ে রাবিয়া খাতুন জানান, আগে ওই ফ্ল্যাটে জরির কাজ হত। জহুরাও আগে ছেলেদের সঙ্গেই থাকতেন। ন’বছর আগে তাঁর স্বামী মহম্মদ হাসিম মারা যান। তবে কারখানা বন্ধ হয়ে গেলে ফ্ল্যাটটি পড়েই ছিল। বর্তমানে সেখানে থাকতেন জহুরা। রাতে নাতনি ফারিয়া তাঁর সঙ্গে ঘুমোতে আসত। রাবিয়া আরও জানান, জহুরার তিন ছেলে বর্তমানে আলাদা আলাদা ভাবে বাড়ি-বাড়ি কেরোসিন তেল সরবরাহ করেন। তাঁরা একসঙ্গে কেরোসিন তেল সরবরাহের ব্যবসা খোলার কথা ভাবছিলেন।
এ দিন পাশের ফ্ল্যাটের বাসিন্দারা জানান, জহুরা পাড়ায় সকলের সঙ্গে মিশতেন। লোকজনকে সাহায্যও করতেন। খুনের কারণ পরিষ্কার নয় তাঁদের কাছেও। ঘটনার সময়ে কোনও আওয়াজ পাননি তাঁরা। ঘটনার পর থেকে তাঁরাও নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন বলে জানান ওই প্রতিবেশীরা।