তখনও ভোরের আলো ফোটেনি। রবিবার সুধীর বসু রোডের ঘিঞ্জি বস্তির একচিলতে ঘরে মা-বাবার সঙ্গে ঘুমিয়ে ছিল বছর ষোলোর কিশোরটি। হঠাৎই দরজায় ঠক-ঠক আওয়াজ। মা ঘুম থেকে উঠে দরজা খুলতেই বদলে গেল এক সন্তানকে নিয়ে মা-বাবার ছোট্ট পরিবারের ছবিটা।
ওই পরিবারের একমাত্র সন্তানকেই একবালপুর হত্যাকাণ্ডের অন্যতম অভিযুক্ত হিসেবে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। কিন্তু সোমবার দুপুরেও এ কথা বিশ্বাস করতে পারছিলেন না ছেলেটির বাবা। কথা বলতে বলতেই কানে আসছিল ঘরের ভিতরে থাকা মায়ের ফোঁপানির শব্দ।
ওই কিশোরের বাবা জানালেন, খিদিরপুর এলাকারই একটি স্কুলে অষ্টম শ্রেণিতে পড়ে ছেলে। পড়াশোনা আর সরু গলির ক্রিকেটেই মজে থাকত সে। মাঝেমধ্যে সাইকেল কিনে দেওয়ার জন্য বায়না জুড়ত বাবার কাছে। শুধু তাঁরা কেন, ওই আপাত শান্ত ছেলেটা যে আর তিন জনের সঙ্গে মিশে প্রায় তারই বয়সী দু’টি মেয়ে ও তাদের মা-কে খুন করতে পারে, এ কথা বিশ্বাস করছেন না পাড়ার লোকেরাও। কিন্তু অবিশ্বাস করারই বা জায়গা কোথায়? বস্তিতে ঢোকার মুখে দাঁড়িয়ে এক বাসিন্দা বললেন, “চোখের সামনেই তো লাশ বেরোতে দেখলাম। শুনলাম, জেরায় অপরাধ স্বীকারও করেছে ওরা।”
ছেলের সঙ্গে যে ইদানীং একবালপুর কাণ্ডের অন্যতম অভিযুক্ত মহম্মদ আমিনের ঘনিষ্ঠতা বেড়েছিল, তা অবশ্য মেনে নিয়েছেন ওই কিশোরের বাবা। বললেন, “আমিন বখে গিয়েছিল। তাই ছেলেকে ওর সঙ্গে মিশতে বারণ করতাম আমি। আমিনের বাবাও একই কথা বলতেন। কিন্তু ছেলে শুনল না।” পুলিশ সূত্রের খবর, মোটরবাইক কিনে দেওয়ার লোভ দেখিয়ে দুই কিশোরকে দলে টেনেছিল সিকন্দর। ওই কিশোরের বাবা অবশ্য বলছেন, “আমার ছেলে মোটরবাইক চালাতেই জানত না। তা ছাড়া, কেউ ভালবেসে দশ টাকা দিলেও ও মাকে এসে বলত! মোটরবাইক কিনে দেওয়ার কথাটা ওর মাকে বলল না!”
ছেলে যে খুন করেছে, এটা রবিবার থেকে বিশ্বাস করতে পারছেন না একবালপুর-কাণ্ডে ধৃত আর এক কিশোরের মা-দিদিরাও। সুধীর বসু রোডে তারের জটলা পেরিয়ে বহুতলের ভিতরে ঢুকতেই নাকে ভেসে এল রান্নার গন্ধ। সামনে কলতলা। সরু সিঁড়ি বেয়ে দোতলার কোনার ফ্ল্যাটে দুই দিদি-মা-বাবার সঙ্গে থাকত বছর সতেরোর ওই কিশোর। ঘিঞ্জি ঘরে ঠিক মতো আলো পৌঁছয় না। দিনের বেলাতেও আলো জ্বালিয়ে কাজ করছিলেন মহিলারা।
ওই কিশোরের মা-ই জানালেন, সপ্তম শ্রেণির পরে পড়াশোনা ছেড়ে দিয়েছিল ছেলে। ঢুকেছিল পারিবারিক গ্যারাজের ব্যবসায়। কাজ থেকে ফিরে পাড়ায় আড্ডা দিত। রাত দশটা-সাড়ে দশটার মধ্যেই ঘরে ফিরে আসত। পাড়ার ছেলেদের সঙ্গে মিশলেও ইদানীং ওর ঘনিষ্ঠতা বেড়েছিল তুতো সম্পর্কের কাকা সিকন্দরের সঙ্গে। “সিকন্দর আমাদের আত্মীয়। তাই ঘনিষ্ঠতা নিয়ে মাথা ঘামাইনি”, বলছেন ওই কিশোরের মা। সেই সিকন্দরই যে ছেলেকে এমন অপরাধে ফাঁসিয়ে দেবে, এ দিন দুপুরেও তা বিশ্বাস করতে পারছিলেন না মহিলা। বারবার বলছিলেন, “ও খুন করতে পারে না, পারে না!” পুলিশ অবশ্য বলছে, ২৯ মার্চ দুপুরে পুষ্পা সিংহ ও তাঁর মেয়েদের খুন এবং ওই রাতেই সিকন্দরের দোকানে দেহগুলি পুঁতে দেওয়ার পুরো কাজেই জড়িয়ে ছিল ওই দুই কিশোর।
যদিও গত সপ্তাহ দুয়েকে ওই দুই কিশোরের মধ্যে কোনও অস্বাভাবিকতা লক্ষ করেননি অভিভাবকেরা। বছর ষোলোর কিশোরের বাবা বললেন, “ছেলে তো দিব্যি ঘুরে বেড়াত। চোখে-মুখে কোনও ভয় বা অপরাধ বোধের ছাপও দেখিনি।” একই কথা জানালেন বছর সতেরোর কিশোরের মা-ও। তিনি জানালেন, গত ৩ এপ্রিল ছেলেকে একটি সংগঠনের মাধ্যমে ধর্মপ্রচারের কাজে যোগ দিতে পাঠিয়েছিলেন। শনিবার রাতে সেই সংগঠনের আস্তানা থেকেই তাকে পাকড়াও করে পুলিশ।
ওই দুই কিশোরের এই পরিণতির জন্য তাদের আর্থ-সামাজিক অবস্থানকেই প্রধানত দায়ী করছেন মনস্তত্ত্ববিদেরা। তাদের মতে, এরা এমন একটি পরিবেশে বাস করে, যেখানে নানা অপরাধ বা শোষণ নিত্য ঘটে থাকে। ফলে আর পাঁচটা মধ্যবিত্ত-উচ্চ মধ্যবিত্ত পরিবারের কাছে যেটা অস্বাভাবিক, এদের কাছে তা স্বাভাবিক। অর্থনৈতিক কারণে এদের দামি জিনিসের টোপ দিয়ে অপরাধে টানাটাও সহজ। মনস্তত্ত্ববিদ সুদীপ বসু বলছেন, “এদের থেকেও বড় অপরাধী সিকন্দরের মতো লোকেরা। তারাই এদের দুর্বলতাকে কাজে লাগিয়ে অপরাধে জড়ায়।” এই কারণে জুভেনাইল জাস্টিস আইনেও সিকন্দর অভিযুক্ত হতে পারে বলে সুদীপবাবু জানিয়েছেন।
কিন্তু অপরাধের পরেও এতটা নিস্পৃহ থাকল কী করে ওই দুই অভিযুক্ত কিশোর?
মনস্তত্ত্ববিদদের ব্যাখ্যা, এটা সাবালকত্বের লক্ষণ। ১৬-১৭ বছর বয়সে ৯০ শতাংশ কিশোর-কিশোরীই এটা রপ্ত করে ফেলে। এটা সমাজের মধ্যবিত্ত বা উচ্চবিত্ত পরিবারেও দেখা যায়। প্রসঙ্গত, দিল্লিতে নির্ভয়া-কাণ্ডেও এক কিশোর অপরাধী রয়েছে। সে সময় প্রশ্ন উঠেছিল, এই ধরনের অপরাধের ক্ষেত্রে জুভেনাইল আইনে বদল আনা হবে কি না? একবালপুরের ক্ষেত্রেও একই প্রশ্ন উঠেছে।
সুদীপবাবু অবশ্য বলছেন, “এটা নিয়ে বিতর্ক হতেই পারে। কিন্তু বিচার ব্যবস্থায় কোথাও একটা মাপকাঠি স্থির করে নিতে হয়। সে দিক বিচার করেই ১৮ বছরকে আইনগত ভাবে সাবালক হিসেবে ধরা হচ্ছে।”