বর্ষা এলেই মনে হয় শহর জুড়ে গাছের চারা লাগাই

আমার যখন ছ’ মাস বয়স, মালদহ থেকে চলে আসি কলকাতায় যাদবপুরে। কাঁচা নর্দমা, বাস রাস্তা বাদ দিলে গোটা যাদবপুরেই কাঁচা রাস্তা। এক ছুটে রাস্তা পার হয়ে ঢুকে যেতাম ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে। ওই জায়গাটা অবশ্য তখন খুব সুন্দর। কত না রকমারি ফুলের বাহার। ভাললাগা আর ভালবাসা। এখন তো সব কিছু বদলে গেছে। পুরনো যাদবপুরটা আমার এখনও মনে আছে।

Advertisement

নীলা মজুমদার

শেষ আপডেট: ২১ জুন ২০১৪ ০০:০৫
Share:

পদ্মাদেবীর সঙ্গে নীলা মজুমদার।

আমার যখন ছ’ মাস বয়স, মালদহ থেকে চলে আসি কলকাতার যাদবপুরে। কাঁচা নর্দমা আর বাস রাস্তা বাদ দিলে গোটা যাদবপুরেই তখন কাঁচা রাস্তা। এক ছুটে রাস্তা পার হয়ে ঢুকে যেতাম ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে। ওই জায়গাটা অবশ্য তখন খুব সুন্দর। কত না রকমারি ফুলের বাহার। ভাললাগা আর ভালবাসা। এখন তো সব কিছু বদলে গিয়েছে। পুরনো যাদবপুরটা আমার এখনও মনে আছে।

Advertisement

সেই কোন ছোটবেলায় আমার প্রথম সঙ্গীতগুরু প্রয়াত হিমঘ্ন রায়চৌধুরী এক দিন আমাকে সিংহী প্যালেসে নিয়ে গেলেন। কোরাস গান গাইতে হবে। তখন ওখানে খুব ভাল ভাল গানের অনুষ্ঠান হত। গড়িয়াহাট তখন খুব শান্ত নিরিবিলি ছিল। এখন যেমন সব সময় ব্যস্ততা, সেই নিরিবিলির ছবিটা আর মেলাতে পারি না।

বেলতলা স্কুলে ক্লাস নাইনে পড়ার সময়েই ‘মিউজিক’ আমার অন্যতম বিষয় ছিল। সেই শুরু। উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতে তালিম শুরু তারাপদ চক্রবর্তীর কাছে। তার পর এ কানন। পরবর্তীতে লেডি ব্র্যাবোর্ন কলেজে পড়বার সময় থেকেই পার্ক সার্কাস ময়দান আমার খুব প্রিয় একটি জায়গা। মনের সব উচ্চাশা মনে মনে আওড়াতাম ফাঁকা পার্কের এক কোণে বসে। এখন এখানেও কোনও নির্জনতা নেই। জাল দিয়ে ঘিরে ছোট ছোট করে সেই অবাধ নির্জনতাকে বিসর্জন দেওয়া হয়েছে। আসলে কলকাতায় ‘নির্জনতা’ কথাটাই বেমানান হয়ে গিয়েছে।

Advertisement

তবুও কলকাতা আমার প্রিয় শহর, মনের শহর। আশির দশকের গোড়ায় এই শহর থেকেই তো প্রথম রেকর্ড গ্রামোফোন কোম্পানি থেকে বেরোয়। এই শহরই তো আমার পরিচিতির পরিধি বাড়িয়ে দিয়েছিল গ্রাম থেকে গ্রামে, দেশের বাইরেও। ডাক এল বিদেশ থেকে। দ্বিজেন্দ্রলাল, অতুলপ্রসাদ, রজনীকান্তের গানের প্রশংসা বিদেশ থেকে! ভাবলেই আনন্দে চোখে জল চলে আসে। পরবর্তীতে আমেরিকায় সেই সব গান শোনাতে গিয়ে শুধু একটা কথাই ভেবেছি, কলকাতা আমাকে কোথায় পৌঁছে দিয়েছে।

কিন্তু ইদানীং এই শহরটা নিয়ে অভিমানে কুঁকড়ে থাকি। পরিবেশের উন্নতির জন্য সচেতনতার এত অভাব কেন? আমরা নিজেরাই তো শহরটাকে আরও পরিষ্কার করে রাখতে পারি। একটা উদাহরণ না দিলে বোঝাতে পারব না। এক বার অনুষ্ঠানের পর নায়েগ্রা জলপ্রপাত ঘুরে দেখছি। হাঁটতে হাঁটতে বিস্কুটের একটা ছোট্ট অংশ মাটিতে পড়ে গিয়েছিল। পিছনেই ছিল একটি জাপানি পরিবার। এক জন এগিয়ে বললেন, ‘ক্যুড আই হেল্প ইউ?’ টুকরোটা হাতে তুলে নিলেন। সে লজ্জার কথা আজও ভুলিনি। আসলে আমাদের অভ্যাসটা বদলাতে হবে। বদলাতে গেলে পরবর্তী প্রজন্মকেও সঙ্গী করতে হবে। ওদের এড়িয়ে নয়। আমাদের অসমাপ্ত কাজ যে ওরাই করবে।


পিছনে হাডসন নদী, ওপারে দেখা যাচ্ছে ‘স্ট্যাচু অফ লিবার্টি’।

জীবন দ্রুত বদলায়। শহর দ্রুত পাল্টায়। পাল্টাচ্ছে, তবে কোনওটা ভাল, কোনওটা খারাপ। একটা ব্যাপারে ভীষণ গর্ববোধ করি, তা হল এই শহর সবার জন্য। তবে সবাইকে আপন করে নিতে গিয়ে কলকাতা বড় ভারাক্রান্ত হয়ে পড়ছে। প্রতি দিন লক্ষ লক্ষ মানুষ রুজি-রোজগারের জন্য শহরে এসে ঢুকছেন। তার উপরে এত বেশি যানজট, যে গতি শব্দটাই অর্থহীন হয়ে পড়ছে। কলকাতার এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে যেতে অনেক বেশি সময় লাগছে। ফুটপাথ বেদখল হয়ে গিয়েছে। ঠিক মতো হাঁটা দায়। ব্যস্ত সময়ে ফুটপাথ ছেড়ে বড় রাস্তাতেও নেমে আসতে হচ্ছে। কিন্তু কে ভাববে কার কথা?

এখন কলকাতা যেন বনফুলের লেখা ‘নিমগাছ’।

‘কেউ ছালটা ছাড়িয়ে নিয়ে সিদ্ধ করছে
পাতাগুলো ছিঁড়ে শিলে পিষছে কেউ
কেউ বা ভাজছে গরম জলে.....’।


সঙ্গে কৃষ্ণা চট্টোপাধ্যায়।


নির্মলা মিশ্র ও প্রদীপ দাশগুপ্তের সঙ্গে শিল্পী।

আশ্চর্যের ব্যাপার, নিমগাছের মতো এই শহরটাকে ব্যবহার করছে সবাই, কিন্তু তার পরিণতির কথা কেউ ভাবছে না। প্রতি বছর বর্ষা আসে, আমার মনে এই শহর নিয়ে নানা স্বপ্নের জাল আমাকে বিদ্রোহী করে তোলে। এক এক সময়ে মনে হয়, শহরের সবাইকে ডেকে নিয়ে যে যেখানে পারি, যতটা পারি গাছের চারা বসিয়ে দিই। এক দিন সেই সবুজে আমরা ভেসে যাব নতুন করে বাঁচার আনন্দে।

লেখক: সঙ্গীতশিল্পী

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement
Advertisement