হেলমেট ছাড়াই বেপরোয়া বাইক-সফর। পুলিশ দর্শক। বর্ষবরণের রাতে, পার্ক স্ট্রিটে। ছবি: রণজিত্ নন্দী।
বড় কোনও অশান্তি বা অঘটন ছাড়াই বর্ষবরণের রাত কাটাল কলকাতা। শহরে পুলিশি নিরাপত্তা ছিল ব্যাপক। গোড়া থেকে পুলিশ তত্পরও ছিল তা নিয়ে। কিন্তু সেই সঙ্গেই লোকের ভিড় বা উন্মাদনা দুই-ই ছিল অন্য বছরের তুলনায় কিছুটা কম। ভিড়ের নিরিখে তো বটেই, গভীর রাতে উল্লাসের যে প্রকাশ বরাবর দেখে এসেছে পার্ক স্ট্রিট, এ বার তা-ও যেন কিছুটা স্তিমিত। নববর্ষের সকালে চিড়িয়াখানাতেও ভিড় ছিল গত বারের চেয়ে অনেক কম। অনেকে কটাক্ষ করে বলছেন, ‘এ বড় সুখের সময় নয়। আনন্দেও তাই হয়তো ভাটার টান।’
নতুন বছরকে স্বাগত জানানোর উচ্ছ্বাস, উন্মাদনা সব কিছুতেই লাগাম পরাতে প্রথম থেকেই মরিয়া চেষ্টা চালিয়েছিল কলকাতা পুলিশ। পার্ক স্ট্রিট, মির্জা গালিব স্ট্রিট, রাসেল স্ট্রিট, মিডলটন রো-সহ অন্যান্য রাস্তার প্রতিটি মোড়ে তৈরি হয়েছিল পুলিশ বুথ। বর্ষবরণের রাতে ভিড় দেখলেই ক্যামেরা হাতে হাজির হয়েছেন কলকাতা পুলিশের কর্মীরা। উর্দিধারীর পাশাপাশি পার্ক স্ট্রিট ছেয়ে ছিল সাদা পোশাকের পুলিশও। বেশিক্ষণ কোথাও জটলা থাকলেই লাঠি উঁচিয়ে তেড়ে গিয়েছে পুলিশ। তবু ভিড় সে ভাবে যেন দানা বাঁধেনি। অপরাধ-অভিযোগের সংখ্যাও কম। শ্লীলতাহানির চেষ্টা, গণ্ডগোল পাকানো, মত্ত অবস্থায় গাড়ি চালানো-সহ বিভিন্ন অপরাধে পার্ক স্ট্রিট-সহ শহর জুড়ে গ্রেফতার হয়েছেন ৩৩৭ জন। তাঁদের মধ্যে ৪৪ জন পার্ক স্ট্রিট থানায়। আবার হেলমেট ছাড়া বেপরোয়া গতিতে মোটরবাইক চালানোর জন্য ৭৮০টি কেস হয়েছে। গত বছরের নিরিখে মোট গ্রেফতারের সংখ্যা অনেক কম, বলছেন পুলিশের একাংশই। তার মধ্যেই হুড খোলা গাড়ি, মোটরবাইকে ঝড়ের গতিতে পার্ক স্ট্রিটে দাপিয়ে বেড়িয়েছেন একদল যুবক-যুবতী। কখনও একটা বাইকের পিছনে চার জন পুলিশ তাড়া করে কখনও বা চলন্ত বাইক থেকে চাবি টেনে খুলে নিয়েছে পুলিশ। মোটরবাইকের দৌরাত্ম্য অবশ্য তাতে ম্লান হয়নি তেমন। এক পুলিশকর্তাই স্বীকার করেছেন, বেপরোয়া সব বাইককে শায়েস্তা করা সম্ভব হয়নি।
শহরজুড়ে যে কয়েকটি দৌরাত্ম্যের অভিযোগ উঠেছে, তার একটি নিউ টাউনের চণ্ডীবেড়িয়ায়। বুধবার রাত সাড়ে বারোটা নাগাদ এক তরুণী তাঁর স্বামীর সঙ্গে মোটরবাইকে যাওয়ার পথে স্থানীয় কয়েক জন যুবক তাঁদের পথ আটকে মারধর এবং তরুণীর শ্লীলতাহানি করে বলে অভিযোগ। এমনকী, মেয়েটির স্বামীর মোবাইল, টাকা-পয়সাও ছিনিয়ে নেওয়া হয়। বৃহস্পতিবার থানায় অভিযোগ দায়ের করেন ওই তরুণীর বাবা। ওই রাতেই বাগুইআটির ক্রিশ্চানপাড়ায় দীপক মালাকার নামে এক যুবক নিজের বাড়িতে ঢোকার সময়ে তাঁকে মারধর এবং বাধা দিলে তাঁর মা ও দিদিকেও মারধরের অভিযোগ ওঠে একদল যুবকের বিরুদ্ধে।
তবে মেঘলা দিন, সন্ধে থেকে অল্পস্বল্প বৃষ্টি মাথায় করে যাঁরা পথে নামেন, তাঁদের মধ্যে চেনা উচ্ছ্বাস-উন্মাদনার ছবিটা বহাল। সন্ধে থেকেই ঢল নামছিল এলইডি আলোয় ঝলমলে পার্ক স্ট্রিট জুড়ে। খাস কলকাতা থেকে মফস্সলের মানুষ, সান্তা টুপি, প্রজাপতি, নানা আকারের রঙিন চশমা পরা ভিড়টা ঘুরপাক খেতে খেতে এগিয়েছে পুলিশের ব্যারিকেড করে দেওয়া ফুটপাথ ধরে। যানবাহনের রাশ টানতে একমুখী করা হয়েছিল রাস্তা। ঘড়ির কাঁটায় রাত ১২টা। ভুভুজেলার কানফাটানো শব্দে ভেসে গেল আলোয় মোড়া পার্ক স্ট্রিট। রাস্তার দু’ধারে ব্যারিকেডে আট থেকে আশির উন্মাদনাকে আটকে রাখার মরিয়া চেষ্টার মাঝে কলকাতা পুলিশ মাইকে ঘোষণা করল ‘হ্যাপি নিউ ইয়ার’।
বাংলাদেশ থেকে কলকাতায় বর্ষবরণ উত্সব দেখতে ছুটে আসেন একটি পরিবার। তাঁদের কথায়, “গত বছর থেকেই পরিকল্পনা করেছিলাম। এ বার আসতে পারলাম।” পার্ক স্ট্রিট তো বটেই, ভিড় জমেছিল শহর জুড়ে হোটেল-রেস্তোরাঁ, পাব-ডিস্কোথেক, সর্বত্রই। বেশি রাতে উত্তেজনার পারদ কিছুটা কমেছে বটে। তবে রাত সওয়া ১টায় পার্ক স্ট্রিটের দু’ধারের গার্ড রেল তুলে নেওয়ার পরে পায়ে হেঁটেই বাড়িমুখো হয়েছে জনতা।