অফিসযাত্রীদের ভিড়ে ঠাসা মেট্রোর কামরায় পুরুষবন্ধুকে জড়িয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন কলেজের তৃতীয় বর্ষের তরুণীটি। ‘অপরাধ’ এইটুকু। তারই মাসুল দিয়ে দুই সহযাত্রীর হাতে মার খেলেন ওই তরুণীর সঙ্গী যুবক। তার আগে তাঁদের লক্ষ করে ওই কামরায় উপস্থিত দুই ‘স্বঘোষিত অভিভাবক’ অশ্লীল মন্তব্য ও কটূক্তি করে বলে অভিযোগ, সঙ্গে অভব্য অঙ্গভঙ্গিও। কামরার অন্য যাত্রীরাও প্রতিবাদ করেননি। শুধু বিষয়টি মারধর পর্যন্ত গড়ালে সেন্ট্রাল স্টেশনে তাঁরা জোর করে চার জনকেই ট্রেন থেকে নামিয়ে দেন। খবর যায় পুলিশে। বৌবাজার থানায় অভিযোগ দায়ের হয়।
সোমবার সন্ধ্যায় খাস কলকাতায় এই ঘটনা সমাজের এই ধরনের ‘অতিসক্রিয় রক্ষাকর্তা’দের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলে দিয়েছে। যদিও এর নজির একেবারে নতুন নয়। ভ্যালেন্টাইন্স ডে-পালনের প্রতিবাদ বা মেয়েদের জিন্স পরার মতো বিষয়ের নিন্দা করার মতো কাজে এঁদের পেশী আস্ফালন আগেও টের পাওয়া গিয়েছে। পার্কে বসে থাকা প্রেমিক-প্রেমিকাকে উত্ত্যক্ত করারও একাধিক উদাহরণ রয়েছে। তবুও সমাজের একাংশ প্রশ্ন তুলছে, কে কার সঙ্গে কী ভাবে দাঁড়াবে, তা মুষ্টিমেয় কিছু লোককে ঠিক করে দেওয়ার অধিকার কে দিয়েছে? তার থেকেও বড় কথা, তাদের ঠিক করে দেওয়া সামাজিক আচরণ মানা হচ্ছে না বলে তারা মারধর করবে, এমন সাহস ওই নীতিবাগীশদের হয় কী করে?
থানায় পুলিশ ও অভিযুক্তদের সামনে ফোঁপাতে ফোঁপাতে ওই তরুণীও বলছিলেন সে কথা “আমার শরীর ভাল লাগছিল না বলে আমার বন্ধুকে ধরে দাঁড়িয়েছিলাম। তার জন্য ওরা অশালীন মন্তব্য করার বা মারধর করার কে?” ধোপদুরস্ত পোশাক পরা, অভিজাত চেহারার অভিযুক্তেরা তখনও বারবার বলছিলেন, “স্যার, মেয়েটা অত লোকের সামনে ভিড় মেট্রোয় ছেলেটাকে জড়িয়ে ধরেছিল! ভাবুন এক বার! আমরা বারণ করলেও শুনছিল না। কী ধরনের ছেলেমেয়ে এরা!” যা শুনে পুলিশও ধমক দিয়ে দুই অভিযুক্তকে বলে, “আপনারা তা ঠিক করার কে মশাই?” পুলিশ অবশ্য উভয়পক্ষের ধস্তাধস্তির একটি মামুলি অভিযোগ লিখে অভিযুক্তদের হুঁশিয়ারি দিয়ে ছেড়ে দেয়।
তবে এই ঘটনা নাড়া দিয়েছে সমাজের বিভিন্ন স্তরের বিশিষ্ট মানুষদের। তাঁদের সকলেরই বক্তব্য, সমাজের ‘নীতিরক্ষক পুলিশগিরি’ কখনওই এই পর্যায়ে যেতে পারে না। তাই মেট্রোয় যে ভাবে ওই তরুণ-তরুণীকে হেনস্থা হতে হয়েছে, তা মেনে নেওয়া যায় না।
মনস্ত্বত্ত্বের শিক্ষিকা নীলাঞ্জনা সান্যালের ব্যাখ্যায়, এর মধ্যে রয়েছে ‘না-পাওয়ার’ অসহিষ্ণুতা। “আমার সামনে এক জন একটি মেয়ের সান্নিধ্য পাচ্ছে। আমার মনেও সেই চাহিদা রয়েছে, কিন্তু আমি পাচ্ছি না এই হতাশা থেকেও এমন আগ্রাসন আসতে পারে” বলছিলেন তিনি।
সমাজকর্মী শাশ্বতী ঘোষ আবার অন্য একটি দিক থেকে বিষয়টিকে বিচার করছেন, “শুধু না-পাওয়ার অতৃপ্তি নয়, আমার চোখ যা দেখতে অভ্যস্ত নয় তাকে কোনও ভাবেই সহ্য না করার মন তৈরি হয়েছে মানুষের। শরীর-শরীর করে এমনিতেই আমরা কাঁটা হয়ে থাকি। তারই বিস্ফোরণ হয়েছে এখানে।” ঠিক এই মনোভাবেরই সমালোচনা করেছেন অভিনেত্রী পাওলি দাম। তিনি বলেছেন, “আমি কী আচরণ করব, বা কী ভাবে চলব তা ঠিক করার অধিকার অন্যের নয়। তার খারাপ লাগলে সে অন্য দিকে চলে যাবে, খুব বেশি হলে মুখে বলতে পারে। গায়ে হাত দেওয়ার প্রশ্নই আসে না।” অভিনেতা রুদ্রনীল মনে করেন, বাৎসায়নের কামসূত্র এ দেশেই তৈরি হয়েছে, অথচ এ দেশের ঢাকঢাক-গুড়গুড় রয়েছে। হয়তো অবদমিত যৌনতা থেকেই এসব পদক্ষেপ কিছু মানুষের, বলছেন তিনি।
আর সমাজতত্ত্ববিদ প্রদীপ বসুর সিদ্ধান্ত, জনসমক্ষে একটি ছেলে এবং একটি মেয়ের ঘনিষ্ঠতা কোনও অন্যায় নয়। এখনকার সময়ে এটা কোনও অস্বাভাবিক দৃশ্যও নয়। মানুষের মধ্যে একটা স্বাভাবিক স্বাধীনতা থাকা উচিত। তবে বুদ্ধিমান ছেলে-মেয়েদের এ বিষয়ে সচেতনও থাকা উচিত বলে মনে করছেন তিনি।