মঞ্চের ক্যানভাসে চিরস্থায়ী খালেদ

বাড়ি থেকে পালিয়েছে সে বহু বার। হাতে গুনে শেষ করা যাবে না। মা মারা গিয়েছিলেন ন’বছর বয়সে। বাবার ব্যবহারে অতিষ্ঠ হয়ে সতেরো বছর বয়সে সেই যে শেষ বারের মতো পালাল ছেলেটি, আর করিমগঞ্জের বাড়িতে ফেরেনি। এর বহু বছর পর পঞ্চাশের দশকের মধ্য ভাগে ঋত্বিক ঘটকের ‘বাড়ি থেকে পালিয়ে’ ছবির টাইটেল-সহ পোস্টার, হোর্ডিং যখন সে তৈরি করবে, তখন সেখানে ধরা পড়বে ফেলে আসা সেই পালানোর অভিজ্ঞতা। অবিভক্ত অসমের করিমগঞ্জ থেকে সিলেট হয়ে কলকাতায় চলে আসাটা তার কাছে যেন এক পরিভ্রমণ।

Advertisement

উজ্জ্বল চক্রবর্তী

শেষ আপডেট: ২১ মে ২০১৪ ০০:০৫
Share:

বাড়ি থেকে পালিয়েছে সে বহু বার। হাতে গুনে শেষ করা যাবে না। মা মারা গিয়েছিলেন ন’বছর বয়সে। বাবার ব্যবহারে অতিষ্ঠ হয়ে সতেরো বছর বয়সে সেই যে শেষ বারের মতো পালাল ছেলেটি, আর করিমগঞ্জের বাড়িতে ফেরেনি। এর বহু বছর পর পঞ্চাশের দশকের মধ্য ভাগে ঋত্বিক ঘটকের ‘বাড়ি থেকে পালিয়ে’ ছবির টাইটেল-সহ পোস্টার, হোর্ডিং যখন সে তৈরি করবে, তখন সেখানে ধরা পড়বে ফেলে আসা সেই পালানোর অভিজ্ঞতা। অবিভক্ত অসমের করিমগঞ্জ থেকে সিলেট হয়ে কলকাতায় চলে আসাটা তার কাছে যেন এক পরিভ্রমণ। যে পরিভ্রমণ অচেনা এই শহরে এসেও থেমে যায়নি। বরং সেই যাত্রাপথে সে পেরিয়েছে আরও কঠিন সব মাইলস্টোন। যে সব তার নামের মতোই ‘চিরস্থায়ী’। চিরস্থায়ী মানে খালেদ।

Advertisement

খালেদ নাম তাঁর নিজের দেওয়া। বাড়ি থেকে পালিয়ে সিলেটে যে মুসলমান পরিবারে তিনি আশ্রয় পেয়েছিলেন, সেখানে থাকার সময়েই নাম পরিবর্তন। সম্পর্কে তিনি গুরুসদয় দত্তের নাতি হতেন। গুরুসদয় তাঁর নাম রেখেছিলেন চিরকুমার। কিন্তু অন্য ভাইদের সঙ্গে মিলিয়ে বাবা চন্দ্রনাথ দত্তচৌধুরী তাঁর নাম রাখলেন চিররঞ্জন। তাঁর মায়ের নাম হেমনলিনী। ১৯১৯ সালের ২০ ডিসেম্বর অসমের করিমগঞ্জের দাসগ্রামে মামাবাড়িতে জন্মেছিলেন তিনি। যদিও এই দু’টি নামের কোনওটিতেই তিনি বাঙালির কাছে পরিচিত নন। বাঙালি তাঁকে চেনে খালেদ নামে। খালেদ চৌধুরী।

ছোট থেকেই ছবি আঁকার পাশাপাশি গান ছিল খালেদের প্রাণ। কিন্তু শ্বাসকষ্টের কারণে গানটা আর তার প্রথাগত ভাবে শেখা হয়ে ওঠেনি। তবে শুনে শুনে শিখে নিয়েছিলেন ভাটিয়ালি থেকে ভাওয়াইয়া। সিলেটে চলে আসার পর ছোটবেলার ছবি আঁকাই হয়ে উঠবে তাঁর পেট চালানোর একমাত্র অবলম্বন। তবে একটু অন্য ভাবে। সাইনবোর্ড লিখে। মাঝে মাঝে চলবে ছবি আঁকাও। আঁকবে স্তালিন-এর ছবিও। যে ছবি তাঁকে জড়িয়ে ফেলবে কমিউনিস্ট পার্টির কাজকর্মের সঙ্গে। ছোটবেলার না গাইতে পারা গান মঞ্চে গাইবেও সে। তখন তার সহশিল্পীরা হবেন হেমাঙ্গ বিশ্বাস, নির্মলেন্দু চৌধুরী। আইপিটিএ নামকরণ তখনও হয়নি। খালেদ যুক্ত হলেন ‘কমিউনিস্ট পার্টি কালচারাল স্কোয়াড’-এ।

Advertisement

আর্ট কলেজে ভর্তি হবেন বলে সিলেট থেকে শিলং হয়ে কলকাতায় চলে এলেন খালেদ। হাতে পয়সাকড়ি বলতে মাত্র ৬৪ টাকা। কিন্তু গভর্নমেন্ট আর্ট কলেজের প্রিন্সিপাল জয়নুল আবেদিন তাঁর আঁকা ছবি খুঁটিয়ে দেখে বললেন, “তোমার আর্ট স্কুলে ভর্তি হওয়ার দরকার নেই।” এই মন্তব্য যে প্রশংসাসূচক তা বুঝতে সময় লেগেছিল যুবক খালেদের। কিন্তু মাঝেমাঝেই তিনি যেতেন জয়নুলের বাড়ি। শিখতেন নিজের মতো করে। সে শেখাও বেশি দিন এগোবে না। কারণ কিছু দিনের মধ্যেই শহরে দাঙ্গা বাধবে। আর জয়নুলকে চলে যেতে হবে পূর্ব পাকিস্তানে। খালেদও এই সময় গোয়াবাগানের আস্তানা ছেড়ে চলে এলেন পার্ক সার্কাসে। এখানকার আস্তানাতেই পরিচয় মহম্মদ ইসরাইল এবং কলিম শরাফির সঙ্গে। এই ইস্রাইলকেই পরে ‘বহুরূপী’তে অভিনয় করতে দেখা যাবে। এই সময়েই খালেদ তাঁর জীবনের প্রথম প্রচ্ছদচিত্রটি এঁকেছিলেন। পারিশ্রমিক পেয়েছিলেন ১০ টাকা। তবে প্রথম বইয়ের প্রচ্ছদ বলতে তিনি ‘সোভিয়েত বিজ্ঞান’-এর কথাই বলতেন। এর পর খালেদ তাঁর গোটা জীবনে আঁকবেন ১৫ হাজারেরও বেশি প্রচ্ছদচিত্র।

খালেদ তখন মেহের আলি রোডের আস্তানায় থাকেন। শম্ভু মিত্র প্রায়ই তাঁর কাছে মিউজিক শুনতে আসতেন। আইপিটিএ-র সময় থেকেই দু’জনের পরিচয়। খালেদও যেতেন শম্ভু মিত্রের নাসিরুদ্দিন রোডের বাড়িতে। এর পর এক দিন ‘ছেঁড়া তার’ এবং ‘চার অধ্যায়’ নাটক দু’টি নিয়ে একটি ফেস্টিভ্যাল করার কথা জানালেন শম্ভু মিত্র। খালেদকে তার পোস্টারও এঁকে দিতে বললেন। খালেদ এঁকে দিলেন।

আলোকশিল্পী তাপস সেনের সঙ্গে খালেদ চৌধুরী।

তত দিনে যদিও দু’জনে আইপিটিএ ছেড়ে দিয়েছেন। এর কিছু দিন পর এল মোক্ষম আর এক প্রস্তাব, ‘রক্তকরবী’। রবীন্দ্রনাথের এই নাটক শম্ভুবাবু করতে চান শুনে খালেদের মনে সম্ভাবনার এক ছবি ফুটে ওঠে। কেননা এর আগে রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী দেবব্রত বিশ্বাসের উদ্যোগে ‘মহিলা আত্মরক্ষা সমিতি’র ব্যানারে ‘রক্তকরবী’র মঞ্চ নির্মাণ করেছিলেন খালেদ। কাজেই নাটকে জড়িয়ে পড়লেন খালেদ। আর বাংলা নাট্যমঞ্চ পেল তার সর্বকালের সেরা মঞ্চ নির্দেশককে। সেটা ১৯৫৪ সালের ১০ মে। রেলওয়ে ম্যানসন ইনস্টিটিউট-এ বহুরূপী-র প্রযোজনা, শম্ভু মিত্রের পরিচালনায় মঞ্চস্থ হয় ‘রক্তকরবী’। মঞ্চচিত্রণ এবং আবহসঙ্গীতে খালেদ চৌধুরী।

খালেদ চৌধুরীকে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। এর পর থেকে প্রায় ১০৬টি নাটকে কাজ করেছেন তিনি। পাশাপাশি বেশ কিছু নাটকে আবহসঙ্গীত এবং পোশাক পরিকল্পনার কাজও করেছেন। উল্লেখযোগ্য নাটকগুলি হল ‘ডাকঘর’, ‘পুতুল খেলা’, ‘পাগলা ঘোড়া’, ‘এবং ইন্দ্রজিৎ’, ‘কালের যাত্রা’। ২০০৪ সালে ‘রঙ্গকর্মী’র ‘বদনাম মান্টো’ নাটকে মঞ্চ নির্দেশনার অর্ধশতাব্দী পূরণ হয় তাঁর।

খালেদ চৌধুরীকে নান্দীকার সম্মান জানাচ্ছেন রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত।

নাট্যব্যক্তিত্ব হিসাবে তাঁকে নানা সম্মান জানানো হয়েছে। পেয়েছেন সঙ্গীত নাটক আকাদেমির রত্নসদস্য, নান্দীকার সম্মান, পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য আকাদেমি পুরস্কার, ফেলো অফ সঙ্গীত নাটক আকাদেমি প্রভৃতি। হেমাঙ্গ বিশ্বাস, রণজিৎ সিংহ এবং আরও কয়েক জনকে নিয়ে খালেদ গড়ে তোলেন ‘ফোক মিউজিক অ্যান্ড ফোক লোর রিসার্চ ইনস্টিটিউট’। ২০০২ সালে মধ্যপ্রদেশ সরকার খালেদ চৌধুরীকে কালিদাস সম্মান দেয়। ২০১২ সালে ভারত সরকার দেয় পদ্মভূষণ। এর মাঝে তিনি রবীন্দ্রভারতী এবং বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ডি-লিট পেয়েছেন।

গায়ক, সুরকার, রাজনৈতিক কর্মী, অভিনেতা, নাট্য ও শিল্প নির্দেশক, প্রাবন্ধিক, প্রচ্ছদশিল্পী, নাট্যকর্মী খালেদ চৌধুরী গত ৩০ এপ্রিল ২০১৪ প্রয়াত হলেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৯৫। দীর্ঘ দিন ধরে কিডনির অসুখে ভুগছিলেন তিনি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন