তিনি ‘বিরূপাক্ষ’। আবার তিনিই বেতারের সেই প্রবাদপুরুষ, গত আট দশকেরও বেশি সময় ধরে যাঁর কণ্ঠের স্তোত্রপাঠ দিয়েই মহালয়ার উষা লগ্নে শুরু হয় বাঙালির দেবীপক্ষ। তিনি বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র।
‘মহিষাসুরমর্দিনী’ প্রথম প্রচারিত হয় ১৯৩২ সালে ষষ্ঠীর দিন। তবে তার আগের বছর ১৯৩১ সালে, বাণীকুমার (বৈদ্যনাথ ভট্টাচার্য) ‘শ্রীশ্রী চণ্ডী’-র বিষয়বস্তু নিয়ে বসন্তেশ্বরী নামক একটি কাব্য রচনা করেছিলেন। সে বছরই চৈত্র মাসে বাসন্তী পুজোর সময়ে ‘বসন্তেশ্বরী’ প্রচারিত হয়। তাতে সুর দিয়েছিলেন পণ্ডিত হরিশচন্দ্র বালী। তাতে ছিলেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ও বাণীকুমারও। আর সঙ্গীত পরিচালনায় ছিলেন রাইচাঁদ বড়াল। এমনই এক সময় সকলে মিলে ঠিক করলেন দুর্গাপুজোর ষষ্ঠীর সকালে এমন একটা অনুষ্ঠান করলে কেমন হয়? সেই শুরু। ১৯৩২ সালে প্রথম প্রচারিত হয় ‘মহিষাসুরমর্দিনী’। বাণীকুমার এই রচনায় সহায়তা পেয়েছিলেন পণ্ডিত অশোকনাথ শাস্ত্রীর। কয়েকটি গানে সুর দিয়েছিলেন পণ্ডিত হরিশচন্দ্র বালী ও রাইচাঁদ বড়াল। তবে বেশির ভাগ গানে সুর দিয়েছিলেন পঙ্কজকুমার মল্লিক।
শোনা যায় অনুষ্ঠানের আগের দিন রাত্রে স্টুডিওতেই থাকতেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র। অন্য শিল্পীদের রাত দু’টো নাগাদ স্টুডিওয় নিয়ে আসা হত। বীরেন্দ্রকৃষ্ণ স্টুডিওতেই স্নান সেরে গরদের ধুতি ও চাদর পরতেন। অনুষ্ঠানের শুরুতে শাঁখ বেজে উঠত। শুরু হত লাইভ প্রোগ্রাম। প্রথম দিকে কয়েক বছর রাইচাঁদ বড়াল ও পঙ্কজকুমার মল্লিক যুগ্ম সঙ্গীত পরিচালনায় ছিলেন। তবে পরবর্তী কালে এই অনুষ্ঠানে এসেছিল বেশ কিছু পরিবর্তন। বদলেছিল শিল্পীর তালিকাও। শুধু বদলায়নি গ্রন্থণা ও শ্লোক আবৃত্তির সেই শিল্পী।
১৯০৫ সালের ৪ অগস্ট বীরেন্দ্রকৃষ্ণের জন্ম আহিরীটোলায়। বাবা রায়বাহাদুর কালীকৃষ্ণ, মা সরলাবালা দেবী। ছোটবেলাতেই চলে আসেন শ্যামবাজারের রামধন মিত্র লেনের বাড়িতে। সেখানে আমৃত্যু তাঁর কেটেছে। ছোটবেলায় বাড়ির কাছেই তেলিপাড়া লেনে রাজেন্দ্রনাথ দে নামক এক আদর্শবান শিক্ষক গড়ে তুলে ছিলেন একটি স্কুল। তাঁর স্নেহ ছায়াতেই বেড়ে ওঠেন বীরেন্দ্র। শোনা যায় মাস্টারমশায়ের বাড়ির দুর্গাপুজোয় মাত্র আট-ন বছর বয়সেই বীরেন্দ্র চণ্ডী পাঠ করতেন। এমনকী, স্কুলের সরস্বতী পুজোয় তিনি জোরে জোরে মন্ত্রপাঠও করতেন। বীরেন্দ্রকৃষ্ণের ডাক নাম ছিল ‘বুশি’।
এক বার এই মাস্টারমশাই এক আবৃত্তি প্রতিযোগিতায় ‘বুশির’ নাম দিয়ে এলেন। তাতে মাইকেল মধুসূদনের ‘বীরাঙ্গনা কাব্য’ আবৃত্তি করতে হবে। বীরেন্দ্রকৃষ্ণের স্মৃতিশক্তি ছিল প্রখর। মাত্র কয়েক দিনেই মুখস্থ করে ফেললেন। সেই সঙ্গে প্রতিযোগিতায় পেয়েছিলেন প্রথম পুরস্কার।
রাজেনবাবুর কাছে প্রাথমিক শিক্ষার পরে তিনি ভর্তি হয়েছিলেন টাউন স্কুলে। পরবর্তী কালে স্কটিশচার্চ কলেজে ভর্তি হলেও বিএ পাশ করেছিলেন বিদ্যাসাগর কলেজ থেকে। ১৯২৮ সালে বীরেন্দ্রকৃষ্ণের বিবাহ হয় রায়বাহাদূর আশু বসুর পৌত্রী ও ফণি বসুর কন্যা রমা দেবীর সঙ্গে। তাঁর প্রথম চাকরি জীবন শুরু হয় ইস্টার্ন রেলের ফেয়ারলি প্লেসের অফিসে। কিন্তু সেই অফিসের অ্যাকাউন্টস বিভাগের ছোট সাহেব এক বাঙালি কেরানিকে মারধর করলে প্রতিবাদ করে সেই সাহেবকে পিটিয়ে তিনি চাকরি ছেড়ে দেন।
পঙ্কজকুমার মল্লিক, সুরেশচন্দ্র চক্রবর্তী প্রমুখের সঙ্গে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ।*
ইতিমধ্যে ১৯২৭ সালে ডালহৌসির গাস্টির্ন প্লেসে বোম্বাই-এর ইন্ডিয়ান ব্রডকাস্টিং কোম্পানি একটি বেতারকেন্দ্র স্থাপন করে। নৃপেন্দ্রনাথ মজুমদার রেডিওতে নিয়ে এলেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণকে। শুরু হল এক নতুন অধ্যায়। তাঁকে ভার দেওয়া হল সাহিত্য, নাটক, মহিলা মজলিশ ইত্যাদি অনুষ্ঠানের। তবে ১৯৪৩ সালে একটি বিশেষ কারণে শুধু সম্মানের প্রশ্নে তিনি চাকরি ছেড়ে দেন। কিন্তু বেতার তাঁকে ছাড়েনি। তৎকালীন স্টেশন অধিকর্তা জানতেন, বীরেন্দ্রকৃষ্ণ সেই সময় জনপ্রিয়তম শিল্পী। নির্দিষ্ট কালের জন্য তিনি সসম্মানে রয়ে গেলেন চুক্তির ভিত্তিতে উচ্চ বেতনে।
সেই ১৯৪৩ থেকে যত দিন পর্যন্ত তিনি ছিলেন, বেতারকে উপহার দিয়েছেন অসংখ্য স্মরণীয় নাটক। তাঁর মধ্যে উল্লেখযোগ্য গৃহপ্রবেশ, ‘সাজাহান’, ‘প্রফুল্ল’, ‘সীতারাম’ উল্লেখযোগ্য। অনেকেই মনে করেন তাঁর অন্যতম শ্রেষ্ঠ প্রযোজনা ডি এল রায়ের নাটক ‘চন্দ্রগুপ্ত’। তাঁকে বলা হত রেডিও নাটকের জণক। তেমনই সে যুগের রঙ্গমঞ্চের প্রখ্যাত শিল্পীদের টেনে এনেছিলেন তিনি বেতারে। তাঁদের মধ্যে অন্যতম শিশিরকুমার ভাদুড়ী, অহীন্দ্র চৌধুরী, নরেশচন্দ্র মিত্র প্রমুখ। এ সবের পাশাপাশি বেতারে তিনি নানা ধরনের অনুষ্ঠান করেছেন।
বহু ক্ষেত্রেই বীরেন্দ্রকৃষ্ণ আর বেতার এই দুই যেন মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছে। ১৯৪১-এর ৭ অগস্ট। রবীন্দ্রনাথের স্বাস্থ্য ক্রমশই অবনতির পথে। তৎকালীন স্টেশন অধিকর্তার নির্দেশ— সকাল থেকে প্রতি পনেরো মিনিট অন্তর কবির খবর শ্রোতাদের জানাতে হবে। নলিনীকান্ত সরকার গেলেন জোড়াসাঁকোয়। প্রতি পনেরো মিনিট অন্তর টেলিফোনে তিনি জানাচ্ছিলেন কবির খবর। আর সেই খবরের উপর ভিত্তি করে দুপুর পর্যন্ত চলতে লাগল বীরেন্দ্রকৃষ্ণের ঘোষণা। রবীন্দ্রনাথ শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করার পরে বেতার কর্তৃপক্ষ ঠিক করেছিলেন শ্মশান থেকে শেষ যাত্রার ধারাবিবরণী সম্প্রচার করা হবে। সেই প্রথম কোনও বিশিষ্ট ব্যক্তির শেষ যাত্রার ধারাবিবরণী রেডিওতে সম্প্রচারিত হয়। আর সেই ধারাবিবরণীর বিবৃতি দিয়েছিলেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ। সে কাহিনি আজ ইতিহাস।
আশ্চর্যের কথা ছেলেবেলা থেকেই খেলাধুলোয় তাঁর আগ্রহ ছিল না। অথচ ১৯২৯ সালে তিনি প্রথম ফুটবল খেলার ধারাবিবরণী দেন রেডিওতে। আজও ফুটবল কিংবা ক্রিকেটের যে রিলে অনুষ্ঠান শোনা যায় তার পথিকৃত বীরেন্দ্রকৃষ্ণ। শুধু তাই নয় ‘বিরূপাক্ষ’ ছদ্মনামে তিনি বেতারে নিজের লেখা বেশ কিছু কৌতুক নকশা পরিবেশন করেছিলেন ‘রূপ ও রঙ্গ’ নামক আসরে যা অসম্ভব জনপ্রিয় হয়েছিল। ভাল গান গাইতে পারতেন এবং পিয়ানো বাজাতেন।
তবু শেষ জীবনে ডুবেছিলেন অভিমানে। সে যুগে বেতারের স্টাফ আর্টিস্টদের পেনশন ইত্যাদির ব্যবস্থা ছিল না। অবসরের সময়ে সামান্য কিছু টাকা পেয়েছিলেন। অথচ সে যুগে বেতার ও দূরদর্শনে এমেরিটাস প্রডিউসর পদটি ছিল। কিন্তু তৎকালীন বেতার মন্ত্রক তাঁকে এ পদের যোগ্য বিবেচনা করেনি। যাঁর হাত ধরে কলকাতার বেতার মাধ্যম পূর্ণতা পেয়েছিল, নেপথ্যে থাকা অন্যতম সেই স্থপতি পেয়েছিলেন বঞ্চনা। আশির দশকের প্রথম দিক থেকে ক্রমেই তাঁর স্মৃতিভ্রংশ হতে থাকে। ১৯৯১ সালের ৩ নভেম্বর ছিয়াশি বছর বয়সে তাঁর জীবনাবসান ঘটে।
আবারও আশ্বিনের শারদপ্রাতে যখন বেজে উঠবে ‘আলোক মঞ্জির’, বাঙালির অবচেতনে আলো-আঁধারির খেলায় ভেসে উঠবে বীরেন্দ্রকৃষ্ণের অদৃশ্য উপস্থিতি। তাঁর কণ্ঠস্বরের মধ্যে আজও বেঁচে আছে শারদোৎসবের সেই অনন্য আবেগ।
* চিহ্নিত ছবিগুলি তুলেছিলেন পরিমল গোস্বামী। হিমানীশ গোস্বামীর সৌজন্যে প্রাপ্ত।