বন্ধ হওয়ার আগে বিড়লা তারামণ্ডলে দর্শকদের ভিড়। রবিবার। ছবি: সুমন বল্লভ
প্রায় তিন দশক আগের কথা। এক কিশোরকে নিয়ে তার বাবা হাজির হয়েছিলেন বিড়লা তারামণ্ডলের আকাশ চেনার কোর্সে ভর্তি করতে। পরীক্ষায় ভাল ভাবে উতরোলেও বয়সের কারণে তাকে ভর্তি করা যাচ্ছিল না। শেষে উপায় বাতলালেন তৎকালীন অধিকর্তা। তাঁর চেষ্টাতেই খাতায়-কলমে ভর্তি না হয়েও ক্লাসে হাজির থাকত ছেলেটি।
বছর তিন আগে হায়দরাবাদে বসে ঘটনাটি শোনান বিড়লা তারামণ্ডলের সেই অধিকর্তা, মহাকাশ-পদার্থবিজ্ঞানী বি জি সিদ্ধার্থ। ছেলেটির নাম অমিতাভ ঘোষ। নাসার অন্যতম শীর্ষ বিজ্ঞানী!
সিদ্ধার্থ বা অমিতাভের মতো বিজ্ঞানীরাই শুধু নন, বিড়লা তারামণ্ডলের সঙ্গে শহরের বেশির ভাগ বাঙালিরই স্মৃতি জড়িয়ে রয়েছে। মাঝবয়সে পৌঁছেও কারও মনে অমলিন হয়ে রয়েছে ছোটবেলায় বাবার হাত ধরে তারামণ্ডলে যাওয়া, হিন্দিতে ধারাভাষ্য শুনে আকাশ চেনার কথা। ছুটির দিনে বাবা-মায়ের সঙ্গে তারামণ্ডলে হাজির হয়নি, এমন শিশু-কিশোর বছর কয়েক আগেও নেহাতই হাতেগোনা ছিল।
ইদানীং অবশ্য সেই উৎসাহে কিছুটা ভাটা পড়েছিল। অনেকেই বলছেন, তার অন্যতম কারণ ছিল তারামণ্ডলের আধুনিকীকরণ না হওয়া। সেকেলে প্রোজেক্টরে শো দেখার চেয়ে এখন ইন্টারনেট ঘাঁটতেই বেশি স্বচ্ছন্দ শিশু-কিশোরেরা। বিষয়টি কার্যত স্বীকার করে নিয়েছেন তারামণ্ডল কর্তৃপক্ষও। তাই পুরনো প্রোজেক্টর ছেড়ে এ বার হাল আমলের ডিজিটাল প্রোজেক্টর বসাতে চলেছেন তাঁরা। এই কাজের জন্য অবশ্য আগামিকাল, মঙ্গলবার থেকে ন’মাসের জন্য বন্ধ থাকবে শহরের অন্যতম এই দ্রষ্টব্য স্থান।
বিড়লা তারামণ্ডলের অধিকর্তা দেবীপ্রসাদ দুয়ারি বলছেন, এত দিন কার্ল জাইস সংস্থার তৈরি একটি ‘অপ্টো-মেকানিক্যাল’ প্রোজেক্টর দিয়ে শো করা হত। এ বার ওই সংস্থারই ৯টি ডিজিট্যাল প্রোজেক্টর বসানো হবে। তার ফলে বিশদ ও উন্নত ছবির পাশাপাশি হাবলের মতো টেলিস্কোপে ধরা পড়া মহাজাগতিক ঘটনার ছবিও দেখানো যাবে। “ডিজিটাল প্রযুক্তির উন্নতিকে হাতিয়ার করে এ বার তারামণ্ডলের ভিতরে একটা মায়াবি পরিবেশও তৈরি করা হবে,” বলছেন দেবীপ্রসাদবাবু।
আধুনিকীকরণের বিষয়টি শুনে উচ্ছ্বসিত জ্যোতির্বিজ্ঞানী এবং তারামণ্ডলের প্রাক্তন অধিকর্তা অমলেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়। কথায় কথায় তিনি বললেন, তাঁর পূর্বজদের কাছ থেকে শোনা এই তারামণ্ডল তৈরি হওয়ার ইতিহাস। কী রকম?
অমলেন্দুবাবু বললেন, বিড়লা গোষ্ঠীর মালিক মাধবপ্রসাদ বিড়লা জার্মানিতে গিয়ে এই প্রোজেক্টর কেনেন। জাহাজে সেই প্রোজেক্টর চলে আসে কলকাতায়। কিন্তু তারামণ্ডল তৈরির জমি না মেলায় প্রোজেক্টর পড়ে ছিল গুদামেই। এক সময়ে বিরক্ত হয়ে মাধবপ্রসাদ ঠিক করেন, দিল্লিতে তারামণ্ডল গড়বেন। সেখানেই বসবে তাঁর সাধের প্রোজেক্টর। কলকাতা ছেড়ে প্রোজেক্টর যখন দিল্লি পাড়ি দিতে যাচ্ছে, তখনই আসরে নামেন তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বিধানচন্দ্র রায়। এক দিন সকালে ওয়েলিংটন স্কোয়ারের বাড়িতে প্রাতরাশে ডাকেন মাধবপ্রসাদকে। তার পরেই তাঁকে সঙ্গী করে সোজা ভিক্টোরিয়ার সামনে। এক খণ্ড সরকারি জমি দেখিয়ে জিজ্ঞাসা করেন, এখানে তারামণ্ডল গড়া যায় কি না!
অমলেন্দুবাবুর কথায়, “বিধান রায়ের দেওয়া সেই জমিতেই তৈরি হয় দেশের প্রথম তারামণ্ডল। দর্শকাসনের নিরিখে যা পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম, মস্কোর পরেই।” একই কথা বলছেন কেন্দ্রীয় সরকারি সংস্থা পোজিশন্যাল অ্যাস্ট্রোনমি সেন্টারের অধিকর্তা সঞ্জীব সেন। ছোটবেলায় তিনিও গিয়েছিলেন বিড়লা তারামণ্ডলে। “তখন অবশ্য জানতাম না, বড় হয়ে এ বিষয়েই কাজ করব। তবে রাতের আকাশ দেখে দারুণ লেগেছিল,” বলছেন সঞ্জীববাবু।
তবে আধুনিকীকরণের কাজ করতেও কম বেগ পেতে হয়নি তারামণ্ডল কর্তৃপক্ষকে। কী রকম? দেবীপ্রসাদবাবু জানােচ্ছেন, নয়া প্রযুক্তির এই প্রোজেক্টর দিয়ে বিদেশে যুদ্ধবিমানের সিমুলেটরের কাজও করা যায়। তাই কার্ল জাইসের কাছ থেকে এই প্রোজেক্টর পেতে যথেষ্ট কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে।