হর্ষবর্ধন-গোবর্ধন চরিত্রের রূপকার আগে, পিছে আমি

নব্বই দশকের মাঝপথ, শাসনে বামফ্রন্ট। রবীন্দ্রসদনে বাংলা সঙ্গীতমেলার শুরুর সন্ধ্যায় সংবর্ধিত হবেন সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়, তাঁর হাতে পুরস্কার তুলে দেওয়ার কথা মান্না দে-র। তখন দায়িত্বে থাকা শিবাজীদা, উৎপলদা আমার কাছে সরকারি সাদা অ্যাম্বাসাডর পাঠিয়ে দিলেন। পেছনের সাদা তোয়ালে মোড়া আসনে একা মান্না দে, সামনে ড্রাইভারের পাশের সিটে গুটিগুটি এই অধম। রামদুলাল সরকার স্ট্রিটে গয়ে গিরিশ পার্কে ঢোকা মাত্রই গোটা সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউতে থিকথিকে যানজট।

Advertisement

অলক রায়চৌধুরী

শেষ আপডেট: ২১ ডিসেম্বর ২০১৫ ০০:০০
Share:

নব্বই দশকের মাঝপথ, শাসনে বামফ্রন্ট। রবীন্দ্রসদনে বাংলা সঙ্গীতমেলার শুরুর সন্ধ্যায় সংবর্ধিত হবেন সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়, তাঁর হাতে পুরস্কার তুলে দেওয়ার কথা মান্না দে-র। তখন দায়িত্বে থাকা শিবাজীদা, উৎপলদা আমার কাছে সরকারি সাদা অ্যাম্বাসাডর পাঠিয়ে দিলেন। পেছনের সাদা তোয়ালে মোড়া আসনে একা মান্না দে, সামনে ড্রাইভারের পাশের সিটে গুটিগুটি এই অধম। রামদুলাল সরকার স্ট্রিটে গয়ে গিরিশ পার্কে ঢোকা মাত্রই গোটা সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউতে থিকথিকে যানজট। পয়লা বৈশাখের ঘেমো বিকেল। আমাদের গাড়িও নড়ছে না। কানে আসছে শিল্পীর ইংরেজি-হিন্দি-বাংলা মেশানো চোখাচোখা সব মন্তব্যও। কাজেকাজেই পিছনে তাকাচ্ছি না। ঘণ্টাখানেকের চেষ্টায় এসপ্ল্যানেড ছাড়িয়ে গাড়ি রবীন্দ্রসদনের দিকে এগোতেই কর্তব্যরত পুলিশদাদা সেই যে ড্যাশ চিহ্নের মত হাতটি তুলে থাকলেন, সে আর নামছেই না। প্রবল উত্তেজিত মান্না দে এক সময় গাড়ির দরজা খুলে নেমেও পড়েন এবং সটান হাজির হন পুলিশ ভাইটির কাছে। সেই স্তব্ধবাক, মুগ্ধ দৃষ্টির প্রহরী মানুষটি মান্না দে-কে সামনাসামনি রাজপথে দেখে প্রণাম করতে উদ্যত, বলছেন ‘ভাল আছেন স্যার’? স্মৃতির পাতায় অমলিন এ ছবি দিতে পারে খালি আমার শহরই।

Advertisement

বাংলায় প্যারডি যিনি ‘সেলিকা’ নামে প্রথম বাজারে এনেছিলেন সেই সতীশ ঘটক মশাই ধনধান্য পুষ্পভরার আদলে রাইটার্স বিল্ডিং নিয়ে লিখছেন, ‘কেরানিদের শীর্ণদেহ/ কোথায় এমন পাবে কেহ/চাকরি মা তোর চরণদুটি নিত্য পুজো করি/আমার এই আপিসের কর্ম যেন বজায় রেখে মরি।’ তো আমি সে প্যারডির শেষ লাইনটি আরও পার্সোনালাইজড করে বলতে চাই, ‘আমার এই শহরে জন্ম যেন বজায় রেখে মরি। নিমতলার কাছে বাড়ি যাদের, তাদের এখন মরেও যে কত সুখ। মুখ্যমন্ত্রীর বদান্যতায় শ্মশানঘাটে সারি সারি ইলেকট্রিক চুল্লি। চড়লেই হল। নো ওয়েটিং। আর ওয়েটিং হলেও শ্মশানযাত্রীদের জন্য খুলে দেওয়া হয়েছে এসি এবং নন এসির গঙ্গাহাওয়ার আরাম ঘর। অতএব মৃত্যুসংবাদ পেয়ে যিনি রানাঘাট কালনা থেকে ছুটে এসে ইনিয়ে বিনয়ে কান্না যন্ত্রে শান দেবেন বলে পিটি করছেন তাঁর চান্স খুব কম। ততক্ষণে অপার্থিব শরীরটি ভ্যানিশ হয়ে যাওয়ার কথা।

পার্থিব সুখই বা কম কী দিল আমার শহর? এক আর পাঁচ নম্বর ট্রামে চড়ে প্রায় নিখরচায় চলমান প্রেমের অভিজ্ঞতা আমার মতো অনেকেরই আছে নিশ্চিত। কন্ডাক্টর ভাইকে ধরো, ‘দাদা টিকিট লাগবে না।’ ব্যাস, কেউ বিরক্ত করার নেই। পাশেই ঢনঢনিয়া পার হয়ে যাচ্ছে ট্রাম। ঠনঠনিয়া। বউবাজার, ধর্মতলা ছেড়ে ট্রাম ঢুকছে ময়দানের গুমটিতে। ফের ঘুরে সে ট্রাম যাবে বেলগাছিয়া বা শ্যামবাজার। এই ঘণ্টাদেড়েকের প্রেমযাত্রায় ‘দুজনে মুখোমুখি/দোহার দুখে দুখী’—দুঃখ আসলে পকেটে পয়সা না থাকার।

Advertisement

সে বেড়ে ওঠায় অবশ্য অনেক বিধি ও বাধা ছিল। সন্ধ্যা ছটার পরে বাড়ির বাইরে থাকার পারমিশন নেই পড়ুয়া ছেলেদের। দক্ষিণীতে গান শেখার সুবাদে অবশ্য সপ্তাহে দু’দিন দেশপ্রিয় পার্কে যাওয়ার অনুমতি মিলেছে। এবং সেই সূত্রেই একদিন আকাশবাণী তো পরের দিন রবীন্দ্রসদনের সিংহদুয়ার খুলে যাচ্ছে। ঋতু গুহ, রনো গুহঠাকুরদের তাদের কাছ থেকে দেখতে দেখতে তাঁদেরই উপস্থিতিতে কোরাসে গলা মেলানো। সে কালে সেই অনির্বচনীয় পাওয়া আজকের যাবতীয় অনায়াস প্রাপ্তির ধারে কাছে আসে না। এ ভাবেই একদিন রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ছাত্রটি হয়ে পড়ল ঘোরতর সঙ্গীতমুখী। বাবার মৃত্যুর পরে গান থেকে ফেরার উপায়ও ছিল না। কেননা প্রয়োজনের তুলনায় অত্যল্প হলেও গানই তখন সংসারে ডালভাতের ব্যবস্থা করছে। এরই মাঝে একদিন চিত্রলেখা চৌধুরী এবং আর একদিন রাজেশ্বর ভট্টাচার্যের কৃপায় শিশির মঞ্চে গাওয়ার সুযোগ পাওয়া এবং দেবাশিস দাশগুপ্ত দেশ পত্রিকায় ছবি ছাপিয়ে দু’চার লাইন প্রশস্তিও লিখলেন সে অনুষ্ঠানের। গরবে পা পড়ে না। আজ অবশ্য কত তাড়াতাড়ি, কত অল্প বিনিময়ে টিভির পর্দায় মুখ দেখানো য়ায়, তার বিজ্ঞাপনেরই ছড়াছড়ি। শহর তারও সাক্ষী। আমার সেই শহরের একদম অদেখা জগৎ হল জেলখানা, আজকের ভাল বাংলায় যা সংশোধনাগার। আলিপুরের সেই সংশোধনাগারে মাত্রই ক’বছর আগে হাতে ধরে নিয়ে গেলেন অলকানন্দা রায়। মোবাইল, ম্যানিব্যাগ, সাইড ব্যাগ সব জমা রেখে জেলবন্দিদের ডেরায় ঢোকা। উদ্দেশ্য তাঁদের ‘বাল্মিকী প্রতিভা’-র গান শেখানো। আজকের অভিনেতা নাইজেল-সহ সব বিচারাধীনের সঙ্গেই ওঁদের মাতৃসমা মুন্নিদি বা অলকানন্দা রায় গানের মাস্টারের পরিচয় ঘটালেন। ইচ্ছুক, অনিচ্ছুক মানুষগুলির সঙ্গে গানের ফাঁকে ফাঁকে কয়েক মাসের নানা আলাপচারিতায় কত মর্মন্তুদ ঘটনার স্মৃতি উঠে এল!

অভিজ্ঞতার রকমফের আছে। যেমন শিব্রাম চক্রবর্তীর সঙ্গে বউবাজারের রাস্তায় দাঁড়িয়ে দই খাওয়া। স্টুডেন্টস হলে গান শুনে শিব্রাম বা শিবরাম বললেন, ভাইজ তোমায় এখনই নিতে হবে বাপু। মন্ত্রমুগ্ধের মতো ট্রামলাইন ধরে ওর সঙ্গে পিছু হাঁটছি বউবাজারের দিকে। নবকৃষ্ণ গুঁই থেকে দু’ভাঁড় একশো গ্রামের দই কেনা হল। ওপরে মিহি সাদা কাগজ। হর্ষবর্ধন-গোবর্ধন চরিত্রের রূপকার বললেন বিধাতা পুরুষ দই খাওয়ার নিয়মটিও নাকি স্বপ্নে বাতলে গিয়েছেন ওঁকে। উনি যা করবেন, আমাকেও তেমনই করতে বলা হল। ভাঁড় হাতে ফুটপাথে নামতেই অল্প হাওয়ায় ভাঁড়ের কাগজ গেল সরে এবং পড়ে। হাঁটতে হাঁটতে জিভ দিয়ে একটু একটু করে তার স্বাদ নেওয়া। সামনে সাহিত্যসেবী, পিছনে এই পুরস্কার প্রার্থী। খাচ্ছি দই, যেমন বলছেন, তেমনই সই। শহর সাক্ষী। আর ওই ট্রামলাইন ধরে উত্তরের দিকে এলে আমার স্কুল স্কটিশ চার্চ। এই সেদিনও প্রখ্যাত বিজ্ঞানী বিকাশ সিংহ জানিয়েছেন যে, স্কটিশ স্কুলের শহবত আজীবন ভাঙিয়ে খেয়েছেন তিনি, অন্য কিছুর প্রয়োজন লাগেনি। আমাদেরও তাই। মনে পড়ে স্কুলের দেড়শো বছরের অনুষ্ঠানের ডোনেশান জোগার, এক ডাকসাইটে প্রাক্তনীর অফিসে গিয়েছি। রাশভারী, কথা কম বলেন,। ফুড প্যাকেট মোট কত লাগতে পারে জিজ্ঞেস করে একটি পার্সোনাল চেক –এ সই করে দিলেন। আমরা কজন দু’পাঁচ হাজারের হিসেব কষছি, ভদ্রলোক হাতজোড় করে বললেন, ওরে ভাই খুব ব্যস্ত রে, বেরোতে হবে। স্কুলে গিয়ে বসিয়ে নিস। দেখি চেক-এ টাকার অঙ্ক লেখা নেই। ভদ্রলোক চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়ে বলছেন, স্কটিশের ছেলেরা ছোট কাজ করতে পারে না—এ বিশ্বাস আছে। এই বিশ্বাসের ভিত গড়ল তো আমার শহরের স্কুলই।

বাবার মৃত্যুর পরে সীমাহীন দারিদ্রে যখন এ ধার ও ধার নিজের গান শুনিয়ে টিউশন বা ফাংশনের প্রত্যাশী, তখন কী অপরূপ এবং অপার্থিব মমতায় বাণী ঠাকুর রবিবারের বিকেলে গানের শিক্ষক হিসেবে ডেকে নিলেন কিংশুক-এ। হাতে গোনা ছাত্রছাত্রী কিন্তু মাসান্তে খামে ভরা মোটা টাকা। ভেতরে বসে তাস খেলছেন বিকাশ রায়, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, সুমিতা সান্যাল, বিমান ঘোষেরা। এত সব তারকা দেখে আমার বদহজমের অবস্থা। ক্লাসের সময় আসে, বেল বাজে। আর বাণীদি স্বয়ং দরজা খুলে অভিভাবকদের বলছেন, আজও শুনতে পাচ্ছি, স্যারের শরীর খারাপ। আসে নি রে—পরের সপ্তায় আয়। ছাত্রছাত্রীরা চলে গেল, বাণীদিকে ‘কেন’ বলতেই জবাব, ‘ধুস, রোজ ক্লাস করবি নাকি? একদিন তোর শরীর বিগড়োতে নেই, যা, হেমন্তদাকে একটু পটা।’ পটাব কী, বাইরে এক অভিভাবকের গলা পাচ্ছি, ‘স্যারের দশ নম্বর চটি বাইরে, উনি আসেননি?’ এমন বোকা বনে যাওয়া লজ্জা কোনও দিন পাইনি যে!

এখন শহরের গানের প্রতিনিধি হয়ে দু’ পাঁচজনের বেশি বাইরে থাকলেই টুকলি করেই বলি, বাসায় ফেরার ডানার শব্দ যেন হৃদমাঝারেও পাই। দ্বিজেন্দ্রলাল যথার্থই বলেছেন, ‘হেথা বাতাস গীতিগন্ধভরা চিরস্নিগ্ধ মধুমাসে/হেথা চির শ্যামল বসুন্ধরা চির জ্যোৎস্না নীলাকাশে’। তাই এ শহরে দিব্যি আছি।

লেখক: সঙ্গীতশিল্পী

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন