এ বারেও ‘অচ্ছুত’ সীসামুক্ত রং

দশ বছরেও কুমোরটুলির বন্ধু হতে পারল না পরিবেশবান্ধব রং। প্রতিমা শিল্পীরা যাতে সীসামুক্ত রং ব্যবহার করেন, তাই ঘটা করে সরকারি উদ্যোগ শুরু হয়েছে বছর দশেক। ২০১২ থেকে পুজোর মাসখানেক আগে শিল্পীদের পরিবেশ ভবনে ডেকে ওই রং দেওয়ার ব্যবস্থাও করেছে পরিবেশ দফতর।

Advertisement

মেহবুব কাদের চৌধুরী

শেষ আপডেট: ১৬ সেপ্টেম্বর ২০১৫ ০১:০০
Share:

মূর্তিতে সীসামুক্ত রঙের পোঁচ পরিবেশ মন্ত্রী সুদর্শন ঘোষদস্তিদারের। মঙ্গলবার, পরিবেশ ভবনে। ছবি: শৌভিক দে।

দশ বছরেও কুমোরটুলির বন্ধু হতে পারল না পরিবেশবান্ধব রং।

Advertisement

প্রতিমা শিল্পীরা যাতে সীসামুক্ত রং ব্যবহার করেন, তাই ঘটা করে সরকারি উদ্যোগ শুরু হয়েছে বছর দশেক। ২০১২ থেকে পুজোর মাসখানেক আগে শিল্পীদের পরিবেশ ভবনে ডেকে ওই রং দেওয়ার ব্যবস্থাও করেছে পরিবেশ দফতর। তবুও ওই রং ব্যবহারে সাড়া দেননি বেশির ভাগ শিল্পীই। এ বছর পুজোর আগে মঙ্গলবার পরিবেশ ভবনের অনুষ্ঠানেও সেই ছবিই বহাল রইল। পটুয়াপাড়ায় দেখা গিয়েছে, কোনও শিল্পীর স্টুডিওয় অব্যবহৃতই পড়ে রয়েছে সেই রং, কেউ বা স্রেফ সিংহাসন, কাঠামোতেই তা ব্যবহার করছেন। কিন্তু প্রতিমায় সেই রং ভুল করেও ঠেকাচ্ছেন না কেউ।

রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের চেয়ারম্যান কল্যাণ রুদ্র বলেন, ‘‘কলকাতা ছাড়াও কৃষ্ণনগর, হলদিয়া, দুর্গাপুর ও শিলিগুড়িতেও দেওয়া হবে এই রং।’’ পরিবেশমন্ত্রী সুদর্শন ঘোষদস্তিদার অবশ্য বলেছেন, ‘‘সব কিছুরই সময় দরকার। রাতারাতি তো বদল হবে না। এক দিন ঠিক সীসামুক্ত রং ব্যবহার করবেন শিল্পীরা।’’

Advertisement

পরিবেশমন্ত্রী আশাবাদী হলেও এ বছরও সীসামুক্ত রং ব্যবহারের বিপক্ষেই শিল্পীরা। এ দিন কুমোরটুলি মৃৎশিল্পী সমিতির সম্পাদক মন্টু পাল বলেন, ‘‘আধ ঘণ্টার অনুষ্ঠানে পরিবেশমন্ত্রী ও দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের চেয়ারম্যান ওই রঙের উপকারিতা নিয়ে বললেন। আমাদের কিছু বলতে দেওয়া হল না।’’ শিল্পীরা জানাচ্ছেন, সীসামুক্ত রঙের দাম সাধারণ রঙের তুলনায় পাঁচ গুণ বেশি। তা ব্যবহার করলে প্রতিমায় ঔজ্জ্বল্যও আসে না। তাই ওই রং সহজলভ্য করার পাশাপাশি একে ব্যবহারের উপযোগী করে তুলতে হবে বলেও মত তাঁদের। কুমোরটুলির মৃৎশিল্পীদের তিনটি সংগঠনের প্রতিনিধিরা আরও জানান, পুজোর আগে স্রেফ একটি অনুষ্ঠান করলে কাজ হয় না। সীসামুক্ত রং চালুর আগে সরকারি তরফে শিল্পীদের নিয়ে কর্মশালা করা জরুরি। বাড়াতে হবে প্রচারও।

রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ ও ইন্ডিয়ান টক্সিকোলজি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের যৌথ সমীক্ষার রিপোর্ট অনুযায়ী, কুমোরটুলির শিল্পীদের ব্যবহৃত রঙে প্রতি গ্রামে ৬-১০ মাইক্রোগ্রাম সীসা থাকে। দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ সূত্রে খবর, ওই রঙে বহু ভারী ধাতু (পারদ, ক্যাডমিয়াম, জিঙ্ক অক্সাইড, ক্রোমিয়াম ইত্যাদি) থাকলেও সর্বাধিক ক্ষতি করে সীসা। বিসর্জনের সময়ে সীসা নদীর জলে মিশে বাস্তুতন্ত্র নষ্ট করে। গঙ্গা দূষণ রোধে তাই পরিবেশবান্ধব রং ব্যবহার চালু করতে উদ্যোগী হয় পরিবেশ দফতর ও দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ।

সমস্যাটা ঠিক কোথায়?

শিল্পী সনাতন দিন্দা বলেন, ‘‘সীসামুক্ত রঙের দাম এত বেশি যে মৃৎশিল্পীদের কাছে তা গ্রহণযোগ্য নয়। এর প্রয়োগও শক্ত।’’ শিল্পী ভবতোষ সুতারের কথায়, ‘‘এক বার প্রতিমায় সীসামুক্ত রং লাগিয়ে দেখেছিলাম উজ্জ্বল ভাব ফুটছে না। তাই আর ব্যবহার করি না।’’ কুমোরটুলি প্রগতিশীল মৃৎশিল্প ও সাজশিল্প সমিতির সম্পাদক অপূর্ব পালও বলেন, ‘‘সরকার শিল্পী পিছু ২-৩ লিটার করে রং দেয়। এত কমে কাজ হয় না। বাড়তি রং কেনাও ব্যয়সাপেক্ষ।’’

শিল্পী অনির্বাণ দাসের মতে, দাম কমানোর পাশাপাশি সীসামুক্ত রংকে ব্যবহারের উপযোগী করে তুলতে পারলে তবেই শিল্পীদের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে। শিল্পীদের অভিযোগ, তাঁদের হাতে রং তুলে দিয়েই দায় সারছে সরকার। রঙের দাম কমানো বা ঔজ্জ্বল্য বজায় রেখেই তাকে সীসামুক্ত করতে প্রয়োজনীয় গবেষণার বিষয়ে এত বছরে কোনও উদ্যোগ দেখা যায়নি। কুমোরটুলি মৃৎশিল্প সাংস্কৃতিক সমিতির তরফে বাবু পাল বলেন, ‘‘সীসামুক্ত রং ব্যবহারের আগে সরকারের ভাল ভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা দরকার ছিল। শিল্পীদের কাজে না লাগলে তা বাজারে এনে লাভ কী?’’

পরিবেশকর্মী সুভাষ দত্তও জানান, ভাল ভাবে পরীক্ষা করেই শিল্পীদের সীসামুক্ত রং দেওয়া উচিত। প্রতিমার সৌন্দর্য না ফুটে উঠলে শিল্পীরা বর্জন করবেনই। এ নিয়ে পরিবেশ দফতরকে উদ্যোগী হতে হবে বলে তাঁর মত। দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের চেয়ারম্যান কল্যাণ রুদ্রের আবার পাল্টা প্রশ্ন, শিল্পীরা সীসামুক্ত রং ব্যবহারই না করলে নিচ্ছেন কেন?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন