কুণাল-গর্জন রুখতে কোর্ট চত্বরেই দমদম দাওয়াই

কখনও দলবদ্ধ ‘হা-রে-রে-রে’ চিৎকার। কখনও বা পুলিশের গাড়িতে চাপড় মেরে ‘ধাঁই ধপাধপ’ শব্দ। সারদা কেলেঙ্কারিতে অন্যতম অভিযুক্ত, জেলবন্দি কুণাল ঘোষের কথা যাতে সংবাদমাধ্যমের কানে না-পৌঁছয়, সেই জন্য এমন বিচিত্র সব আয়োজন করে থাকেন কলকাতা পুলিশের কর্তারা।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

কলকাতা শেষ আপডেট: ০১ জুলাই ২০১৫ ০৩:৪২
Share:

সল্টলেক আদালতের বাইরে কুণাল ঘোষ। মঙ্গলবার। ছবি: শৌভিক দে

কখনও দলবদ্ধ ‘হা-রে-রে-রে’ চিৎকার। কখনও বা পুলিশের গাড়িতে চাপড় মেরে ‘ধাঁই ধপাধপ’ শব্দ। সারদা কেলেঙ্কারিতে অন্যতম অভিযুক্ত, জেলবন্দি কুণাল ঘোষের কথা যাতে সংবাদমাধ্যমের কানে না-পৌঁছয়, সেই জন্য এমন বিচিত্র সব আয়োজন করে থাকেন কলকাতা পুলিশের কর্তারা। বিধাননগর পুলিশ কিন্তু এত সব আয়োজনের ধার ধারেনি।

Advertisement

কুণালের বক্তব্য যাতে সর্বসমক্ষে না-আসে, তার জন্য ‘দমদম দাওয়াই’ প্রয়োগই সেরা নিদান বলে মনে করেছে ওই উপনগরীর পুলিশ। শুধু মনে করা নয়। মঙ্গলবার কুণালকে এই দাওয়াই দেওয়া হয়েছে বিধাননগর আদালত চত্বরে, আইনজীবী এবং সংবাদমাধ্যমের সামনেই। এজলাসের বাইরে সাংবাদিকদের দেখে কথা বলতে এগিয়ে আসা কুণালকে এ দিন যে-ভাবে টেনেহিঁচড়ে, ধাক্কা মারতে মারতে কার্যত চ্যাংদোলা করে লিফটে তুলে নিয়ে যাওয়া হল, তা নজিরবিহীন বলেই জানাচ্ছেন আইনজীবীদের একাংশ। ন্যায়ালয়ের চৌহদ্দিতে বিচারাধীন বন্দিকে পুলিশ এ ভাবে মারধর করতে পারে কি না, তা নিয়েও প্রশ্ন উঠছে।

কুণালের আইনজীবী সৌম্যজিৎ রাহা বলেন, ‘‘এ দিন সকলের চোখের সামনে আমার মক্কেলকে যে-ভাবে মারধর করা হল, তা মানা যাচ্ছে না।’’ কুণালের অভিযোগ, পুলিশ তাঁর বুকে-পেটে লাথিও মেরেছে। পুলিশের এই আচরণে আদালতের পবিত্রতা নষ্ট হচ্ছে বলে ক্ষোভ প্রকাশ করে এসিজেএমের কাছে অভিযোগ করেন বেশ কিছু আইনজীবী।

Advertisement

সারদা কাণ্ডে সল্টলেক ইলেকট্রনিক্স কমপ্লেক্স থানার পুরনো চারটি মামলায় এ দিন আদালতে হাজির করানো হয় সারদার কর্ণধার সুদীপ্ত সেন, দেবযানী মুখোপাধ্যায় ও সাংসদ কুণালকে। তখনই কুণাল বিচারককে বলেন, আদালত থেকে জেলে নিয়ে যাওয়ার সময় তিনি যাতে সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলতে পারেন, তার ব্যবস্থা করা হোক। পুলিশ তখন তাঁকে যাতে মারধর না-করে, তা দেখার জন্য তিনি আদালতের কাছে আবেদন করেন। ওই সাংসদের অভিযোগ, এর আগেও আদালতে তাঁকে মারধর করেছে পুলিশ। এ দিনও তাঁর উপরে অত্যাচার করা হবে বলে তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করেন। বিচারক মনদীপ সাহারায় তাঁকে জানান, বিষয়টি তিনি দেখবেন।

কুণালের আশঙ্কা যে সত্যি ছিল, তার প্রমাণ মিলল বিকেল ৪টে নাগাদ তাঁকে আদালত থেকে বার করার মুখে। তেতলার এজলাস থেকে লিফটে তাঁকে নামানো হয় একতলায়। কুণাল লিফট থেকে বেরিয়ে সাংবাদিকদের দিকে এগিয়ে যেতেই তাঁকে ঘিরে ধরেন বিধাননগর পুলিশের দুই কর্তা। তাঁদের সঙ্গে ছিল প্রায় ৫০ জনের বাহিনী। তাদের একাংশ প্রাণপণে বাধা দিতে থাকে সাংবাদিকদের। বচসা, ধাক্কাধাক্কিতে প্রথমে মাটিতে পড়ে যান সাংসদ। বেগতিক দেখে পুলিশ তাঁর দুই বগলের ভিতর দিয়ে হাত ঢুকিয়ে টেনেহিঁচড়ে তাঁকে আবার তুলে নেয় লিফটের মধ্যে। সেখান থেকেই প্রবল আর্তনাদ করতে থাকেন কুণাল। চিৎকার করে বলতে থাকেন, ‘‘আমাকে মারবেন না।’’ ওই সময়ে সাংবাদিকেরা লিফটের কাছে পৌঁছে যাওয়ার চেষ্টা করেন। তাঁদেরও ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেয় পুলিশ। তবে জেলে নিয়ে যাওয়ার জন্য সেই মুহূর্তে কুণালকে বাইরে বার করতে পারেনি তারা। তাঁকে নিয়ে লিফট ফের চলে যায় তেতলায় আদালতের লক-আপে। ওই দফায় সাংসদকে সেখানে বসিয়ে রাখা হয় প্রায় ৪৫ মিনিট। কুণালের আইনজীবীর অভিযোগ, দ্বিতীয় বার আদালতের লক-আপে ঢোকানোর সময়েও পুলিশ বেধড়ক মারধর করেছে তাঁর মক্কেলকে।

পুলিশ অবশ্য কুণালকে মারধরের অভিযোগ অস্বীকার করেছে। বিধাননগরের এডিসিপি দেবাশিস ধর বলেন, ‘‘এ-সব অভিযোগ মিথ্যে। কুণাল নিজেই আদালত-চত্বর থেকে বেরোতে চাইছিলেন না। কোনও রকম মারধর করা হয়নি।’’

আইনজীবীদের একাংশ এর মধ্যেই আদালত-চত্বরে কুণালকে মারধরের অভিযোগ নিয়ে অতিরিক্ত মুখ্য বিচার বিভাগীয় ম্যাজিস্ট্রেট অপূর্বকুমার ঘোষের কাছে হাজির হন। তাঁদের বক্তব্য, আদালত চত্বরের মধ্যে এক বিচারাধীন বন্দিকে এ ভাবে মারধর করা অন্যায়। ওই সব আইনজীবীর বক্তব্য, যখনই সারদা গোষ্ঠীর আর্থিক কেলেঙ্কারির মামলা উঠছে, বিশৃঙ্খলা ও পুলিশের আচরণে আদালতের পবিত্রতা নষ্ট হচ্ছে। তাঁরা অভিযোগের আঙুল তোলেন পুলিশকর্তাদের দিকেই। আইনজীবীদের কথা শুনে আদালতে হাজির পুলিশকর্তাদের ডেকে পাঠিয়ে তাঁদের সঙ্গে আলোচনায় বসেন বিচারক। পরে পুলিশকর্তারা জানান, কী ভাবে কুণালকে লক-আপ থেকে বার করে জেলে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া যায়, বিচারকের সঙ্গে সেই বিষয়েই আলোচনা হয়েছে।

এর প্রায় ৪৫ মিনিট পরে, বিকেল ৫টা নাগাদ কুণালকে আদালত থেকে বার করা হয়। প্রিজন ভ্যানে ওঠার মুখে পুলিশি হেনস্থা নিয়ে ফের চেঁচামেচি শুরু করেন সাংসদ। পুলিশ তাঁকে জাপটে ধরে ধাক্কা দিতে দিতে প্রিজন ভ্যানে ঢুকিয়ে দেয়। তাতেও দমে যাননি কুণাল। প্রিজন ভ্যানে দাঁড়িয়ে তিনি বলেন, ‘‘ওরা (পুলিশ) বলছে, মুখ্যমন্ত্রীর নাম নিলে ফেলে পেটাবে। আমিও দেখতে চাই, বিধাননগর উত্তর থানার ওসি-র কত বুলেট আছে!’’

প্রিজন ভ্যানে দাঁড়িয়ে মুখ্যমন্ত্রীর নাম তো করেছেনই। তার আগে ভরা এজলাসে দাঁড়িয়েও তাঁর নাম করেন কুণাল। এ দিন তিনি আদালতে দাঁড়িয়ে বিচারক বলেন, ‘‘আমি শরীর খারাপের অজুহাত দেখিয়ে আদালতে গরহাজির হই না। আমি এমন কোনও নাটকও করি না। সব নাটকের কপিরাইট তো মিস ব্যানার্জির (মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের) কাছে আছে!’’

এ দিন নিজের অসুস্থতা প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে রাজ্যের স্বাস্থ্য দফতরকেও একহাত নিয়েছেন কুণাল। আদালতে তিনি বলেন, ‘‘দীর্ঘদিন ধরে আমি অসুস্থ। তা সত্ত্বেও আমার চিকিৎসা হচ্ছে না। চিকিৎসকেরা এসএসকেএমে ভর্তি করানোর সুপারিশ করলেও কর্তৃপক্ষের নির্দেশে তা হচ্ছে না।’’ সোমবার স্বাস্থ্যপরীক্ষার জন্য এসএসকেএমে নিয়ে যাওয়া হবে বলেও তাঁকে প্রেসিডেন্সি জেলের গেটে দু’ঘণ্টা ধরে বসিয়ে রাখা হয় বলে ওই সাংসদের অভিযোগ।

কুণালের মন্তব্য, ‘‘আমার জন্য এসএসকেএম নয়। তাঁরা ‘কুকুর’ আর ‘মদন’ নিয়ে ব্যস্ত!’’

এ কথা শুনে বিচারকক্ষে হাসি চেপে রাখতে পারেননি অনেকেই। তাঁদের মধ্যে দেখা গেল রুমাল দিয়ে মুখ ঢাকা দেবযানী মুখোপাধ্যায়কেও।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন