এখনও চোখ রাখাচ্ছে সে!
শ্রীরামপুর, বিধাননগর, দক্ষিণ দমদম এবং দমদম— এই চার পুরসভাতেই অগস্টের প্রথম সপ্তাহে জাঁকিয়ে বসেছিল ডেঙ্গি। কী করবে প্রথমে বুঝে উঠতে পারছিল না তারা। শেষ পর্যন্ত মুখ্যমন্ত্রীর তৎপরতায় শুরু হয়েছিল মশা নিধন এবং জন সচেতনতা অভিযান। পরিস্থিতি একটু ভাল হতেই সে সব বন্ধ। তার জেরে ডেঙ্গি ফের স্বমহিমায় ফিরে এসেছে। এমনকী প্রাণ নিতেও শুরু করেছে। শনিবার শ্রীরামপুর এবং দক্ষিণ দমদম লাগোয়া বরাহনগর এলাকার দু’জনের মৃত্যু হয়েছে ডেঙ্গিতে।
ডেঙ্গির কোনও কার্যকর ওষুধ বের হয়নি এখনও। এমতাবস্থায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু) মশা নিয়ন্ত্রণে ধারাবাহিক ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করেছে। হু বলেছে, সংক্রামিত এলাকায় পুরসভা কিংবা স্থানীয় প্রশাসনকেই উদ্যোগী হয়ে প্রতিদিন বাড়ি বাড়ি লোক পাঠাতে হবে। দেখতে হবে একটি বাড়িও যেন বাদ না যায়। পুর-কর্মীরা বাড়ির ভিতরে ঢুকে দেখবেন, কোথায় কোথায় জল জমেছে। সেখানে টর্চ ফেলে খুঁজতে হবে মশার লার্ভা। জমা জল পেলে ফেলে দিতে হবে। কোথাও কর্মীরা ঢুকতে না পেলে বাড়ির মালিককের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশও করেছে হু।
সচেতনতা বাড়াতে বিশেষ অভিযানও চালাতে বলেছে হু। কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রকের এক কর্তা বলেন, ‘‘যেখানে স্থানীয় প্রশাসনের পরিকাঠামোগত সমস্যা রয়েছে, সেখানে স্থানীয় ক্লাব এবং গণ সংগঠনগুলিকে সঙ্গে নিয়ে প্রচার অভিযানে নামার সুপারিশ করেছি আমরা। আমাদের লক্ষ্য যে ভাবেই হোক মশার বংশবিস্তার নিয়ন্ত্রণ।’’
রাজ্যের স্বাস্থ্য অধিকর্তা বিশ্বরঞ্জন শতপথীর অবশ্য দাবি, ‘‘ইতিমধ্যেই রোগের প্রকোপ কমতে শুরু করেছে। আগামী কয়েক দিনে আরও কমবে।’’ কোথায় ডেঙ্গি রোগীর সংখ্যা কত, সেই পরিসংখ্যান জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিকর্তা বলেছেন, ‘‘কোথায় কতটা বাড়ল বা কমলো, তা বলা সম্ভব নয়। ওটা সরকারি তথ্য। তবে সরকার সব রকম ভাবে মোকাবিলার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তাই পরিস্থিতি এখনও লাগামছাড়া হয়ে ওঠেনি।’’
এখন দেখা যাক রাজ্যের সব থেকে বেশি ডেঙ্গি আক্রান্ত চার পুরসভা, সেখানে মারাত্মক ডেঙ্গি সংক্রমণের পরে এখনও পর্যন্ত কী ব্যবস্থা নিয়েছে।
শ্রীরামপুর পুরসভা: স্বাস্থ্য দফতর এই পুরসভার ডেঙ্গি পরিস্থিতিকে মহামারী বলে ঘোষণা করেছিল। তাতেও প্রথমে গা করেনি পুরসভাটি। কিন্তু নবান্নের চাপে শেষ পর্যন্ত বাড়ি বাড়ি চিকিৎসক দল পাঠানো শুরু হয়। কিন্তু পরিস্থিতি একটু স্বাভাবিক হতেই বিশেষ ব্যবস্থায় ইতি। কিন্তু পরিবেশ থেকে ডেঙ্গি রোগী এবং জীবাণুবাহী মশা যে বিলুপ্ত হয়নি, শনিবার বৃদ্ধার মৃত্যু তা দেখিয়ে দিল।
অগস্টের প্রথম দু’সপ্তাহে মৃতের সংখ্যা ছিল তিন। তার পরে গোটা মাসটা যে যুদ্ধকালীন তৎপরতায় মশা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি চালানো হয়েছিল, তাতে ভাটা পড়েছে। প্রতি বাড়ি গিয়ে তল্লাশি অভিযান বন্ধ। বাড়ি বাড়ি গিয়ে সই করানোর কর্মসূচিও বন্ধ। মশার লার্ভা খেয়ে ফেলে এমন প্রজাতির (গাপ্পি, গাম্বুসিয়া) মাছও জলাশয়ে এবং কাঁচা ড্রেনে ছাড়া হয়েছিল। সেগুলি এখন বেঁচে আছে, না মরে গিয়েছে তা দেখেইনি পুরসভা। বিভিন্ন এলাকা ঘুরে এমন অভিযোগই মিলেছে। কেন ক্লাবগুলিকে সচেতনতা প্রচারে কাজে লাগানো হল না, সেই প্রশ্ন তুলে শহরের এক চিকিৎসকের মন্তব্য, ‘‘যে সব ক্লাবকে রাজ্য সরকার কয়েক লক্ষ করে টাকা দিয়েছে, বিশেষ পরিস্থিতিতে তাদেরও মাঠে নামানো যেত।’’ পুরসভার ন্যাশনাল আরবান হেলথ্ মিশনের নোডাল অফিসার শৌভিক পাণ্ডার অশ্য দাবি, ‘‘প্রচারে কোনও ঘাটতি নেই। সব ওয়ার্ডেই স্বাস্থ্যকর্মীরা বাড়ি বাড়ি ঘুরছেন। কোথাও যদি তা না হয়ে থাকে, সেটা দেখা হবে।’’
সল্টলেক: বাড়িতে গিয়ে জ্বর হয়েছে কি না, খোঁজ নিচ্ছে পুরসভা। বাড়ির আশেপাশে মশার তেলও স্প্রে করা হচ্ছে। কিন্তু বাড়িতে ঢুকে মশা চিহ্নিত করে তা ধ্বংসের কাজ সর্বত্র হচ্ছে না। বিশেষত বহুতলগুলিতে তো নয়ই। যেমন, সল্টলেকের ইই ব্লকের বাসিন্দাদের একাংশ জানান, বহুতলের ছাদে বা চত্বরে ঢুকে মশা নিধন হচ্ছে না। কেবি-কেসি আবাসন থেকে ইস্টার্ন ড্রেনেজ চ্যানেলের পাড়ের অবস্থাও তথৈবচ। মশার বংশবৃদ্ধির আঁতুড়ঘর সেখানে। ঝোপ-জঙ্গল কাটা ছাড়া কিছু হচ্ছে না। বিধাননগর পুর এলাকায় অন্তত চার হাজার মানুষ জ্বরে আক্রান্ত। ৫০০ জনেরও বেশি ডেঙ্গিতে আক্রান্ত। যদিও পুরসভার সরকারি হিসেবের সঙ্গে তা মিলছে না।
বিধাননগরের মেয়র পারিষদ (স্বাস্থ্য) প্রণয় রায় বলেছেন, ‘‘সদ্য তৈরি একটি কর্পোরেশন। তার সঙ্গে কলকাতার তুলনা চলে না। আমরা নিশ্চিত ভাবেই পরিকাঠামো ঠিক করব। আপাতত হাতে গোনা কিছু কর্মী এবং যন্ত্রপাতি নিয়েই আমরা চলছি। নিজস্ব তহবিল থেকেই সরঞ্জাম সংগ্রহ করে কাজ চলছে।’’
দক্ষিণ দমদম: বাসিন্দাদের অভিযোগ, বাড়ি বাড়ি মশা চিহ্নিত করে ধ্বংস করা, সচেতনতা প্রচার, তেল স্প্রে, প্রয়োজনে কামান দাগা, জঙ্গল সাফাইয়ের কাজ— সবেতেই পিছিয়ে এই পুরসভা। পরিস্থিতি এমন যে, এখানকার ১৩ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দারা ডেঙ্গি মোকাবিলায় যজ্ঞ করছেন! স্থানীয় কাউন্সিলর তৃণমূলের প্রবীর পাল বলেন, ‘‘মধুগড়-সহ বিস্তীর্ণ এলাকায় ডেঙ্গির প্রকোপ বেড়েছে। পুরসভা প্রতিকারের চেষ্টা করছে। ওষুধ ও তেল স্প্রে আরও বাড়ালে ভাল হত।’’ চেয়ারম্যান পারিষদ (বর্জ্য) দেবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায় বলছেন, ‘‘প্রতি ওয়ার্ডের জন্য মাসে ২০ লিটার মশার তেল বরাদ্দ থাকে। সেগুলো ঠিকমতো ছড়ানো হয় বলেই জানি। এর বেশি তেল বরাদ্দ করা পুরসভার পক্ষে সম্ভব নয়।’’ ডেঙ্গিতে আক্রান্ত হয়ে ফের বিকাশ ঘোষ নামে এক জনের মৃত্যু হয়েছে। বর্ধমানের কেতুগ্রামের রাজুর গ্রামের বাসিন্দা বিকাশ দক্ষিণ দমদম লাগোয়া বরাহনগরে থাকতেন।
দমদম: এই পুর এলাকার কমলাপুর, কুমোড়পাড়া, দমদম ক্যান্টনমেন্ট, রাধানগরেও জ্বরে আক্রান্ত হচ্ছেন বাসিন্দারা। পুরসভা সূত্রে খবর, এই মুহূর্তে এখানে ৯০ জন আক্রান্ত। চেয়ারম্যান পারিষদ(স্বাস্থ্য) রিঙ্কু দত্ত বলেন, ‘‘টিম করেছি। প্রচারও চলছে।’’ তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রী তথা স্থানীয় বিধায়ক ব্রাত্য বসু দমদম এলাকায় মিছিলও করেছেন। বাসিন্দা ও শাসক দলের একাংশের দাবি, কিছু লিফলেট দেখতে পেলেও মাইকে বা বাড়ি গিয়ে প্রচারে অনেক পিছিয়ে পুরসভা। মোকাবিলা কী ভাবে সম্ভব, তা পুরসভা জানে না বলে অভিযোগ। সে ক্ষেত্রে জেলা ও রাজ্য স্বাস্থ্য দফতর কেন হাত গুটিয়ে বসে, জবাব নেই কোনও মহলেই।