ছলেবলে জমি দখল-সহ নানা অপরাধমূলক কাজকর্মে জড়িত অভিযোগে দিনকয়েক আগে হাওড়া ও হুগলি জেলার ‘ত্রাস’ রমেশ মাহাতোকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। কিন্তু শ্রীঘরে বসে রমেশ পুলিশি জেরায় তার বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ উড়িয়ে দিয়ে তা শাসক দলের ঘাড়ে চাপিয়েছে।
পুলিশের দাবি, জেরায় রমেশ জানিয়েছে, সে নির্মাণ সামগ্রী সরবরাহের ব্যবসা করে মাত্র। শাসক দলের নেতারাই তার নাম করে টাকা তুলছে, জমি দখল করছে। আর তাকে বিনা দোষে শ্রীঘরে পচে মরতে হচ্ছে। পুলিশ অবশ্য রমেশের এই দাবিকে পুরোপুরি উড়িয়ে দিচ্ছে না। হুগলি জেলা পুলিশ সুপার প্রবীণ ত্রিপাঠী বলেন, “রমেশের সঙ্গে কারা যুক্ত, তার সম্পত্তির পরিমাণ কত বা তার টাকার উৎস কী— সবই দেখা হচ্ছে। তার বিরুদ্ধে যে সব পুরনো মামলা রয়েছে, তা-ও খতিয়ে দেখা হচ্ছে।”
‘জমি-মাফিয়া’ রমেশের সঙ্গে শাসক দলের নেতাকর্মীদের যোগাযোগ নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই সরব বিরোধীরা। কয়েক মাস আগে রমেশের দুই মেয়ের বিয়েতেও জেলা তৃণমূল নেতৃত্বের অনেককেই দেখা গিয়েছিল। এ নিয়ে অস্বস্তিতেও পড়তে হয় শাসক দলকে। কিন্তু তার পরেও দু’পক্ষের যোগসাজশ নিয়ে অভিযোগ ওঠা বন্ধ হয়নি। অভিযোগ, ডানকুনি থেকে দুর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়ে এবং দিল্লি রোডের দু’ধারের বহু জমিই এখন রমেশের দলবলের নজরবন্দি। শাসক দলের স্থানীয় নেতাদের সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধে শিল্পের জমি এবং কৃষিজমিতেও থাবা বসানো হয়েছে। আবার কোথাও স্রেফ প্লট করে কৃষিজমি দেদার হাত বদলে চলে আসছে রমেশ এবং তার দলবলের হাতে।
পুলিশের একটি সূত্রে জানা গিয়েছে, ডানকুনিতে এক নেতার ‘সৌজন্যে’ দলিল জাল করে জমির চরিত্র বদল করে ফেলা হচ্ছে। সরকারি খাস জমিও প্লট করে বিক্রি হয়ে যাচ্ছে রমেশের দলবলের কাছে। তার সঙ্গে ক্রমাগত টাকার জন্য হুমকি-ফোনও চলছে। মাস কয়েক আগে এক বিস্কুট-কারখানার মালিকের কাছেও টাকা দাবি করে জমি-মাফিয়ারা। ক্রমাগত হুমকির মুখে পড়ে কারখানার নির্মীয়মাণ অংশের কাজ বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়। পুলিশি হস্তক্ষেপে সে যাত্রায় বিষয়টির মীমাংসা হয়।
বস্তুত, বালি-বেলুড় থেকে ডানকুনি শিল্পাঞ্চল, উত্তরপাড়া থেকে চন্দননগর, কোন্নগর— সর্বত্র রমেশের জাল বিছানো। কোথাও সরাসরি শাসক দলের স্থানীয় নেতাদের সঙ্গে সে মিলেমিশে কাজ করছে, কোথাও আবার সরাসরি প্রোমোটারদের সঙ্গে রফা করছে বলে অভিযোগ। উত্তরপাড়ায় ফিল্ম সিটি তৈরির কথা ঘোষণা করেও পিছিয়ে আসে রাজ্য সরকার। ওই প্রকল্প নিয়েও রমেশ-বাহিনীর আপত্তি ছিল বলে স্থানীয় তৃণমূলেরই একটি সূত্রের দাবি। কেননা, গঙ্গার পাড়ে ফিল্মসিটির থেকে ইটভাটার জমিতে আবাসন তাদের কাছে অনেক লাভজনক।
প্রশাসনের একটি সূত্র জানাচ্ছে, উত্তরপাড়ার সমস্ত বড় আবাসন প্রকল্পে হয় রমেশ, না হলে তার শাগরেদ চিকুয়া, নেপুয়া বা আক্রমরা জড়িত। আর তাদের মদত দিচ্ছে শাসক দলের স্থানীয় নেতারা। এ কথা অবশ্য জেলা তৃণমূল সভাপতি তপন দাশগুপ্ত মানতে চাননি। তাঁর দাবি, ‘‘পুলিশ মামলা করছে। ওর মতো দাগি দুষ্কৃতী কাকে কী বলল, তাতে কারও কিছু যায় আসে না। পুলিশ শক্ত হাতে দুষ্কৃতী দমন করছে বলেই ওদের গায়ে জ্বালা ধরছে।”
১৫ মাস আগে সুপ্রিম কোর্ট থেকে জামিন পেয়ে এলাকাতেই ছিল রমেশ। কিন্তু মাস কয়েক আগে পুলিশের তাড়ায় সে পালিয়ে বেড়াতে থাকে। সম্প্রতি বিহার হয়ে মুম্বইয়ে পাতানো বোনের বাড়িতে ওঠে। পুলিশের নজর এড়াতে গত কয়েক মাসে সে প্রায় ৩৫ বার মোবাইলের ‘সিম’ বদলেছে। পোশাক এবং চেহারাও বদলের চেষ্টা করেছে। মাঝে বড় চুলও রেখেছিল মূলত হিন্দি এবং বাংলা বলতে অভ্যস্ত, আদতে বেনারসের এই বছর ছাপান্নর দুষ্কৃতী। কিন্তু পুলিশ সুপারের ক্রমাগত চাপে ফের তার ঠাঁই হল শ্রীঘরে।