বৃহস্পতিবার সভাপতি বরণের মঞ্চে শুভেন্দু অধিকারী এবং শমীক ভট্টাচার্য। —ফাইল চিত্র।
দিল্লি থেকে কলকাতায় ফিরেছিলেন বুধবার সকালে। পরবর্তী ৪৮ ঘণ্টা যে গতিতে কেটেছে, গত ৪২ বছরের রাজনৈতিক জীবনে তেমন দিনকাল শমীক ভট্টাচার্য কাটিয়েছেন কি না, ঘনিষ্ঠতম সহচরেরাও মনে করতে পারছেন না। পশ্চিমবঙ্গ বিজেপির নতুন সভাপতি রাজনীতিতে পুরনো। বরাবরই দলবল, লোকলস্কর নিয়ে ওঠাবসা। ঘনিষ্ঠ বৃত্ত বলতে যা বোঝায়, তার আকারও অন্য অনেক ভারিক্কি নেতার চেয়ে বড়। সুতরাং শমীকের ঘরদুয়ার আগেও গমগমই করত। কিন্তু বুধবার থেকে তাঁকে ঘিরে যে পরিস্থিতি, তা যেন ‘জোয়ারের দোসর হড়পা বান’। নিমেষে বদলে গিয়েছে তাঁর রোজনামচা। গত দু’দিনে দু’বেলার আহারটুকুও বাড়িতে জোটেনি।
বুধবার সকালে কলকাতা বিমানবন্দর থেকে বিধাননগরের বাড়ি। সেখান থেকে বেলা ২টো নাগাদ দলীয় কার্যালয়ে। ‘রাজ্যসভা সাংসদ’ স্টিকার সংবলিত সাদা এসইউভি থেকে রাস্তায় পা রাখতেই টেলিভিশন ক্যামেরার দুর্ভেদ্য ঘেরাটোপ প্রায় বন্দি করে ফেলেছিল শমীককে। সে সব সামলে মিডিয়া সেলের ঘর ঘুরে কার্যালয়ের দোতলায়। নীচে নেমেছিলেন সভাপতি নির্বাচনের মনোয়ন পর্ব শেষ হওয়ার পরে। সোজা গিয়েছিলেন মুরলীধর সেন লেনের দলীয় কার্যালয়ে। শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের মূর্তিতে মালা দিয়ে, কার্যালয়ের উল্টো দিকের চেনা দোকানে চা-টোস্ট খেয়ে ফের বিধাননগরের দফতর। সন্ধ্যায় সেখান থেকেই বিমানবন্দরে কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের পাঠানো নির্বাচনী আধিকারিক রবিশঙ্কর প্রসাদ এবং পর্যবেক্ষক মঙ্গল পাণ্ডেকে স্বাগত জানাতে। রাতে তাঁদের সঙ্গে কয়েক দফা আলাপ-আলোচনা সেরে বাড়ি। আর বৃহস্পতিবার সকাল হতেই জীবনের ছন্দ বদলের আঁচ পাওয়া।
এমনিতে সকাল সাড়ে ৬টা থেকে ৭টার মধ্যেই উঠে পড়েন। বার তিনেক চিনি ছাড়া লিকার চা। তার পরে প্রাতরাশে হাল্কা কিছু। অল্প রুটি-সব্জি বা সামান্য দই-চিঁড়ে। সে সব সেরেই বেরিয়ে পড়তেন দলীয় কাজে। কয়েক ঘণ্টার কাজ সেরে বাড়ি ফিরে মধ্যাহ্নভোজ। আপ্ত-সহায়ক তথা দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক সঙ্গী উত্তম দাসের কথায়, ‘‘ভাত খান তো এইটুকু! খুব বেশি হলে ২৫ গ্রাম চালের। সঙ্গে বাড়িতে রান্না হাল্কা-পাতলা তরিতরকারি। খাসির মাংস আর মিষ্টি খুব ভালবাসেন। কিন্তু বেশ কয়েক বছর আগেই ডাক্তারের পরামর্শে সে সব ছেড়ে দিয়েছেন।’’ মিটিং-মিছিল না থাকলে বা দলীয় কাজে বাইরে না থাকলে দুপুরটা বাড়িতেই কাটাতেন শমীক। বিকেলে সাংবাদিক বৈঠক করতেন রাজ্য বিজেপির প্রধান মুখপাত্র হিসেবে। অধিকাংশ দিন বিএইচ ব্লকের বাড়ির হাতায়। কোনও কোনও দিন রাজ্য দফতরেও। গত কয়েক বছরে শমীকের এই বৈকালিক সাংবাদিক বৈঠক প্রায় নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছিল।
সন্ধ্যা থেকেই শমীকের ঘনিষ্ঠ বৃত্ত তাঁর বাড়িতে হাজির। বসার ঘরে গোল হয়ে আড্ডা বসত। সাংবাদিক বৈঠকের খবর ফোনে অফিসকে জানিয়ে অনেক সাংবাদিকও শামিল হতেন সেই আড্ডায়। দফায় দফায় চা আসত। বাছাই দোকানের চপ বা বিশেষ দোকানের মিনি শিঙাড়াও আবদার মাফিক পৌঁছে যেত। শমীক যদি বিকাল-সন্ধ্যায় অন্য কর্মসূচিতে বাইরে থাকতেন, তা হলেও তিনি ফেরার পর বন্ধুমহল আড্ডা দিয়ে যেত কয়েক ঘণ্টার জন্য। বিজেপির পুরনো দিন থেকে বাম জমানার রাজনীতি, ব্যক্তিবিশেষ নিয়ে চর্চা থেকে শুরু করে দর্শনের আলোচনা, কী থাকত না সে সব আড্ডায়!
বুধবার থেকে সে ছন্দ উধাও। ঘনিষ্ঠ বৃত্ত এখনও সঙ্গেই রয়েছে। সহচররা এখনও ঘিরেই রয়েছেন। কিন্তু ভিড় আচমকা দশগুণ বা তার বেশি। সকালে ঘুম ভেঙেই খবর পাচ্ছেন, বাড়ির বাইরে সংবাদমাধ্যম দাঁড়িয়ে। গাড়ির সারি বিএইচ ব্লকের রাস্তাকে অপরিসর করে তুলছে। আর ফোনের ঘন্টি আক্ষরিক অর্থেই থামছে না। তরুণ বিজেপি কর্মী সুবীর শীল অনেক বছর ধরে শমীকের ঘনিষ্ঠ সহযোগী। ঘরে-বাইরে অনেক কাজই সামলে দেন। তিনি জানাচ্ছেন, গত কয়েক দিনে কয়েক হাজার ফোন ধরতে হয়েছে তাঁকে। তার চেয়েও বেশি ফোন অপেক্ষায় থাকতে থাকতে কেটে গিয়েছে। সুবীরের কথায়, ‘‘মনে হচ্ছে বাড়িতে খাওয়ার অভ্যেসটা উঠেই যাবে। গত দু’দিনে দাদা (শমীক) সেই সুযোগ পাননি। বৃহস্পতিবার গভীর রাত পর্যন্ত বৈঠক হয়েছে। দাদা সেখানেই অল্প খেয়ে নিয়েছিলেন। শুক্রবারেও ১২টা থেকে পার্টি অফিসে একটার পর একটা বৈঠক। পৌনে ৩টে নাগাদ পার্টি অফিসেই বনসলজি (সুনীল বনসল), পাণ্ডেজির (মঙ্গল পাণ্ডে) সঙ্গে খেয়ে নিলেন।’’
শমীকের আর এক তরুণ সহচর সায়ন গঙ্গোপাধ্যায় অবশ্য ‘রুটিনবদল’ হয়েছে বলে মানতে রাজি নন। সায়নের কথায়, ‘‘লোকজন বেশি আসছে ঠিকই। বাড়িতে ভিড়ভাট্টাও আগের চেয়ে বেড়েছে। কিন্তু প্রয়োজন পড়লে দিনভর ছোটাছুটি, গভীর রাত পর্যন্ত বৈঠক— এ সব শমীকদা আগেও করেছেন।’’
রাজ্য বিজেপির নতুন সভাপতি নিজে কী বলছেন জীবনের ছন্দ-বদলের বিষয়ে? বলছেন, ‘‘এগুলো আমাদের কাছে কোনও বড় বিষয় নয়। সব ছন্দেই আমরা অভ্যস্ত। আমরা এখন শুধু বাংলার এবং বাঙালির জীবনের ছন্দ বদলানোর কথা ভাবছি।’’ সে ভাবনা কেমন? শমীক বলছেন, ‘‘বাংলার যুবসমাজকে বলছি, একটু অপেক্ষা করুন। ছন্দ বদলাবে। পরিযায়ী হয়ে বাইরে চলে যেতে হবে না। শিল্পপতিদের বলছি, কয়েকটা মাস অপেক্ষা করুন। বাংলায় শিল্পের জন্য অনুকূল পরিবেশ আমরা তৈরি করব, অবৈধ চাঁদার জুলুম আমরা বন্ধ করব। সাধারণ মানুষকে বলছি, একটু সময় দিন। পশ্চিমবঙ্গের বিচারব্যবস্থার নিচুতলায় সম্পূর্ণ স্বচ্ছতা নিশ্চিত করে প্রশাসনকে জনতার সহায় হতে আমরাই বাধ্য করব।’’