Samik Bhattacharya

একটা সময়ে তিনি কোণঠাসা ছিলেন দলে, সেই তাঁর হাতেই এখন রাজ্যের ভার কী কারণে, খুঁজল আনন্দবাজার ডট কম

সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়, জ্যোতি বসু, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য এবং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। চার জনই বাংলার মুখ্যমন্ত্রী হয়েছেন। রাজনৈতিক ভেদাভেদ যা-ই থাকুক, চার জনের মধ্যেই একটি মিল রয়েছে— সকলেই ‘কলকাতার মুখ’। শমীকও তা-ই।

Advertisement

ঈশানদেব চট্টোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ০২ জুলাই ২০২৫ ২০:২৯
Share:

নীলবাড়ির লড়াইয়ের আগে বিজেপির সংগঠনের মাথায় ‘কলকাতার মুখ’ শমীক ভট্টাচার্য। গ্রাফিক: আনন্দবাজার ডট কম।

ঠেকে শিখেই কি কলকাতার দিকে মুখ ফেরালেন বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব? শমীক ভট্টাচার্যকে বঙ্গ বিজেপির সভাপতি করার সিদ্ধান্ত কাটাছেঁড়া করতে বসে তেমনই মনে করছেন অনেকে।

Advertisement

পাশাপাশিই, বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব সূত্রের খবর, আরও কয়েকটি কারণে শমীককে বেছে নেওয়া হল। প্রথমত, শমীক দলের ভিতরে-বাইরে ‘শহুরে শিক্ষিত মধ্যবিত্ত’ বলে পরিচিত। তাঁর এই পরিচিতিকে কলকাতা, রাজারহাট-সহ ‘বৃহত্তর কলকাতা’ বা দুর্গাপুরের মতো ‘বাঙালি ভদ্রলোক’ অধ্যুষিত এলাকায় কাজে লাগাতে চান বিজেপি নেতৃত্ব। দ্বিতীয়ত, এ রাজ্যে পদ্মশিবির যখন কোনও শক্তি হিসাবে গণ্য হত না, তখন থেকে এখনও পর্যন্ত একই ভাবে বিজেপির মুখপাত্র হিসাবে সংবাদমাধ্যমকে সামলেছেন দলের মধ্যে ‘বাগ্মী’ বলে পরিচিত শমীক। বিরোধীদলের নেতা হতে গেলে তাঁকে সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে সম্পর্ক রেখে চলতে হয়। তাদের কাছে গ্রহণযোগ্য হতে হয়। রাতবিরেতে দরকারে দলের বক্তব্য জানাতে হয়। শমীকের সেই ‘গ্রহণযোগ্যতা’ রয়েছে। যেমন বিরোধী নেত্রী থাকার সময় ছিল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের। যা নেই বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীর।

ঘটনাচক্রে, সেই শুভেন্দুর সঙ্গে তাঁর ‘সুসম্পর্ক’ও শমীককে বেছে নেওয়ার একটি কারণ। বিরোধী দলনেতা এবং রাজ্য সভাপতির মধ্যে সমন্বয় ‘মসৃণ’ রেখে বাংলায় বিধানসভা ভোটের ময়দানে নামতে চান কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব। শমীকের সঙ্গে অবশ্য বরাবরই অন্য দল থেকে বিজেপি-তে আগত নেতাদের সুসম্পর্ক থেকেছে। সে তিনি মুকুল রায়ই হোন বা শুভেন্দু। আশ্চর্য নয় যে, শমীককে সভাপতি পদে বসাতে শুভেন্দুর সমর্থন ছিল।

Advertisement

রাজ্যসভার সাংসদ শমীক সভাপতি হওয়ার পরে এটাও মোটামুটি নিশ্চিত হয়ে গেল যে, আগামী ভোটে শুভেন্দুই হবেন বিজেপির ‘মুখ’। সে বিষয়ে কোনও দ্বন্দ্ব থাকবে না। শমীক অবশ্য বলছেন, ‘‘এই মুহূর্তে কোনও নির্দিষ্ট মুখ বা নির্দিষ্ট ব‍্যক্তির হাতে পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতির নিয়ন্ত্রণ নেই। বাংলার মানুষ স্থির করে নিয়েছেন লড়াই কার সঙ্গে কার। স্থির করে নিয়েছেন তৃণমূলের বিসর্জন হবে। সুতরাং কে মুখ, কে কোন পদে, সেটা বড় কথা নয়।’’ বস্তুত, সভাপতি হয়েই ভোটের ভেরী বাজিয়ে দিয়েছেন শমীক। বলেছেন, ‘‘আগামী নির্বাচন বাংলা থেকে লগ্নি বেরিয়ে যাওয়া আটকানোর নির্বাচন। বাংলায় উপযুক্ত কর্মসংস্থান তৈরি করে রাজ‍্য থেকে মেধার নিরন্তর বহির্গমন রোখার নির্বাচন। হিন্দু বাঙালির অস্তিত্ব রক্ষার স্বার্থে এই নির্বাচন শেষ সুযোগ। মানুষ সেই কথাটা মাথায় রেখেই নির্বাচনে যাবেন। অন‍্য সব কিছু গৌণ।’’

শমীকের ক্ষেত্রে ‘কলকাতা ফ্যাক্টর’ কাজ করেছে বলে যাঁরা দাবি করছেন, তাঁদের বক্তব্য, ২০১৯ সালের লোকসভা ভোটে নজিরবিহীন ফল করেও বিজেপি ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে ৭৭ আসনে আটকে গিয়েছিল। তখন রাজ্য সভাপতি ছিলেন দিলীপ ঘোষ। যিনি ঝাড়গ্রামের গোপীবল্লভপুরের ভূমিপুত্র। দিলীপের পরে সভাপতি করা হয় সুকান্ত মজুমদারকে। তিনি দক্ষিণ দিনাজপুরের। এই দু’জনকে ‘উপর’ থেকে বসিয়ে দেওয়া হয়েছিল। আর নিজের সাংগঠনিক দক্ষতায় যিনি বিজেপি-তে গিয়ে বিরোধী দলনেতার আসনে, সেই শুভেন্দু অধিকারীও পূর্ব মেদিনীপুরের। ইতিহাস বলে, বাংলার রাজনীতিতে নির্বাচনী সাফল্যের সঙ্গে কলকাতায় বসবাসের নিবিড় যোগাযোগ রয়েছে। এই মতের প্রবক্তারা অধীর চৌধুরীরও উদাহরণ দিচ্ছেন। যিনি প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি হলেও বহরমপুর থেকে যাতায়াত করেছেন। তাঁর আমলেই কংগ্রেস নির্বাচনী বিপর্যয় দেখেছে।

পাশাপাশিই সাফল্যের নিরিখে উদাহরণ দেওয়া হচ্ছে সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়, জ্যোতি বসু, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য এবং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের। চার জনেই বাংলার মুখ্যমন্ত্রী হয়েছেন। রাজনৈতিক ভেদাভেদ যা-ই থাকুক, চার জনের মধ্যেই একটি মিল রয়েছে— সকলেই ‘কলকাতার মুখ’। শহরের রাজনীতি থেকেই তাঁদের উত্থান।

তবে এই কলকাতা তত্ত্বের পাল্টা অভিমতও বিজেপির অন্দরে রয়েছে। বলা হচ্ছে, রাজ্য বিজেপির সভাপতি হয়েছিলেন তথাগত রায় এবং রাহুল সিংহেরা। তাঁরাও কলকাতার। বরং রাজ্যে বিজেপির উত্থানপর্ব শুরু হয়েছিল দিলীপের আমলে। যাঁর শিকড় কলকাতায় নয়।

বিজেপির অন্দরে অনেকের অনুমান ছিল, বিধানসভা নির্বাচনের আগে রাজ্যে সভাপতি পদে বদল করা হবে না। ভোট পর্যন্ত সুকান্তকেই রেখে দেওয়া হবে। কোনও কোনও মহল থেকে বলা হচ্ছিল, সুকান্তকে সরানো হলে বিরোধী দলনেতা শুভেন্দুকে সভাপতি করা হবে। কিন্তু বিজেপির দলীয় কাঠামোয় বিরোধী দলনেতা পরিষদীয় রাজনীতির লোক হবেন। সভাপতি হবেন সংগঠনের। ফলে শুভেন্দুকে নিয়ে জল্পনায় বিশেষ সত্য ছিল না।

বিবিধ সূত্রে খবর পেয়ে আনন্দবাজার ডট কম-ই প্রথম লিখেছিল, শমীকই সম্ভবত বিজেপির সভাপতি হতে চলেছেন। তার ৪৮ ঘন্টার মধ্যেই সে খবর আনুষ্ঠআনিক ভাবে ঘোষিত হয়েছে।

১৯৭৪ সাল নাগাদ হাওড়ার মন্দিরতলা এলাকায় রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক (আরএসএস)-এর শাখায় যাতায়াত শুরু শমীকের। সঙ্ঘ পরিবারের সদস্য পরিচয় নিয়েই রাজনীতিতে যোগ। ২০০৬ সালে প্রথম বিজেপির টিকিটে শ্যামপুকুর বিধানসভা কেন্দ্র থেকে লড়ে হেরে যান। তথাগত সভাপতি থাকার সময় থেকেই শমীকের উত্থান শুরু। তখনই তিনি রাজ্যের সাধারণ সম্পাদক হন। রাহুল সভাপতি হওয়ার পরেও ওই পদে ছিলেন শমীক। দিলীপ রাজ্য সভাপতি হলে তিনি দলের প্রধান মুখপাত্র হন। কিন্তু তাঁর সেই স্তরের ‘গুরুত্ব’ ছিল না।

সঙ্ঘ পরিবারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার সূত্রে বিজেপির অন্দরে ‘ঘরের লোক’ বলে পরিচিত হলেও শমীক কেন দলে গুরুত্ব পাননি, তা নিয়ে অনেকেই কৌতূহলী ছিলেন। যার জবাবে বিজেপির অন্দরে কিছু ‘ব্যাখ্যা’ও শোনা যায়। যেমন অনেকের দাবি, শমীক দলে অন্তর্ঘাতের শিকার হয়েছিলেন। ২০১৪ সালের লোকসভা ভোটে বসিরহাট কেন্দ্রের প্রার্থী হয়ে হেরে যান শমীক। কিন্তু সেই বছরেই বসিরহাট দক্ষিণ কেন্দ্রে বিধানসভা উপনির্বাচনে অনেককে চমকে জিতেছিলেন তিনি। তখন দলের সভাপতি ছিলেন রাহুল। দলের একটি অংশের দাবি, শমীকের কার্যত ‘একক শক্তি’তে জয় দলের অন্দরে আলোড়ন তৈরি করেছিল। পদাধিকারীদের অনেকে ‘আশঙ্কিত’ হয়ে পড়েছিলেন। তার পর থেকেই শমীককে ‘কোণঠাসা’ করা শুরু হয়।

আবার অনেকের দাবি, ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে শমীক দমদম কেন্দ্রে প্রার্থী হওয়ায় পরে তাঁর বিরুদ্ধে এমন কিছু অভিযোগ উঠেছিল, যা বিজেপির মতো ‘রক্ষণশীল’ দলের ক্ষেত্রে অস্বস্তিকর। শমীক অবশ্য সমস্ত অভিযোগই অস্বীকার করেছিলেন।

তবে শমীকের ঘনিষ্ঠদের বক্তব্য, দলের অন্দরে যা-ই হোক, শমীক বরাবর নিষ্ঠার সঙ্গে দলের কাজ করে এসেছেন। দলের কারও বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে মুখ খোলেননি। এক ঘনিষ্ঠের কথায়, ‘‘উনি সেই বিরল রাজনীতিবিদ, যিনি জানেন কে বা কারা দলে ওঁর ক্ষতি করছে। তবু কখনও তাঁদের বিরুদ্ধে কিছু বলেন না। বরং ক্ষমা করে দেন। ওঁর এই স্বভাবই ওঁকে সকলের চেয়ে আলাদা করে দেয়।’’ ওই নেতার আরও দাবি, ‘‘২০১৬ সালে তৃণমূল ওঁকে প্রার্থী করতে চেয়েছিল। মন্ত্রিত্বের প্রস্তাবও দিয়েছিল বলে শুনেছি। কিন্তু উনি যাননি। আদর্শ আর দলের প্রতি ওঁর নিষ্ঠা কখনও টলেনি। উনি সব সময় বলেন সাংগঠনিক গোপনীয়তা, মতাদর্শের প্রতি প্রগাঢ় বিশ্বাস, নেতৃত্বের প্রতি প্রশ্নাতীত আনুগত্যই একটি সংগঠিত রাজনৈতিক দলের প্রাথমিক ধর্ম।’’

গত বছর দলের প্রতি নিষ্ঠার ‘স্বীকৃতি’ পেয়েছেন তিনি। দল তাঁকে রাজ্যসভার সাংসদ করেছে। বছর ঘুরতে না ঘুরতেই ‘গুরুদায়িত্ব’! নীলবাড়ির লড়াইয়ে গোটা সংগঠনের ভার তাঁর উপর দিয়েছেন মোদী-শাহেরা। লড়াই কঠিন। তবে ভেরী বাজিয়ে দিয়েছেন শমীক।

(এই প্রতিবেদনটিতে প্রথমে লেখা হয়েছিল: শমীক ভট্টাচার্য এ রাজ্যে বিজেপির প্রথম বিধায়ক। এটি সঠিক নয়। পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির প্রতীকে জেতা প্রথম বিধায়ক বাদল ভট্টাচার্য। ২০০০ সালে উত্তর ২৪ পরগনার অশোকনগর কেন্দ্রের উপনির্বাচনে জিতেছিলেন তিনি। ভুল গোচরে আসার পরই তা সংশোধন করে নেওয়া হয়েছে। অনিচ্ছাকৃত ওই ত্রুটির জন্য আমরা আন্তরিক ভাবে দুঃখিত এবং ক্ষমাপ্রার্থী)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement