Sudhir Chalraborty

গানে, ফুলে, শ্রদ্ধায় স্যরকে বিদায়

কিছু সময় পর ভিড়ের ভিতর থেকে বেরিয়ে এক ভদ্রলোক। রামকৃষ্ণ পাঠাগারের গেটের সামনে দাঁড়িয়ে চশমাটা খুলে দু’আঙুল দিয়ে মুছে নিলেন চোখ।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

কৃষ্ণনগর শেষ আপডেট: ১৭ ডিসেম্বর ২০২০ ০০:০৩
Share:

নবদ্বীপ শ্মশানে। নিজস্ব চিত্র

সকাল সাড়ে আটটা। শববাহী গাড়ি এসে দাঁড়াল রামকৃষ্ণ পাঠাগারের সামনে। ভিতরে চিরনিদ্রায় শুয়ে রইলেন কৃষ্ণনাগরিকদের প্রিয় ‘স্যর’।

Advertisement

বুধবার, সুধীর চক্রবর্তীর শেষযাত্রার সাক্ষী রইল এই শহর। ফুল দিয়ে অতি যত্ন করে সাজিয়ে দেওয়া হয়েছিল তাঁর মরদেহ। আগে থেকেই পাঠাগারের সামনে ভিড় করেছিলেন তাঁর গুণমুগ্ধরা। অনেকেরই হাতে ছিল ফুল। শববাহী গাড়ি এসে পৌঁছতেই সকলে মিলে তা ভিড় করে ঘিরে ধরেন। সকলেই তাঁর পায়ে ফুল দিয়ে শেষবারের মতো শ্রদ্ধা জানাতে চান।

কিছু সময় পর ভিড়ের ভিতর থেকে বেরিয়ে এক ভদ্রলোক। রামকৃষ্ণ পাঠাগারের গেটের সামনে দাঁড়িয়ে চশমাটা খুলে দু’আঙুল দিয়ে মুছে নিলেন চোখ। মুখে বিষণ্ণতা। পাঠাগারের পরিচালন সমিতির সম্পাদক চন্দন সরকার তখন কার্যত বাক্‌রুদ্ধ। কোনও মতে শুধু একটা কথাই বলতে পারলেন— ‘‘স্যর নেই... কিছুতেই মানতে পারছি না।”

Advertisement

সুধীর চক্রবর্তীর দাদা দেবপ্রসাদ চক্রবর্তীকে সকলে মাস্টারমশাই বলে চেনেন। আজীবন হরিজনপল্লির মানুষদের মধ্যে নিবিড় ভাবে কাজ করে গিয়েছেন। এই রামকৃষ্ণ পাঠাগার প্রতিষ্ঠা তাঁর হাত ধরেই। ২০০৬ সালে তিনি মারা যাওয়ার পর তাঁর জায়গায় পরিচালন সমিতির সভাপতি হয়েছিলেন প্রাবন্ধিক সুধীর চক্রবর্তী। আমৃত্যু সেই পদে দায়িত্ব সামলেছেন।

বুধবার সকাল সাড়ে আটটা নাগাদ বাড়ি থেকে সুধীরবাবুর মরদেহ নিয়ে সেই পাঠাগারের সামনেই এসে দাঁড়ায় শববাহী গাড়ি। ভিতরে নিথর দেহ তিনি। সে দিকে স্থির দৃষ্টিতে খানিক তাকিয়ে থেকে শহরের তরুণ বাচিকশিল্পী আকাশ দত্ত বলে ওঠেন, “এই ফাঁকা জায়গা ভরাট হওয়া... বড় কঠিন।”

এর পর একে একে সেখানে ভিড় জমান শহরের বিশিষ্ট নাগরিকেরা। কবি থেকে শুরু করে নাট্যকার, লেখক থেকে সঙ্গীত শিল্পী, অভিনেতা থেকে তরুণ বাচিক শিল্পীও। সকলেই চান তাঁদের স্যরকে শেষ দেখা দেখতে। এ দিন প্রায় আধঘণ্টা সেখানে রাখা হল সুধীর চক্রবর্তীর মরদেহ। তার পর ধীরে ধীরে এগিয়ে যেতে থাকে শববাহী গাড়ি। পিছনে পায়ে হেঁটে এগোন তাঁর অনুরাগীরা। কেউ গেয়ে চলেন একের পর এক রবীন্দ্রসঙ্গীত। কেউ নির্বাক, শোকস্তব্ধ।

নগেন্দ্রনগর থেকে শববাহী গাড়ি কদমতলা ঘাট হয়ে এগিয়ে যায় ধোপাপাড়ায় পৈত্রিক বাড়ির দিকে। সেখানে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রোডের উপরে সামান্য কিছু ক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে আবার মরদেহ রওনা হয় পোস্ট অফিস মোড়ের দিকে। এই গোটা যাত্রাপথে এক জন এক জন করে কৃষ্ণনাগরিক জড়ো হতে থাকেন। ক্রমশ বাড়তে থাকে মিছিলের দৈর্ঘ্য।

পোস্ট অফিস মোড়ে তত ক্ষণে ফুল হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন পরম্পরা নাট্যগোষ্ঠীর কয়েক জন সদস্য। কাচের গাড়ির ভিতরে শায়িত স্যরের পায়ে ফুল দিয়ে একে একে শেষ দেখা সেরে নেন তাঁরা।

এর পর শববাহী গাড়ি পাবলিক লাইব্রেরির সামনে দিয়ে এগিয়ে যায় ফোয়ারার মোড়ের দিকে। সঙ্গে ধ্বনিত হয় রবীন্দ্রসঙ্গীত। আলেখ্য স্টুডিয়োর সামনে এসে খানিক দাঁড়িয়ে যায় গাড়ি। বছর কয়েক আগেও এই আলেখ্য স্টুডিয়োয় এসে নিয়মিত আড্ডা দিতেন সুধীরবাবু। এর পর সেখান থেকে মরদেহ পৌঁছয় তাঁর কর্মক্ষেত্র কৃষ্ণনগর গভর্নমেন্ট কলেজে। সেখানে সামান্য কিছু সময় দাঁড়িয়ে শববাহী গাড়ি এগিয়ে যায় সামনের দিকে। এ বার একটু জোরেই ছোটে গাড়ি— নবদ্বীপ মহাশ্মশানের উদ্দেশে। পিছনে পড়ে থাকে তাঁর প্রিয় শহর। তখনও স্যরের জন্য চোখের জলে ভিজে তাঁর অনুরাগীরা গাইছেন— ‘আগুনের পরশমণি ছোঁয়াও প্রাণে।’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন