লড়াই ছিল দ্বিতীয় হওয়ার। না হতে পারলে এক বছর বাদে বিধানসভা ভোটে আরও অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যেত বামেরা। এই লড়াইতে জিতে পুরসভা দখল এবং ভোটের হারে বিজেপি ও কংগ্রেসকে পিছনে রেখে স্বস্তিতে বাম শিবির! মঙ্গল-সন্ধ্যায় যখন প্রবল বৃষ্টি নামল আলিমুদ্দিনে, তখন কিছুটা হলেও স্বস্তির মেজাজে বিমান বসু, সূর্যকান্ত মিশ্র, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যরা হিসাব করছিলেন, তাঁদের রক্তক্ষরণ বন্ধ হয়েছে কিনা। বামফ্রন্ট চেয়ারম্যান বিমানবাবু বলেন, ‘‘প্রাথমিক ভাবে দেখা যাচ্ছে, লোকসভার তুলনায় বামেদের ভোটের হার বেড়েছে। বিজেপির কমেছে।’’ এই হিসাবের ভিত্তিতেই খুশি বাম নেতৃত্ব। কারণ, ২০০৯ সালের লোকসভা নির্বাচন থেকে ক্রমাগত যে রক্তক্ষরণ হচ্ছিল, এই প্রথম তা বন্ধের লক্ষণ দেখা গেল।
গত বছরের লোকসভা ভোটের হিসাবে কলকাতার ১৪৪টি ওয়ার্ডের মধ্যে বামেরা এগিয়ে ছিল ১১টি ওয়ার্ডে। দ্বিতীয় স্থানে ছিল ৩৬টি ওয়ার্ডে। এ বারের ভোটে বামেরা পেয়েছে ১৫টি ওয়ার্ড। দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে ৫০টিরও বেশি ওয়ার্ডে। প্রায় দুই শতাংশ ভোটও বেড়েছে তাদের। লোকসভা ভোটে শিলিগুড়িতে মাত্র চারটি ওয়ার্ডে এগিয়ে ছিল বামেরা। এ বার প্রাক্তন পুরমন্ত্রী অশোক ভট্টাচার্যের নেতৃত্বে সেখানে ২৩টি ওয়ার্ড দখল করে পুরবোর্ড গঠনের পথে বামফ্রন্ট। ভোট বেড়েছে ৫%-এর বেশি। সমস্ত বিরোধী দলকে সঙ্গে নিয়ে শাসক দলের ভোট লুঠ বন্ধ করা, নিজের ভোট নিজে দেওয়া এবং বিগত তিন বছর ধরে লাগাতার রাস্তায় নেমে আন্দোলন করাই তাঁদের এই সাফল্যের কারণ বলে অশোকবাবু জানিয়েছেন। ঠিক যেমন ফরওয়ার্ড ব্লক নেতা উদয়ন গুহের নেতৃত্বে দিনহাটা পুরসভা বামেরা দখলে রেখেছে লোকসভার হিসাবকে পিছনে ফেলে। এ ক্ষেত্রেও জমি না ছেড়ে মাটি কামড়ে পড়ে থাকাই সাফল্যের কারণ বলে উদয়নবাবু জানিয়েছেন।
মুর্শিদাবাদের জিয়াগঞ্জ-আজিমগঞ্জ এবং জঙ্গিপুর পুরসভা বামেদের দখলে ছিল। এ বারও বামেরা তা দখলে রাখল। সেই সঙ্গে নদিয়ার তাহেরপুর এবং বর্ধমানের দাঁইহাট পুরসভা তৃণমূলের হাত থেকে ছিনিয়ে নিয়েছে বামেরা। অন্য দিকে, সোনামুখী এবং উত্তর দমদম পুরসভা বামেদের হাতছাড়া হয়েছে। দু’টি পুরসভাই তৃণমূল দখল করেছে। উত্তরবঙ্গের তুফানগঞ্জ, মাথাভাঙা, গঙ্গারামপুর পুরসভা বামেদের হাতছাড়া হলেও লোকসভা ভোটের নিরিখে এর কোনওটাই কিন্তু বামেদের হাতে ছিল না। সে দিক থেকে কেবল রক্তক্ষরণ বন্ধই নয়, বামেদের অগ্রগতিও ঘটেছে।
রাজ্যের ৯২টি পুরসভার মধ্যে ২৩টি উত্তর ২৪ পরগনা এবং ১১টি হুগলি জেলায়। উত্তর ২৪ পরগনায় ভোটের ফলাফলে বামেরা নিরাশ হলেও লোকসভার তুলনায় ফল খারাপ, তা মানতে নারাজ ভারপ্রাপ্ত জেলা সম্পাদক নেপালদেব ভট্টাচার্য। বারাসত, বসিরহাট, টাকি এবং অশোকনগর-কল্যাণগড়ের মতো গ্রামীণ এলাকায় বামেদের ফল লোকসভার তুলনায় ভাল হয়েছে। ব্যারাকপুর শিল্পাঞ্চলে অবশ্য তাদের ফলাফল ভাল হয়নি। কাঁচড়াপাড়া, হালিশহর, নৈহাটিতে বামেরা একটি ওয়ার্ডও জেতেনি! তবে ভোটের শতাংশে বামেরা বিজেপিকে পিছনে ফেলে এগিয়ে গিয়েছে বলে দাবি সিপিএম নেতৃত্বের। সব মিলিয়ে বামেরা যেখানে এই জেলার ৫৮৭টি ওয়ার্ডের মধ্যে ৬৩টি ওয়ার্ড জিতেছে, সেখানে বিজেপি জিতেছে ১৭টি এবং কংগ্রেস ১২টি।
প্রাক্তন মন্ত্রী গৌতম দেবের নেতৃত্বে জেলা সিপিএম বিগত তিন বছরে একাধিক বড় জমায়েত করছে কলকাতায়। তৃণমূলকে রুখে দেওয়া এবং সক্রিয়-প্রতিরোধেরও ডাকও দিয়েছেন জেলার সিপিএম নেতারা। রাজ্য সম্মেলনে এই জেলা থেকে একাধিক তরুণ নেতাকেও রাজ্য কমিটিতে নেওয়া হয়েছে।কিন্তু পঞ্চায়েত বা লোকসভা ভোটের মতোই পুরভোটেও তৃণমূলের কাছে গো-হারা হেরেছে বামেরা। কেন এই হার? ‘সন্ত্রাস’ দিয়ে তার ব্যাখ্যা দিচ্ছেন নেপালবাবুরা। কিন্তু যেখানে অশোকবাবু, উদয়নবাবুরা পারছেন, সেখানে তাঁরা কেন পারছেন না, এই প্রশ্নের উত্তর নেপালবাবুদের কাছে নেই।
আরামবাগ, তারকেশ্বরের মতো হুগলি জেলার শিল্পাঞ্চলের ৯টি পুরসভাও বিরোধী-শূন্য করার ডাক দিয়েছিল তৃণমূল। কিন্তু তা হয়নি। জেলা সম্পাদক সুদর্শন রায়চৌধুরীর কথায়, ‘‘ডানকুনি, রিষড়া, শ্রীরামপুর, ভদ্রেশ্বর সর্বত্রই লোকসভা ভোটের তুলনায় আমাদের ফল কিছুটা হলেও ভাল হয়েছে।’’ অর্থাৎ জয় নয়, রক্তক্ষরণ বন্ধ করাই বামেদের স্বস্তির কারণ। দক্ষিণ ২৪ পরগনার ক্ষেত্রেও একই কথা বলছেন সুজন চক্রবর্তী।
দিনের শেষে বিমানবাবুর কথায়, ‘‘মুখ্যমন্ত্রী আরামবাগের মতো বিরোধী শূন্য করার ডাক দিয়েছিলেন। নৈহাটি, কাঁথিতে তা হয়েছে। কিন্তু সর্বত্র তা হয়নি। যেখানে মানুষ প্রতিরোধ করেছে, সেখানে ফল ভাল হয়েছে।’’ দ্বিতীয় স্থান ধরে রেখে আগামী দিনে আরও ভাল করার আশাতেই বুক বাঁধছে আলিমুদ্দিন!