পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা সিপিএমের সাধারণ সভায় দীপক সরকার ও সূর্যকান্ত মিশ্র। শনিবার সৌমেশ্বর মণ্ডলের তোলা ছবি।
তিরের মতো ধেয়ে আসছিল প্রশ্নগুলো।
নারায়ণগড়ে সূর্যকান্ত মিশ্রকে দাঁড় করানোটা কি ঠিক হয়েছিল? কতটা ঠিক ছিল কংগ্রেসকে সঙ্গে নিয়ে পথ চলার সিদ্ধান্ত? নারদ-হাতিয়ার হাতে থাকা সত্ত্বেও কেন পথে নামছে না সিপিএম?
শনিবার বিকেল সাড়ে চারটে। মেদিনীপুরে তখন অঝোর বৃষ্টি। স্পোর্টস কমপ্লেক্সের সভাঘরে পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা সিপিএমের সাধারণ সভার শেষলগ্নে শুরু হয়েছে প্রশ্নোত্তর পর্ব। মঞ্চে কিছুটা কঠিন মুখে বসে সূর্যকান্ত মিশ্র, দীপক সরকার, তরুণ রায়রা। আর বন্ধ দরজার ভিতরে একের পর এক প্রশ্ন শানাচ্ছেন দলীয় সদস্যরাই।
বিধানসভা ভোটে ভরাডুবির পরে এ দিন প্রথম জেলায় পা রাখলেন সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক সূর্যবাবু। ভোটের পরে ইতিমধ্যে ১৪টি জেলায় দলের সাধারণ সভা সেরে ফেলেছেন। নিজের জেলায় ১৫তম সভার শুরুটা তাই নারায়ণগড়ের প্রাক্তন বিধায়ক করেছিলেন সাবলীল ভাবেই। চেনা ভঙ্গিমায় শোনাচ্ছিলেন দলের নীতি-আদর্শের কথা। বিড়ম্বনা বাড়ল একেবারে শেষবেলায়। সিপিএমের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য দীপক সরকার ঘোষণা করলেন, ‘পার্টি সদস্যদের কোনও প্রশ্ন থাকলে চিরকুটে লিখে জমা দিতে পারেন। রাজ্য সম্পাদক জবাব দেবেন’।
প্রশ্নের অভাব ছিল না। তাই জেলা সম্পাদক তরুণ রায়ের কাছে চিরকুট জমা পড়তে বিশেষ দেরি হয়নি। আর তার মধ্যে যে পাঁচটি বাছা হল, সবই মোক্ষম প্রশ্নবাণ।
প্রশ্নগুলো অচেনা নয়। গত ১৯ মে বিধানসভা ভোটের ফলপ্রকাশের পর থেকে বাসে-ট্রেনে, চা দোকানের জটলায় আকছার ঘুরপাক খাচ্ছে এমনই সব জিজ্ঞাসা। তবে এ দিন একেবারে দলের অভ্যন্তরীণ সভায়, দলীয় সদস্যদের থেকে এমন প্রশ্ন পেয়ে দৃশ্যতই অস্বস্তিতে পড়েন সিপিএম রাজ্য সম্পাদক। কারণ, সিপিএমের এই ধরনের সভায় এমন সোজাসাপ্টা প্রশ্নোত্তরের রেওয়াজ সচরাচর দেখা যায় না। ২০১১ সালে বিধানসভা ভোটের আগে যাদবপুরে প্রকাশ্য সভা শেষে আমজনতার প্রশ্নের মুখোমুখি হয়েছিলেন প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। সে বারও চিরকুট জমা নিয়েই বাছা হয়েছিল প্রশ্ন। তারপর থেকে গত পাঁচ বছরে আর সিপিএমের অন্দরে বা প্রকাশ্য সভায় এমন প্রশ্নোত্তর পর্ব হয়নি বললেই চলে।
তবে প্রাথমিক অস্বস্তি সামলে এ দিন সূর্যবাবু যে জবাব দেন তা বড্ড চেনা। প্রায় প্রতিটি প্রশ্নের উত্তরেই সিপিএমের রাজ্য সম্পাদককে বলতে শোনা গিয়েছে, “হ্যাঁ ঠিক ছিল, দলের সিদ্ধান্তকে মান্যতা দিতেই হয়।’’ ইউপিএ ২-এর সরকারের থেকে সমর্থন প্রত্যাহার ঠিক হয়েছিল কিনা বা জ্যোতি বসুকে প্রধানমন্ত্রী হতে না দেওয়ার সিদ্ধান্ত সঠিক ছিল কিনা প্রশ্নের জবাবেও সেই এক বুলি আওড়েছেন সূর্যবাবু।
রাজ্য সম্পাদকের বাঁধা গতের সেই জবাব যে দলীয় সদস্যদের মনপসন্দ হয়নি, তা বোঝা গেল সভা শেষের গুঞ্জনে। এক শাখা সম্পাদক বলছিলেন, ‘‘এমন দায়সারা জবাবের মানেটা কী! মানুষ কী চাইছেন বুঝতে গেলে তো এই সব প্রশ্নের মুখে দাঁড়াতেই হবে।’’ নারদ নিয়ে আন্দোলনের ব্যাপারে সূর্যবাবু যখন বললেন, ‘‘এখন আমাদের নজর ২ সেপ্টেম্বরের ধর্মঘটে। পরে নারদ নিয়ে নিশ্চয়ই পথে নামা হবে’, তখনও রীতিমতো বিরক্ত দেখায় দলের বেশ কিছু তরুণ-যুব কর্মীকে। তাঁদের একজনকে পরে বলতেও শোনা যায়, ‘‘পথে নামতে আর কত দেরি করবে দল। এ বার তো নারদ প্রসঙ্গ হিমঘরে চলে যাবে।’’ সিপিএমের অন্দরে এমন সওয়াল-জবাবের কথা জেনে বিঁধতে ছাড়ছেন না তৃণমূলের জেলা নেতৃত্বও। হাসতে হাসতে তৃণমূলের জেলা সভাপতি অজিত মাইতি বললেন, “ওদের দলটা কবে উঠে যাবে, সেই প্রশ্নটা কেউ করেনি? ওটাই তো এখন একমাত্র প্রশ্ন!”