মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। — ফাইল চিত্র।
মমতার কথায়, এসআইআর না করতে দিলে রাজ্যে রাষ্ট্রপতি শাসন জারি করত বিজেপি। তিনি বলেন, ‘‘এসআইআর নিয়ে ভয় পাবেন না। শুধু নিজেদের নথিগুলো জমা দিন। যদি এসআইআর না করতে দিতাম, তা হলে ভোট না করে ওরা রাষ্ট্রপতি শাসন জারি করত। বুঝেছেন অমিত শাহের চালাকি? আমরা অত বোকা নই বাবুমশাই, গোদিভাই! আমরা করব, লড়ব। আমরা জিতে দেখাব। আমাদের ভাতে মারা যাবে না। সম্পত্তি কেড়ে নেওয়া যাবে না।’’
মমতার কথায়, ‘‘ভাগ্যিস আমি বীরভূমে জন্মেছিলাম! নয়তো আমাকেও বাংলাদেশি বলত। শুনে রাখুন, বাংলায় এনআরসি করতে দেব না। আমার গলা কেটে দিলেও এখানে কোনও ডিটেনশন ক্যাম্প করতে দেব না, কাউকে তাড়াব না। রোহিঙ্গা বাংলায় কোথা থেকে আসবে? রোহিঙ্গা তো আসবে মণিপুর, মিজ়োরাম, ত্রিপুরা দিয়ে। সীমান্ত, আইটিবিপি, বিএসএফ, পাসপোর্ট, ভিসা— সবই তো কেন্দ্রের হাতে। এখন দোষ দিলে হবে?’’
মমতার কথায়, ‘‘কেউ কেউ সংখ্যালঘুদের বিভ্রান্ত করছে। বলছে ওয়াকফ নিয়ে আমরা নাকি কিছু করিনি। এটাও সম্পূর্ণ মিথ্যা কথা। আমরা বিধানসভায় কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে আইন পাশ করেছিলাম। বলেছিলাম জোর করে সম্পত্তি কাড়া যাবে না।’’
মমতা আরও বলেন, ‘‘গত কয়েক দিন ধরে কিছু দুষ্কৃতী গুজব রটাচ্ছে, রাজ্য সরকার কালেক্টরে খতিয়ান নম্বর ১ এ ধর্মীয় স্থানগুলো মসজিদ কবরস্থান হিসাবে নথিভুক্ত করা হয়েছে। মিথ্যে কথা। সব ধর্মেই কিছু গদ্দার থাকে, যারা বিজেপির টাকা খেয়ে মিথ্যা প্রচার করে। মনে রাখবেন এখন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বেরিয়ে গিয়েছে। আমার মুখে অন্যের কথা বসানো হচ্ছে। ওদের অনেক টাকা, নোটবন্দির টাকা, চুরির টাকা... সব টাকা দিয়ে বিদেশে গিয়ে একটা করে মালা পরে আসছে! অথচ মানুষের জন্য টাকা নেই। করে লুট, আর বলে ঝুট!’’
বিহার ভোটের উদাহরণ টেনে জগণের উদ্দেশে মমতা বলেন, ‘‘বিহারে চালাকি করে চারটে করে নির্দল প্রার্থী দাঁড় করিয়েছিল। নির্দলেরা ভোট কাটলে লোকসান আপনার। সুবিধা হবে বিজেপি-র।’’
মমতার কথায়, ‘‘প্রতি বছর ৬ ডিসেম্বর সম্প্রীতি দিবস পালিত হয়। সব ধর্মের মানুষ সেখানে অংশগ্রহণ করেন। সংখ্যাগুরুরা সংখ্যালঘুদের রক্ষা করবেন, এটাই তো নিয়ম। বাংলা সব ধর্মকে সম্মান করে। কিন্তু সাম্প্রদায়িক শক্তিকে মানবে না।’’ এর পর বিজেপির উদ্দেশে মমতা বলেন, ‘‘যাঁরা এসআইআর আবহে মারা গিয়েছেন, তাঁদের মধ্যে তো অর্ধেকের বেশি হিন্দুও রয়েছেন। যে গাছের ডালে বসেছেন, সেই ডাল কাটবেন না!’’
মমতা বলেন, ‘‘আমি এখনও নিজের নাম ভোটার তালিকায় তুলিনি। যত ক্ষণ না আপনাদের সকলের নাম উঠছে, তত ক্ষণ আমি নিজের নাম তুলব না। প্রতিটা বুথে বুথে ‘মে আই হেল্প ইউ’ ক্যাম্প করতে বলেছি, যাতে আপনাদের সুবিধা হয়। বিজেপি কান খুলে শুনে নাও, বাংলায় ডিটেনশন ক্যাম্প করতে দেব না।’’
মমতা আবারও বলেন, ‘‘বিজেপি বাংলাবিদ্বেষী। বাংলা ও বাঙালিকে নিশানা করছে ওরা। পরিযায়ী শ্রমিকদের উপর অত্যাচার হচ্ছে। কেউ বাংলায় কথা বললেই ভিন্রাজ্যে তাঁদের ‘বাংলাদেশি’ বলে দাগিয়ে দেওয়া হচ্ছে। সোনালি খাতুনের জন্য সুপ্রিম কোর্টে গিয়েছি। উনি গর্ভবতী মা। মামলা করে বলেছিলাম ফিরিয়ে আনতে হবে।’’
মমতা বলেন, ‘‘যে সব রাজ্যে বিজেপি ক্ষমতায় নেই, সেখানেই কেন ভোটের আগে এসআইআর হবে? অসম, ত্রিপুরায় বাংলাদেশের সীমান্ত নেই? সেখানে কেন এসআইআর হবে না? বিজেপি ক্ষমতায় আছে বলে?’’
মমতা ফের জানালেন, এসআইআর আবহে যে ৪০ জন মারা গিয়েছেন, তাঁদের দু’লক্ষ টাকা দেবে রাজ্য। যাঁরা অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে আছেন, তাঁদেরও এক লক্ষ টাকা করে সাহায্য দেওয়া হবে।
সাগরদিঘির নতুন ইউনিট থেকে বিদ্যুৎ সরবরাহ শুরু হবে আগামী ১০ ডিসেম্বর থেকে, বহরমপুর থেকে ঘোষণা করলেন মুখ্যমন্ত্রী। মমতা বলেন, ‘‘সাগরদিঘি তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রে ৬৬০ মেগাওয়াট সুপার ইউনিট পাওয়ার করেছি। এটা রাজ্যে সবচেয়ে বড়। ২০১৭ সালে ঘোষণা করেছিলাম, এখন সম্পূর্ণ হয়েছে। আগামী ১০ ডিসেম্বর থেকে এখান থেকে বিদ্যুৎ পাওয়া যাবে। ২৬ হাজার মানুষের কর্মসংস্থান হবে।’’
মমতা বলেন, ‘‘ফরাক্কায় আজও ড্রেজ়িং হয়নি। যার জন্য মানুষ ভুগছেন। মুর্শিদাবাদ ও মালদহ— দুই জেলাতেই আমরা নদী ভাঙন রোধের জন্য ১৫০০ কোটি টাকার পরিকল্পনা কেন্দ্রকে পাঠিয়েছি। কিন্তু এখনও কোনও উত্তর পাইনি। অথচ, ১০০ দিনের টাকা বন্ধ, জলের টাকা বন্ধ, বাংলার বাড়ির টাকা বন্ধ। তবু আমরা নিজেদের টাকায় ১৮৯টি কাজ সম্পন্ন করেছি। ১৩৬ কোটি টাকা ব্যয় করে নদীভাঙন রোধে ১৭টি প্রকল্প চালু হয়েছে। বরাদ্দ হয়েছে ২০০ কোটি টাকা।’’
সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে বার্তা দিলেন মুখ্যমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘‘মুর্শিদাবাদের ইতিহাস আমরা ভুলতে পারিনা। এখানে সিরাজউদ্দৌল্লা ঘরে ঘরে পূজিত হন। এই জেলা নবাবদের জেলা। সব ধর্মের তীর্থস্থান আছে এই জেলায়। পলাশিতে বাংলার সঙ্গে যুদ্ধ হয়েছিল। সিরাজউদ্দৌলা মিরজ়াফরের মাথায় মুকুট তুলে দিয়ে স্বাধীনতা রক্ষা করার কথা বলেছিলেন। কিন্তু মিরজ়াফর তা করতে দেননি। সিরাজকেই সকলে মনে রেখেছেন। মুর্শিদাবাদের মানুষ দাঙ্গার রাজনীতি মানবে না।’’
বেলা ১টা নাগাদ বহরমপুরে মুখ্যমন্ত্রীর জনসভা শুরু হল।
মালদহের সভা থেকে নির্বাচন কমিশনকেও আক্রমণ করেন মমতা। তিনি জানান, তাড়াহুড়ো করে এসআইআর চালু করা হয়েছে। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের বিরুদ্ধে চক্রান্তের অভিযোগ তোলেন তিনি। তাঁর কথায়, ‘‘এসআইআর করেছেন অমিত শাহ। চালাকির দ্বারা মহৎ কাজ হয় না।’’ রাজ্যবাসীকে আশ্বস্ত করে মুখ্যমন্ত্রী আরও বলেন, ‘‘কাউকে ডিটেনশন ক্যাম্পে যেতে হবে না। কারও নাম বাদ যাবে না। আপনারা ভয় পাবেন না।’’ ওয়াকফ আইন নিয়েও সকলকে অভয় দিয়ে মমতা জানান, কারও সম্পত্তিতে হাত দিতে দেওয়া হবে না।
সামনের বছরই রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচন রয়েছে। তবে মালদহের সভায় মমতা জানান, তিনি ভোট চাইতে আসেননি। এসেছেন মানুষের পাশে দাঁড়াতে। মমতা বলেন, ‘‘আমি ভোট চাইতে আসিনি। আপনাদের মনে যে দুশ্চিন্তা, সেই দুশ্চিন্তা দূর করতে এসেছি। আপনাদের পাশে দাঁড়াতে এসেছি। আমি সকলকে বলতে চাই, আপনারা নিশ্চিন্তে থাকুুন। কেউ ভয় পাবেন না।’’
বাংলার ভোটারদের অধিকার রক্ষার্থে বুধবার মালদহের গাজোলে সভা করেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সেই সভা থেকে ভোটার তালিকার বিশেষ নিবিড় সংশোধন (এসআইআর) নিয়ে সরব হন তিনি। বৃহস্পতিবার মুর্শিদাবাদে সভা রয়েছে তাঁর। মালদহের মতো মুর্শিদাবাদও সংখ্যালঘু অধ্যুষিত জেলা। ফলে এসআইআর পর্বে সেই জেলায় দাঁড়িয়ে মমতা কী বলেন, সেটাই দেখার।