অর্জুন ও মুঙ্গেরিলালের হাসিন সপনে

দিল্লি গিয়ে তৃণমূল ছেড়ে বিজেপি-তে যোগ দেওয়ার পর কয়েকদিন নিজের বিধানসভা কেন্দ্র ভাটপাড়ায় ঢুকতেই পারেননি তিনি। তৃণমূল বলেছে, জনরোষ।

Advertisement

সুব্রত বসু 

কলকাতা শেষ আপডেট: ০৪ মে ২০১৯ ০৪:১৯
Share:

পরনে ধপধপে সাদা শার্ট, ট্রাউজার্স। পায়ে স্নিকার্স। কব্জিতে এক গোছা তাগা, আঙুলে আংটি। পাশে কালো পোশাকের জনা ছ’য়েক সরকারি রক্ষী। হাতে অ্যাসল্ট-রাইফেল, ওয়াকি-টকি। সাদা-কালোর জবরদস্ত কনট্রাস্ট।

Advertisement

দিল্লি গিয়ে তৃণমূল ছেড়ে বিজেপি-তে যোগ দেওয়ার পর কয়েকদিন নিজের বিধানসভা কেন্দ্র ভাটপাড়ায় ঢুকতেই পারেননি তিনি। তৃণমূল বলেছে, জনরোষ। এর পরেই হাতছাড়া হয়েছে ভাটপাড়া পুরসভার চেয়ারম্যানের পদ। সঙ্গীদের অনেকেই পাশে নেই। তবু, তিনি অর্জুন। ব্যারাকপুর লোকসভা কেন্দ্রের সর্বত্রই দেওয়াল জুড়ে রয়েছেন অর্জুন সিংহ।

দেওয়ালে, ফ্লেক্সে আছেন বটে। কিন্তু নেই সেই আগের দাপট। কারণ, ঘাসফুলের পাল্টা ঘায়ের পাশপাশি কমলের কাঁটাতেও অনেকটাই বিধ্বস্ত তিনি। বিজেপি-র অন্দরে কান পাতলেই শোনা যাচ্ছে, ‘যে অর্জুন কয়েকদিন আগেই মেরে আমাদের মাথা ফাটিয়ে দিল, আজ তাঁর হয়ে ভোট চাইতে গলা ফাটাব!’ কেউ বলছেন, ‘দলে কি আর কোনও নেতা ছিল না যে ওর মতো মাফিয়া-তোলাবাজকে টিকিট দিতে হল?’ অনেকে বলেছেন, ‘‘একা অর্জুনে রক্ষা নেই, ছেলে পবনও বিজেপিতে যোগ না দিয়েই ভাটপাড়া বিধানসভা কেন্দ্রের প্রার্থী হয়ে গেল!’’ ২৪টি অপরাধের মামলায় অভিযুক্ত চৌকিদারের ‘প্রোফাইল’ নিয়ে ধন্ধে পড়ে বিজেপির পুরনো নেতা-কর্মীদের একাংশ বসে গিয়েছেন। অনেকেই আবার দল পাল্টে চলে গিয়েছেন তৃণমূলেই। যাঁরা কাজ করছেন, তাঁরাও যে তাঁকে জেতাতে জানপ্রাণ লড়িয়ে দেবেন, এমন দাবি করছেন না অর্জুনের অতিবড় সমর্থকও।

Advertisement

দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯

যেমন, রবিবার বিকেলের ভরা প্রচারের সময়ে ব্যারাকপুরের নিজের বাড়িতে বসে রয়েছেন বিজেপির রাজ্য কমিটির সদস্য অহীন্দ্র বসু। বাড়ির কয়েক কদম দূরে বিজেপি প্রার্থী অর্জুন সিংহের সমর্থনে সভা করছে একদল যুবক। সেখানে তিনি নেই। কেন?

প্রবীণ অহীন্দ্র এলাকায় আপাদমস্তক ভদ্রলোক বলে পরিচিত। কর্মী-সমর্থকদের ক্ষোভ সামলাতে হিমসিম খেতে হচ্ছে তাঁকে। এ কথা প্রকাশ্যে স্বীকারও করছেন। অহীন্দ্রর তীর্যক বক্তব্য, ‘‘আসলে আমাদের এখন যে ভাবেই হোক, সাংসদের সংখ্যা বাড়াতে হবে। তাতে কাকে প্রার্থী করা হল, কিছু যায়-আসে না!’’ প্রচারে আপনার মতো নেতারা সে ভাবে নেই কেন? অহীন্দ্রর সাফাই, ‘‘আমরাই তো দলের লোককে বোঝাচ্ছি, যাতে সবাই ওঁকে সাহায্য করেন।’’ কী বলছেন কর্মীদের? ‘‘বলছি, দল মনে করছে, তোলাবাজি বন্ধ করার একটাই উপায়। ওকে দিয়েই শিল্পাঞ্চলে তোলাবাজি বন্ধ করে দেব আমরা।’’— বললেন অহীন্দ্র।

গত লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি এই কেন্দ্রে ২২ শতাংশ ভোট পেয়ে তিন নম্বরে ছিল। জেলার বিজেপি নেতারা এ বার এখানে ভাল ফলই আশা করেছিলেন। হালিশহরের বাসিন্দা নৈহাটির হুকুমচাঁদ জুটমিলের কর্মী কমলেশ পাণ্ডে বলছিলেন, ‘‘ইস্ বার বিজেপি কা মাহল থোড়া অলগ থা। লেকিন সব মুঙ্গেরিলাল কে হাসিন সপনে বন্‌ গ্যায়া!’’

ব্যারাকপুরে বিজেপির প্রথম লড়াইটা তাই অর্জুন বনাম অর্জুনের ভাবমূর্তির। এ নিয়ে কী বলছেন সাদা পোশাকের ছোটখাটো চেহারারা মানুষটি? নাকের ডগায় ওড়া মাছি তাড়ানোর ভঙ্গিতে হাত নেড়ে অর্জুনের উত্তর, ‘‘ও জবাব মানুষ দিয়ে দেবে। আমি কিছু বলব না।’’ তা হলে কী বলছেন? অর্জুনের জবাব,‘‘বলছি, দিদি দেশবিরোধী, সেনাবিরোধী। আর বলছি, তৃণমূল তো তোলাবাজদের দল।’’ এত দিন তো এ সব বলেননি? অর্জুনের শাস্ত্রীয় উত্তর, ‘‘মহাভারতের ভীষ্ম দুর্যোধনের দলে থেকে তাঁদের বিরুদ্ধে কিছু বলতে পেরেছিলেন? আমিও তাই। এখন তৃণমূল থেকে বেরিয়ে গেছি, তাই বলছি।’’ একটু থেমে বলেন, ‘‘এই অর্জুন ছাড়া তৃণমূল এখানে দাঁড়াতে পারত? সেই আমাকেই কিনা তিন মাস আগে জেলে ঢোকানোর প্ল্যান হয়েছিল। ৪০ সাল রাজনীতি করছি। সব খবর আগেই ঠিক পেয়ে গেলাম।’’

অর্জুনের ভাবমূর্তিই বড় হাতিয়ার প্রতিপক্ষদেরও। ব্যারাকপুর থেকে দু’বারের সাংসদ দীনেশ ত্রিবেদী গতবার জিতেছিলেন ২ লক্ষ ৬ হাজার ভোটের ব্যবধানে (প্রাপ্ত ভোট ৪৬ শতাংশ)। ৭টি বিধানসভার মধ্যে একমাত্র অর্জুনের ভাটপাড়া বিধানসভা থেকেই তিনি ‘লিড’ পাননি। বিজেপি-র থেকে পিছিয়ে ছিলেন ২ হাজার ভোটে। কেন? দীনেশের সাফ জবাব, ‘‘অন্তর্ঘাত। ও আমাকে আগের বারও হারানোর চেষ্টা করেছিল। তবে রাজনীতিতে মাফিয়ারা থাকুক, এটা মানুষ চায় না।’’ দীনেশের আক্ষেপ, ‘‘বিজেপি এখানে আমার বিরুদ্ধে এক জন ভদ্রলোককে প্রার্থী করতে পারল না! যাঁর নামে এত অপরাধের মামলা, তাঁকেই এখানে দাঁড় করিয়ে দিল।’’

আক্ষেপ থাকতেই পারে। তবে অর্জুন প্রার্থী হওয়ায় বাড়তি লাভ হয়েছে দীনেশের। পঞ্চায়েত ভোটে এলাকায় সন্ত্রাস, তোলাবাজি-সহ তাঁদের বিরুদ্ধে ওঠা যাবতীয় অভিযোগকে ‘অর্জুনের কীর্তি’ বলেই দায় ঝেড়ে ফেলতে সুবিধা হচ্ছে তৃণমূলের। দোরে দোরে কড়া নেড়ে অর্জুনের কৃতকর্মের জন্য দুঃখপ্রকাশও করছে। তাতে কাজ কি কিছু হচ্ছে? তৃণমূল শিবিরের আশা, দীনেশের স্বচ্ছ ভাবমূর্তি এবং সর্বভারতীয় পরিচিতিই ভোটবাক্স ভরাবে। দীনেশেরও বক্তব্য, ‘‘এখানে আমিই জিতব। দুই-এ থাকবে সিপিএম। বিজেপি তিনে।’’

আশ্চর্য সমাপতন! কয়েক ঘণ্টা আগে অর্জুনও বলছিলেন, ‘‘আমার পরে থাকবে সিপিএম। তৃণমূল তিন-এ।’’

গত নির্বাচনে ৩ শতাংশেরও কম ভোট পাওয়া কংগ্রেসের এ বারের প্রার্থী মহম্মদ আলমকে বিশেষ আমল দিচ্ছেন না কেউই। তবে দু’পক্ষই মানছেন, এ বারের লড়াইয়ে প্রবল ভাবেই আছেন সিপিএমের গার্গী চট্টোপাধ্যায়। এলাকায় চরকি-পাক লাগিয়ে কপালের ঘাম মুছে গার্গী বললেন, ‘‘এখানে এখন কে তৃণমূল, আর কে বিজেপি— মানুষ বুঝতেই পারছে‌ন না। ওরা নিজেরাই মারামারি করছে, রক্ত ঝরাচ্ছে। প্রচুর টাকা ছড়ানো হচ্ছে। আমরাই মানুষের সঙ্গে আছি, এটা সবাই এখন বেশি করে টের পাচ্ছেন।’’ গার্গীর দাবি, ‘‘ওদের দু’দলের গোলমাল ঠেকাতে ১০০ শতাংশ বুথে কেন্দ্রীয় বাহিনী রাখতে হবে। নইলে গোলমালের আশঙ্কা থাকছেই।’’

হালিশহরের রামপ্রসাদের ভিটের কাছে বারেন্দ্র গলির বাসিন্দা সাত বছরের সায়ন্তিকারও একই আশঙ্কা। তিন বছর আগের বিধানসভা ভোটের আগের রাতে তার সামনেই দফায় দফায় মারধর করা হয়েছিল মা দেবশ্রী ঘোষ-সহ পরিবারের সকলকে। বাদ পড়েনি ছোট্ট সায়ন্তিকাও। এই নিয়ে শোরগোল হয়েছিল রাজ্যজুড়ে। দেবশ্রীর অভিযোগ ছিল এলাকার তৎকালীন তৃণমূল নেতা রাজা দত্তের বিরুদ্ধে। অর্জুনের সঙ্গে রাজা দত্তও এখন বিজেপিতে। তাই আতঙ্ক বেড়েছে দেবশ্রীর। মায়ের কোল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে ছোট্ট সায়ন্তিকা বলছে, ‘‘ওরা আমাদের খুব মেরেছিল। তা-ও মা পরদিন ভোট দিতে গেল। আমি খুব ভয় পেয়েছিলাম। আবার এমন হবে না তো?’’

প্রশ্নটা বড্ড বেশি ঘুরছে বিটি রোডের ধারের শিল্পাঞ্চল জুড়ে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন