লোকসভায় তৃণমূলের আসন সংখ্যা বেশ কিছু কমতে চলেছে বলে বিভিন্ন বুথ-ফেরত সমীক্ষায় ইঙ্গিত মিলেছে। রাজ্যে বিজেপির আসন যথেষ্ট বৃদ্ধির লক্ষণও সেখানে স্পষ্ট। গত বারের থেকেও কমতে পারে কংগ্রেসের আসন। বাম সম্ভবত একটিও পাবে না।
মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় অবশ্য এই সব সমীক্ষাকে নস্যাৎ করে বলেন, ‘‘মিথ্যাকে সত্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে এবং বিরোধী-জোট যাতে সক্রিয় হতে না পারে, সে জন্য এই ধরনের গুজব ছড়ানো হচ্ছে। বিজেপি হারছেই।’’ বিজেপির রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ বলেন, ‘‘আমার যেমন বলেছিলাম বুথ-ফেরত সমীক্ষায় তারই ইঙ্গিত মিলছে। আসল ফল আরও ভাল হবে।’’
অন্য দিকে, কার্যত মমতার সুরেই আর কংগ্রেসের প্রদীপ ভট্টাচার্য বলেন, ‘‘বিরোধী ঐক্য যাতে দানা না বাঁধতে পারে, তার জন্যই সমীক্ষার ফল এই রকম।’’ সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক সূর্যকান্ত মিশ্র বলেন, ‘‘বুথ ফেরত সমীক্ষা নিয়ে ভাবার দরকার নেই। আসল গণনার দিকে মন দিয়ে শেষ পর্যন্ত লড়তে হবে।’’
রবিবার শেষ পর্বের ভোট মেটার পরেই বিভিন্ন সংস্থার বুথ-ফেরত সমীক্ষার ফলাফল সামনে আসে। তার সব কটিতেই দেখা যায় তৃণমূল তার গতবারের ৩৪ টি আসন ধরে রাখতে পারছে না। এবিপি আনন্দ-নিয়েলসেন-এর সমীক্ষা অনুযায়ী, তৃণমূল পেতে পারে ২৪টি আসন। বিজেপি ১৬ টি। কংগ্রেস গতবারের চারটি আসন থেকে কমে দুটি আসন পেতে পারে। তবে বামকে এই সমীক্ষা একটি আসনও দেয়নি।
এই ধরনের সমীক্ষা অবশ্য কখনওই শেষ কথা বলে না। বহু সময়ে বাস্তব ফল যে সমীক্ষার সঙ্গে মেলে না, তা-ও প্রমাণিত। যেমন ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের বুথ ফেরত সমীক্ষায় তৃণমূল ২৪টি আসন পেতে পারে বলে এবিপি আনন্দ-নিয়েলসেনের সমীক্ষআয় ইঙ্গিত ছিল। বাস্তবে তা দাঁড়ায় ৩৪টিতে। ওই সমীক্ষা বামেদের দিয়েছিল ১২টি আসন। শেষ পর্যন্ত সিপিএম মাত্র ২টি আসনে জেতে। তবু, সাধারণ প্রবণতা হিসেবে এই ধরনের সমীক্ষা স্বীকৃত। তারই ভিত্তিতে এ বারের ফলাফলের আগাম আভাস।
রাজ্যের ৪২ টি আসনের মধ্যে নিয়েলসেনের সমীক্ষা অনুযায়ী বিজেপির যে ১৬ টি আসনে জেতার সম্ভাবনা তার মধ্যে একমাত্র দার্জিলিং গতবারও তাদের হাতে ছিল। তবে গতবার জেতা আসানসোল আসনটি এবার তাদের হাতছাড়া হতে পারে বলে সমীক্ষার ইঙ্গিত। ওই আসনে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী বাবুল সুপ্রিয়কে হারিয়ে জেতার সম্ভাবনা তৃণমূলের মুনমুন সেনের। আবার মুনমুন গতবার যে আসন থেকে জিতেছিলেন সেই বাঁকুড়ায় এবার তৃণমূলের হেভিওয়েট প্রার্থী তথা রাজ্যের মন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায় বিজেপির কাছে হেরে যেতে পারেন, বলছে সমীক্ষা।
মালদহ উত্তরের দু’বারের কংগ্রেস সাংসদ মৌসম বেনজির নূর তৃণমূলে যোগ দিয়ে প্রার্থী হয়েছেন। সমীক্ষা তাঁর পরাজয়ের সম্ভাবনা দেখেছে। ওই কেন্দ্রে বিজেপি জিততে পারে বলে সমীক্ষা জানিয়েছে। যদি তা হয় তাহলে এই কেন্দ্র এবার মালদহের অবিসংবাদী কংগ্রেস নেতা বরকত গণি খানের পরিবারের হাতছাড়া হবে। কারণ মৌসম ছিলেন তাঁর বোনের মেয়ে। আর কংগ্রেস এবার প্রার্থী করেছে গণিখানের ভাইপো ঈশা খান চৌধুরীকে। সমীক্ষা অবশ্য এ বারেও মালদহ দক্ষিণে আবু হাসেম খান চৌধুরীর জয়ের সম্ভাবনা দেখেছে। একই ভাবে কংগ্রেসের জয়ের ইঙ্গিত বহরমপুরে অধীর চৌধুরীর ক্ষেত্রেও।
ভোটের আগেই তৃণমূল ছেড়ে বিজেপিতে গিয়ে যাঁরা প্রার্থী হয়েছেন, তাঁদের মধ্যে একমাত্র বিষ্ণপুরের সৌমিত্র খাঁ জিততে পারেন বলে সমীক্ষা আভাস দিয়েছে। মেদিনীপুরে জয়ের সম্ভাবনা বিজেপির রাজ্য সভাপতি তথা বিধায়ক দিলীপ ঘোষেরও। হুগলিতে জিততে পারেন লকেট চট্টোপাধ্যায়। তবে ভোট ঘোষণার পরেই তৃণমূল ছেড়ে বিজেপিতে গিয়ে প্রার্থী হলেও ব্যারাকপুরে বাহুবলী অর্জুন সিংহ জিততে পারবেন না বলে সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে। একই ভাবে দল বদলে কোচবিহারের বিজেপি প্রার্থী অবশ্য জিতে যেতে পারেন।
তৃণমূলের সম্ভাব্য পরাজয়ের তালিকায় উল্লেখযোগ্য বালুরঘাট। অর্পিতা ঘোষের জয়ের সম্ভাবনা দেখছে না সমীক্ষা। ঝাড়গ্রাম, পুরুলিয়া, হাওড়া, আরামবাগ, রানাঘাট, বর্ধমান পূর্বও তাদের হাত ছাড়া হতে পারে। আবার হাতে আসতে পারে রায়গঞ্জ। যেখানে আগে জিতেছে কংগ্রেস, গতবার সিপিএম। এমনকি, জঙ্গিপুরও এ বার কংগ্রেসের থেকে ছিনিয়ে নিতে পারে তৃণমূল। আগে এই কেন্দ্র ছিল প্রণব মুখোপাধ্যায়ের, এখন তাঁর ছেলে অভিজিতের।
এবিপি আনন্দ-নিয়েলসেনের মতোই প্রবণতা অন্যান্য সমীক্ষাতেও। রিপাবলিক-সি ভোটার তৃণমূলকে ২৯টি আসন দিলেও তাদেরই হিন্দি চ্যানেলের করানো সমীক্ষায় আবার তৃণমূলের প্রাপ্তি ১৩ থেকে ২১। টাইমস নাউ-ভিএমআরের সমীক্ষায় তৃণমূলকে ২৮টি আসন দেওয়া হয়েছে। ইন্ডিয়া নিউজ-পোলস্ট্র্যাট মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দলকে দিয়েছে ২৬টি আসন।
সমীক্ষার সামগ্রিক ফলাফল সম্পর্কে মমতা বলেন, ‘‘এটা নরেন্দ্র মোদীর গেমপ্ল্যান। ইভিএম বদলের জন্য বিজেপির ষড়যন্ত্র। নিফটির টাকা কেউ না কেউ ছড়িয়েছে প্রচারে। এটা অনেকেই জানেন। আগামী কাল যাতে শেয়ার বাজার চাঙ্গা হতে পারে, সে জন্য এ ধরনের সমীক্ষা-রিপোর্ট দেওয়া হয়েছে। সব ক’টি সংবাদমাধ্যমই মোদীর দালালি করেছে। তাই একেবারে মিথ্যা এই বুথ ফেরত সমীক্ষা। এ সব আমি বিশ্বাস করি না।’’ আঞ্চলিক দলগুলির নেতারাও এই সমীক্ষা বিশ্বাস করছেন না বলে দাবি করে মমতা বলেন, ‘‘আমার অন্যান্য দলের চার-পাঁচ জনের সঙ্গেও কথা হয়েছে। সকলেই মনে করছেন এটা ভুয়ো।’’ প্রশাসনকে চাপ দিয়ে ইভিএম বদলে দেওয়ার চেষ্টা করা হবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন মমতা। তাঁর আবেদন, ‘‘সকলকে বলব ইভিএম পাহারা দিন। যাতে একটিও ইভিএম বদল না হয়।’’
এ দিন শেষ দফা ভোট মিটতেই শরদ পওয়ার, চন্দ্রবাবু নায়ডু এবং অহমেদ পটেলের সঙ্গে ফোনে মমতার কথা হয়। ইভিএম কারচুপির আশঙ্কা জানিয়ে তিনি এসএমএস পাঠান রাহুল গাঁধীকেও। পরে তৃণমূলনেত্রী বলেন, আজ, সোমবার চন্দ্রবাবু ফের কলকাতায় এসে তাঁর সঙ্গে দেখআ করতে পারেন। মমতার কথায়, ‘‘এই কারচুপির খেলা এবং ভোট জালিয়াতির চক্রান্ত কিছুতেই মানা হবে না। বিরোধীদের একজোট হয়ে এর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে। দরকারে রাষ্ট্রপতির কাছে যাওয়া হবে, আইনের আশ্রয় নেওয়া হবে।’’
গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।