পাহাড়ের চোখ সমতলে

সেই বিমল গুরুং আর নেই পাহাড়ে। গত দেড় বছর ধরে দূরে থেকে থেকে তিনি কি ফিকে হয়ে গিয়েছেন কিছুটা?

Advertisement

দেবাশিস চৌধুরী

কলকাতা শেষ আপডেট: ১৩ এপ্রিল ২০১৯ ০২:১৯
Share:

—ফাইল চিত্র।

সিংমারি অবধি পৌঁছনোর দরকার হত না। ভোটের সময়ে এলে অন্তত আধ কিলোমিটার আগে থেকে আকাশ ঢেকে যেত হলুদ-সবুজ পতাকায়। নর্থ পয়েন্ট স্কুলের উল্টো দিকের বহুতলের উপরের তলায় তখন প্রচণ্ড কর্মব্যস্ততা। আর তিনি? মাঝে মাঝে ব্যালকনিতে এসে দাঁড়িয়ে দেখা দিচ্ছেন।

Advertisement

সেই বিমল গুরুং আর নেই পাহাড়ে। গত দেড় বছর ধরে দূরে থেকে থেকে তিনি কি ফিকে হয়ে গিয়েছেন কিছুটা? না হলে ভোটের আগের দিন দার্জিলিঙে ফিরতে এত মরিয়া কেন? সেই মামলার শুনানি রয়েছে হাইকোর্টের সার্কিট বেঞ্চে আগামী ১৬ এপ্রিল। ফেরা তাই এখনও ভবিষ্যতের গর্ভে। তবু তাঁর ছায়া রয়ে গিয়েছে। বিনয় তামাংরা মুখে যা-ই বলুন, তাঁদের লড়াই (এখনও অবধি) ওই ছায়াকে হারানোর।

কিন্তু ছায়াকে মানতে আর কে চায়? এক সময়ে বিমল গুরুংয়ের সংগঠন সামলাতেন বিনয়। এখন সেই সংগঠনকে কাজে লাগাতে চাইছেন তৃণমূল প্রার্থী অমর সিংহ রাইয়ের জন্য। কিন্তু ফসল উঠবে কি? বিনয় বলেন, ‘‘বিমলপন্থীদের যদি এতই ক্ষমতা, তা হলে বিজেপি প্রার্থী রাজু বিস্তার সঙ্গে তাদের লোক এত কম কেন?’’ আর বিমল? হিসেবের কাগজপত্র সামনে রেখে বিনয় বলছেন, ‘‘২৩ মে (ভোটগণনার দিন) ওঁর অ্যাসিড টেস্ট।’’

Advertisement

দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯

রাজভবনের কাছে একটি হোটেলে বিনয়ের ওয়্যার রুম। ভোট ১৮ এপ্রিল। তার আগে এলাকাভিত্তিক ছোট ছোট বৈঠক, সেই সব এলাকায় আবার রিভিউ বৈঠক করে চলেছেন তিনি। বলছেন, ‘‘ফিডব্যাক শুনে সব ঠিক করে নিচ্ছি।’’ ভোটের দিন কোনও হোটেলে ঘর খালি নেই, জানেন? শুনে মুচকি হাসলেন। বিনয়ের কথায়, পাহাড়ে শান্তি এসেছে। এই ঘটনা সেটাই প্রমাণ করে।

কিন্তু ভোটের দিনও পর্যটকেরা ভয় পাবেন না? সরকারি একটি হোটেলের ম্যানেজার বলেন, ‘‘মনে হচ্ছে, পাবেন না। কোনও ঘর খালি নেই।’’ একই অবস্থা বহু বেসরকারি হোটেলেরও। বস্তুত, এপ্রিলের গোড়া থেকেই যেন মরসুম শুরু হয়ে গিয়েছে। শিলাবৃষ্টি থেকে কনকনে ঠান্ডা, কিছুকেই পাত্তা না দিয়ে সংস্কারের জন্য আধ খোঁড়া ম্যালে ভিড় জমিয়েছে লোকজন। ম্যালের ধারে দোকান দিয়েছেন মিনা রাই। হাঁফ ফেলার বিশেষ ফুরসত পাচ্ছেন না। তার মধ্যেই বললেন, ‘‘হ্যাঁ, গোলমাল নেই এখন।’’

রাজনৈতিক লড়াইয়ে এই শান্তিকেই সব থেকে বড় অস্ত্র করছে তৃণমূল। পাহাড়ে এল বি রাইয়ের মতো তৃণমূল নেতারা বলছেন, ‘‘শান্তি আছে বলেই উন্নয়ন সম্ভব হচ্ছে। সেটাই আমরা মানুষকে বোঝাচ্ছি।’’ কালিম্পং, কার্শিয়াং বা মিরিকেও একই ছবি। দেড় বছর আগে যে ১০৫ দিন টানা বন্‌ধে পুড়েছিল গাড়ি, সোনাদা স্টেশন বা কার্শিয়াং স্টুরিস্ট লজের ঘর, তা এখন পোড়া স্মৃতি হয়েই রয়ে গিয়েছে। সিংমারিতে মোর্চার পুরনো অফিসে যেমন লোক নেই। তেমনই সুনসান সেখান থেকে গুরুংয়ের বাড়ি পাতলেবাস যাওয়ার রাস্তাও। ওই পোড়া গাড়িগুলো শুধু ২০১৭ সালের ১৭ জুনের কথা মনে পড়িয়ে দেয়।

‘‘ওই সব পোড়া গাড়িও শীতে জবুথবু। বিমল এলেও তাতে উত্তাপ লাগবে না,’’ বলছিলেন এক বোর্ডের প্রধান। শান্তিকে দীর্ঘমেয়াদি করতে এই বোর্ডগুলিকে কাজে লাগিয়ে পাহাড়ে উন্নয়ন করতে চাইছে রাজ্য সরকার। তাঁদেরই কেউ কেউ বলছেন, তাঁরা তৃণমূল প্রার্থী অমর সিংহ রাইয়ের দিকে থাকবেন।

কিন্তু সবাই কি এই ‘ভাগাভাগি’ ঠিক ভাবে নিয়েছে? লামাহাটার গাড়িচালক দাওয়া রাস্তায় দাঁড়িয়েই এর প্রবল প্রতিবাদ করেন। বলেন, ‘‘কলকাতায় যদি বন্দ্যোপাধ্যায় বোর্ড, চট্টোপাধ্যায় বোর্ড তৈরি হয়, আপনারা মেনে নেবেন?’’ দাওয়া কিন্তু সকলেরই বিরোধী। তাঁর সাফ কথা, ‘‘বিজেপি, তৃণমূল, কংগ্রেস— কেউ কাজ করেনি। কেউ কথা রাখেনি।’’ আর এই বিরুদ্ধে হাওয়াটাকেই বাঁচিয়ে রেখে তৃণমূলকে মাত করে দিতে চাইছে জিএনএলএফ এবং গুরুংপন্থীরা।

শুধু এই দিয়েই কি অমর রাইকে আটকানো সম্ভব? তৃণমূলের পাহাড়ের লোকজন বলছেন, লড়াইটা তো শুধু শান্তি আর উন্নয়নে আটকে নেই। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় পুরো বিষয়টিকে রাজনৈতিক জমি দখলের যুদ্ধে নিয়ে গিয়েছেন। তাই চকবাজারে তাঁর সভায় ভিড় উপচে পড়ে। আর তাই গোর্খাল্যান্ডের থেকে গুরুত্ব দিয়ে পাহাড়ে জমি পাট্টা দেওয়ার বিষয়টিকে প্রচারে নিয়ে আসেন বিনয়রা।

গোর্খাল্যান্ড কি হবে? গুরুং জমানা দেখার পরে পাহাড়ের অনেকেই এখন মানছেন, এখনই কিছু হচ্ছে না। তবু কোথাও কোথাও স্লোগানে বেঁচে আছে পৃথক রাজ্য। বেঁচে আছে মানুষের অন্তরেও। এমনকি বিজেপি প্রার্থী রাজু বিস্তাও বলছেন, ‘‘বিজেপি ছোট রাজ্যের পক্ষে ঠিকই, কিন্তু শিলিগুড়ির ‘চিকেনস নেক’ একাধিক দেশের সীমান্ত দিয়ে ঘেরা। এখানে কোনও সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে জাতীয় নিরাপত্তার বিষয়টি মাথায় রাখতে হবে।’’ তাই বিজেপির ইস্তাহারেও নেই পৃথক রাজ্যের প্রসঙ্গ।

বিমল গুরুং এবং গোর্খাল্যান্ড— দুই বিষয়কে আপাত ভাবে পাহাড়ের আড়ালে রাখলেও তৃণমূল এখনও পুরোপুরি নিশ্চিত নয়। তাই বিনয় জানতে চান, সমতল থেকে কত লিড পাওয়া যাবে। তাই মমতা চোপড়ার সভায় দাঁড়িয়ে ডাক দেন, ‘‘আপনারা আমাদের জিতিয়ে দিন।’’

তরাই অঞ্চলেও কিন্তু জিএনএলএফ বা গুরুংয়ের প্রভাব কম ছিল না এত দিন। শিলিগুড়ি, মাটিগাড়া-নকশালবাড়ি, ফাঁসিদেওয়া— এই তিন কেন্দ্রে তাই বাম, কংগ্রেস, বিজেপি আর তৃণমূলে ভোট ভাগাভাগি হবে বলেই ধরে নিচ্ছেন স্থানীয়রা।

বাকি রইল চোপড়া, যেখানে গত বিধানসভা ভোটেও ১৬ হাজারের বেশি ভোটে জিতেছিল তৃণমূল। এ বার বিধায়ক হামিদুল রহমানের বিরুদ্ধে এর মধ্যেই সন্ত্রাসের অভিযোগ এনেছেন কংগ্রেস কার্যালয়ে শুকনো মুখে বসে থাকা ব্লক সভাপতি অশোক রায় থেকে বিজেপির জেলা সম্পাদক সুবোধ সরকার। কিন্তু হামিদুল সে সব উড়িয়ে বলছেন, ‘‘দিদিকে কথা দিয়েছি, এ বারে চোপড়াই কথা রাখবে!’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন