West Bengal News

দুপুরে শিলিগুড়ি বিকেলে ব্রিগেড, ‘পিসি-ভাইপো’কে নিশানা করে প্রচারে শান দিলেন মোদী

‘‘আপনারা কেমন আছেন’’, ভাঙা ভাঙা বাংলায় শুরু করলেন মোদী, ‘‘আপনারা সবাই ভাল নাকি? মা কালীর আশীর্বাদ এবং রামকৃষ্ণ পরমহংসের নাম স্মরণ করে আপনার সবার সামনে পৌঁছেছি।’’

Advertisement

নিজস্ব প্রতিবেদন

কলকাতা শেষ আপডেট: ০৩ এপ্রিল ২০১৯ ১৪:৫৪
Share:

বির্গেডের সভায় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। ছবি: পিটিআই

শিলিগুড়িতে যে ভাবে তোপ দেগেছিলেন, ৫৫০ কিলোমিটার দূরে কলকাতায় এসে সেই জোশ যেন উধাও। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তথা তৃণমূলের বিরুদ্ধে সাকুল্যে বললেন কার্যত তিনটি বাক্য। বাকিটা নিজের সরকারের ঢাক পেটানো আর কংগ্রেসকে নিশানা করেই ফিরে গেলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। বালাকোট নিয়ে প্রশ্ন তোলায় মমতার সমালোচনা, পরিবারতন্ত্র নিয়ে মমতা-অভিষেককে কটাক্ষ, আর বাম-তৃণমূলকে এক পংক্তিতে বসিয়ে অস্ত্রের সংস্কৃতি নিয়ে খোঁচা। কিন্তু তাতেও এক বারের জন্যও মমতার নামোল্লেখ করলেন না প্রধানমন্ত্রী। সব মিলিয়ে কিছুটা হলেও হতাশ ব্রিগেডের বিজেপি নেতা-কর্মীরা। লোকসভা ভোটের প্রথম প্রচারে রাজ্যে এসে মোদী যতটা আক্রমণ করবেন বলে আশা করেছিলেন বিজেপি নেতা-কর্মীরা, ততটা যেন জোরালো হল না বক্তৃতায়।

Advertisement

অথচ আয়োজনের খামতি ছিল না। প্রস্তুত ছিল মঞ্চ। এই প্রথম ব্রিগেডে ‘হ্যাঙার’ তৈরি করে সভায় আয়োজন করেছিল বিজেপি। মোদী কলকাতায় পৌঁছনোর আগে পর্যন্ত দিলীপ ঘোষ, রাহুল সিংহ, বাবুল সুপ্রিয়রা রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে একের পর এক তোপ, ব্যাঙ্গ-বিদ্রুপ কটাক্ষে তাতিয়ে রেখেছিলেন ব্রিগেডে আসা নেতা-কর্মী সমর্থকদের। দমদম বিমানবন্দর থেকে হেলিকপ্টারে রেসকোর্স ময়দানে নেমে গাড়িতে ব্রিগেডের মঞ্চে পৌঁছতেই ‘মোদী-মোদী’ ধ্বনিতে ফেটে পড়ল ব্রিগেড ময়দান। দিলীপ ঘোষের মিনিট চারেকের সংক্ষিপ্ত বক্তৃতার পরই পোডিয়ামে উঠলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী।

‘‘আপনারা কেমন আছেন’’, ভাঙা ভাঙা বাংলায় শুরু করলেন মোদী, ‘‘আপনারা সবাই ভাল নাকি? মা কালীর আশীর্বাদ এবং রামকৃষ্ণ পরমহংসের নাম স্মরণ করে আপনার সবার সামনে পৌঁছেছি।’’ বাকি অংশ হিন্দিতে। আরম্ভ হল জাতীয়তাবাদ দিয়ে। পাকিস্তানের বালাকোটে ভারতীয় বায়ুসেনার অভিযানে ভারতের মাথা কতটা উঁচু হয়েছে, দেশবাসী হিসেবে কতটা গর্ববোধ হয়েছে, তা বোঝানোর চেষ্টা করে গেলেন প্রধানমন্ত্রী। এই অভিযান নিয়ে প্রথম প্রশ্ন তুলেছিলেন বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সেই প্রসঙ্গ টেনে এনে মমতাকে নিশানা করেন মোদী। তবে সেখানেও নাম না করে জনতার উদ্দেশে প্রশ্ন ছুড়ে দেন, ‘‘এয়ার স্ট্রাইক নিয়ে কে প্রশ্ন তুলেছিল? কে সন্দেহ প্রকাশ করেছিল? আপনারাই বলুন, প্রমাণ চেয়েছিল কে?’’ পুলওয়ামায় জঙ্গি হানায় শহিদ হয়েছিলেন এ রাজ্যের দুই সিআরপিএফ জওয়ান বাবলু সাঁতরা এবং সুদীপ বিশ্বাস। সেই সূত্রেই মোদী মমতাকে কাঠগড়ায় তুলে ফের প্রশ্ন তোলেন, বায়ুসেনার অভিযান নিয়ে প্রশ্ন তোলা কি ‘বাবলু-সুদীপের বলিদানকে অপমান’ করা নয়?

Advertisement

মুখোশ: ব্রিগেড ময়দানে মোদীর মুখোশ পরে বিজেপি কর্মী-সমর্থকরা। ছবি: পিটিআই

আরও পড়ুন: আগে দিল্লি সামলা, তার পর দেখিস বাংলা, দিনহাটায় মোদীকে কটাক্ষ মমতার

আরও পড়ুন: ‘নমো টিভি’ নিয়ে নোটিস কমিশনের, ‘চ্যানেল নয়, বিজ্ঞাপনী প্ল্যাটফর্ম’, বলল কেন্দ্র

লোকসভা ভোটের প্রচারে জাতীয় প্রেক্ষিত থাকবে এটা স্বাভাবিক। এ বার তির ঘোরালেন কংগ্রেসের দিকে। কিন্তু সেই যে অভিমুখ বদল হল, তার পর রাজ্যের দিকে সেটা ফিরল খুব কমই। বিভিন্ন রাজ্যে নির্বাচনী সভায় কংগ্রেসকে যে সব আক্রমণ করেছেন, ব্রিগেডে তার চেয়ে খুব আলাদা কিছু ছিল না। ‘মিশন শক্তি’কে নিয়ে রাহুল গাঁধী যে কটাক্ষ করেছিলেন, তা নিয়ে পাল্টা আক্রমণ করেছেন। বিজ্ঞানীদের স্যাটেলাইট ধ্বংসের শক্তি থাকলেও কংগ্রেস তথা ইউপিএ সরকারের সেই অনুমোদন দেওয়ার সাহস ছিল না বলে এতদিন ‘এ-স্যাট’ হয়নি, যা পেরেছে মোদী সরকার। মঙ্গলবারই কংগ্রেসের ইস্তাহার প্রকাশিত হয়েছে। সেই ইস্তাহারে মিথ্যে প্রতিশ্রুতি, দান খয়রাতির মাধ্যমে মানুষের মন পাওয়ার চেষ্টার মতো নানা দিক দিয়ে আক্রমণ করেছেন। দীর্ঘ পাঁচ দশকেরও বেশি কংগ্রেসের শাসনে দেশে শুধু দুর্নীতি হয়েছে বলে ছুড়ে দিয়েছেন কটাক্ষ। এর পর পরিবারতন্ত্র। স্বাধীনতা-উত্তর দেশে গণতন্ত্র ধীরে ধীরে পরিবারতন্ত্রে পরিণত হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন, যা কার্যত দীর্ঘদিনের অভিযোগ মোদীর।

এই প্রসঙ্গেই খানিকটা প্রবেশ করেছেন রাজ্য রাজনীতির গণ্ডিতে। পরিবারতন্ত্রের কথা বলতে গিয়েই প্রধানমন্ত্রীর তোপ, ‘‘পিসি-ভাইপো মিলে রাজ্যকে লুঠ করছে। বাংলার মানুষের সঙ্গে অবিচার করছে।’’ পিসি-ভাইপো বলতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে বোঝালেও কারও নাম করেননি প্রধানমন্ত্রী। এই তৃণমূল সরকারের থেকে মুক্তি পেতে বিজেপিকে ২০১৪ সালের মতোই ২০১৯-এও ভোট দিয়ে জেতানোর আহ্বান জানান মোদী।

নমো: ব্রিগেডের সভায় উঠে দর্শকদের উদ্দেশে প্রণাম মোদীর। ছবি: পিটিআই

আরও একটি প্রসঙ্গও ছুঁয়ে গিয়েছেন। তৃণমূলের বিরুদ্ধে ‘গুন্ডারাজ’-এর অভিযোগ। কিন্তু সেই প্রসঙ্গেও কার্যত এক লাইন। দীর্ঘদিনের বাম সরকারকে সরিয়ে ২০১৮ সালে ত্রিপুরায় বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় এসেছে বিজেপি। ত্রিপুরার মানুষ ‘লাল বন্ধন’ থেকে মুক্তি পেতে বিজেপিকে বেছে নিয়েছেন। অন্য দিকে বাংলায় ৩৪ বছরের বাম শাসনের পর ২০১১ সালে সরকার গঠন করে তৃণমূল। এখানেই বাম-তৃণমূলকে এক দাঁড়িপাল্লায় ফেলে মোদী বলেন, ‘‘বামেদের বন্দুক রাজনীতির সংস্কৃতি ধার করেছে তৃণমূল।’’

হাতে হাত: শিলিগুড়ির কাওয়াখালিতে সভামঞ্চে বিজেপি নেতা-নেত্রীদের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী। ছবি: এএফপি

শিলিগুড়ি তথা উত্তরবঙ্গের বিজেপি নেতা-কর্মী সমর্থকদের উজ্জীবিত করার মতো রসদ দিয়ে গিয়েছেন মোদী। সেখানে দেদার আক্রমণ শানিয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও তাঁর দল তৃণমূলকে এবং রাজ্য সরকারকে। সরাসরি নাম না করলেও ‘দিদি’ বলে অনেকবারই মমতাকে সম্বোধন করে কটাক্ষ করেছেন মোদী। বেআইনি অর্থলগ্নি সংস্থার কেলেঙ্কারি নিয়ে তিনি বলেন, ‘‘এই রাজ্যে চিট ফান্ড কেলেঙ্কারি হয়েছে। গরিব মানুষকে চিট ফান্ডকে ভরসা করে টাকা জমা রেখেছেন। আর সেই টাকা দিদি এবং তাঁর মন্ত্রী, বিধায়ক, সঙ্গীরা লুটে নিয়েছেন। সাধারণ মানুষ সর্বস্বান্ত হয়েছেন।’’

এর পর তুলেছেন উন্নয়নে বাধা দেওয়ার অভিযোগ। এই ইস্যুতেই তাঁর নতুন শব্দবন্ধ, ‘স্পিডব্রেকার দিদি’। অর্থাৎ উন্নয়নের পথে মমতাকে অন্তরায় বলে উল্লেখ করে মোদী বলেন, ‘‘৭০ লাখ গরিব কৃষক পরিবারের উন্নয়নে ব্রেক লাগিয়ে দিয়েছেন। কৃষকদের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে সরাসরি টাকা ঢুকে যায়। কিন্তু দিদি স্পিড ব্রেকার।’’ তিনি এই ‘স্পি়ডব্রেকার’ সরার অপেক্ষায় রয়েছেন বলেও এ দিন উল্লেখ করেন মোদী। অসমে এনআরসি নিয়ে রাজনৈতিক তরজা তুঙ্গে। উত্তরবঙ্গের কিছু অংশেও তার প্রভাব রয়েছে। তৈরি হয়েছে আশঙ্কাও। তবে প্রধানমন্ত্রীর আশ্বাস, ‘‘এনআরসি নিয়ে অনেক ভুল কথা বলা হচ্ছে। গোর্খাদের বলছি, এনআরসি-র জন্য আপনাদের কোনও ক্ষতি হবে না। তবে জগাই-মাধাই গুন্ডা আর অনুপ্রবেশকারীদের দিন শেষ।’’

‘চৌকিদার’: শিলিগুড়ির জনসভা ময়দানে ‘চৌকিদার’ টুপি পরে এক মহিলা বিজেপি কর্মী। ছবি: এএফপি

কিন্তু শিলিগুড়ির এই গতি আর ঝাঁজ অনেকটাই থমকেছে ব্রিগেডের সভায়, মত রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের। তৃণমূলের খাস তালুক রাজ্যের রাজধানীতে দাঁড়িয়ে কেন কিছুটা হলেও তৃণমূলের বিরুদ্ধে কিছুটা হলেও নরম অবস্থান নিলেন, তা নিয়ে কাটাছেঁড়া করতে বসে পড়েছে রাজনৈতিক শিবির।

দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯

অন্য দিকে জাতীয় প্রেক্ষিতে বিজেপির মূল শত্রুকংগ্রেস ঠিকই। কিন্তু যে রাজ্যে প্রচারে এসেছেন মোদী, সেই পশ্চিমবঙ্গে মালদহ, মুর্শিদাবাদ, উত্তর দিনাজপুর ছাড়া কংগ্রেসের তেমন কোনও শক্ত ভিত নেই। আর কলকাতা এবং সংলগ্ন জেলাগুলিতে আরও দুর্বল হাত শিবির। এ রাজ্যে বরং বিজেপির মূল প্রতিপক্ষ তৃণমূল। অথচ রাজ্যের প্রথম নির্বাচনী প্রচারে এসে সেই কলতাতার মঞ্চে কেন শুধুই কংগ্রেসের পিছনে পড়ে রইলেন এবং তৃণমূলের বিরুদ্ধে বিশেষ কিছু বললেন না, তারও উত্তর খুঁজছেন রাজনৈতিক সমালোচকরা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন