দুর্গাপুরে এমএএমসি কারখানার আবাসন এখন খাঁ খাঁ। ছবি: বিকাশ মশান
‘‘ভোটের দাম নেই। খোদ মন্ত্রীরও কথার দাম নেই। যদি দামই থাকত, তা হলে ওটা কী ?’’ ঝাঁঝিয়ে উঠে দরজা-জানলাবিহীন ইটের কঙ্কালের দিকে আঙুল তুললেন বিশ্বনাথ বাগ। ওই ভগ্নস্তূপ এক সময়ের পুরোদস্তুর হাসপাতাল। কেন্দ্রীয় সরকারি সংস্থা ‘হিন্দুস্থান কেবলস’-এর কর্মীদের জন্য তৈরি ওই হাসপাতালে ছোট-বড় অস্ত্রোপচারও হত বলে দাবি।
ফাঁকা মাঠে হাসপাতালের ওই হাঁ-করা দোতলা কাঠামোর মতোই রূপনারায়ণপুরের ‘হিন্দুস্থান কেবলস’-এর ৯০০ একরের বেশি জমি জুড়ে তৈরি কারখানা-উপনগরী এখন শুধুই স্মৃতি। যার তাড়নায় আজও দিনের কোনও একটা সময় এসে জমায়েত হন স্বেচ্ছাবসর নেওয়া কর্মীরা। চৈত্রের কড়া রোদ থেকে বাঁচতে ভরসা কারখানার ভাঙাচোরা ওয়্যারহাউজ়। সেখানেই দাঁড়িয়ে বিশ্বনাথবাবুর প্রাক্তন সহকর্মী নীলকমল মৌলিক জানালেন, অজয় নদী পর্যন্ত বিস্তৃত একদা-ব্যস্ত উপনগরীতে আপাতত চুরির রমরমা। গাছ কাটা, কাঠের দরজা-জানলা খুলে নিয়ে যাওয়া থেকে শুরু করে গ্যাসকাটার দিয়ে পাইপ চুরি, সবই চলছে প্রায় প্রকাশ্যে। এমনকি মাটি খুঁড়ে তামার তার লোপাট করা হচ্ছে বলে কর্মীদের অভিযোগ। ৩৫০০ কোয়ার্টার, স্কুলবাড়ি, হাসপাতাল, জলের ট্যাঙ্ক— সবেতেই চোরেদের হাত পড়েছে।
রূপনারায়ণপুর থেকে ৬০ কিলোমিটারের একটু বেশি দূরে দুর্গাপুরের মাইনিং অ্যান্ড অ্যালায়েড মেশিনারি কর্পোরেশন অব ইন্ডিয়া (এমএএমসি)। পর পর তিনটি জীর্ণ, ভূতের বাড়ির মতো কোয়ার্টার পেরিয়ে কোয়ার্টার নম্বর ৮২/১। ৭৭ বছরের বৈদ্যনাথ ঘোষ এমএএমসির প্রাক্তন কর্মী। সদ্য চুনকাম করা কোয়ার্টারের লোহার গেট খোলার আগে দিতে হল পরিচয়। তাতেও কথা বলতে বিশেষ আগ্রহ দেখালেন না বৈদ্যনাথবাবু। তাঁর ছোট ছেলে সুদীপ্ত ঘোষ বললেন,‘‘ বাবার আর দোষ কী ? প্রতি পাঁচ বছর একই মিথ্যা প্রতিশ্রুতি। ছোট-বড় মিলিয়ে এই নিয়ে আমি ১৮ বার ভোট দেব। প্রতিবারের মতো এ বারও সেই শিল্প, উন্নয়ন নিয়ে বড় বড় কথা শুনছি। প্রায় শ্মশান এই টাউনশিপ দেখলেই বুঝতে পারবেন আসলে কোনও কাজ হয়েছে কি না।’’ কেন্দ্রীয় সরকারের এই বন্ধ সংস্থার উপনগরী জুড়ে একের পর এক পরিত্যক্ত আবাসন, স্কুল, ডিসপেনসারি। গুটিকয়েক কোয়ার্টার সারিয়ে নিয়ে বসবাস করছেন প্রাক্তন কর্মীরা। আর দেখা যাচ্ছে ছোট ছোট ক্লাব। আগুয়ান, উদীয়মান, অগ্রদূত, কালচারাল ক্লাব, ইত্যাদি।
দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯
এমএএমসি উপনগরী থেকে ৬.৬ কিলোমিটার দূরে হিন্দুস্থান ফার্টিলাইজার কর্পোরেশন লিমিটেড (এইচএফসিএল) টাউনশিপ। দেড় দশকের বেশি আগে বন্ধ হয়ে যাওয়া এই কেন্দ্রীয় সরকারি সংস্থার উপনগরীর চেহারা আরও মলিন, আরও শ্রীহীন। আগাছা জন্মে যাওয়া সার সার পোড়ো বাড়ি। তারই মধ্যে জড়োসড় হয়ে কয়েকটা কোয়ার্টার। তাপ্পি দেওয়া দেওয়াল, চাঙড় খসে পড়া ছাদের একপাশ সারিয়ে নিয়ে দিন গুজরান করেন মৃণালকান্তি মণ্ডল। ফার্মাসিস্ট হিসেবে কাজ করতেন তিনি। কারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়ার সময় মাঝচল্লিশের মৃণালকান্তিবাবুর দুই সন্তান স্কুল পড়ত। ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা চালাতে কোয়ার্টার ছেড়ে অন্যত্র থাকার সাহস করেননি। বাড়িভাড়া বাঁচাতে এই ভাঙাচোরা আবাসনই ভরসা। তিনি বলেন, ‘‘বর্ষায় নিকাশির ময়লা জল পেরিয়ে বাড়ি ঢুকতে হয়। কেউ ভাবতেই পারবে না কেমন ছবির মতো সাজানো ছিল এই জায়গাটা।’’
রূপনারায়ণপুরের বিশ্বজিৎ বাগ, নীলকমল মৌলিক আর দুর্গাপুরের সুদীপ্ত ঘোষ, মৃণালকান্তি মণ্ডলকে জুড়ে দিয়েছে স্মৃতি হাতড়ানো আর প্রতিশ্রুতিভঙ্গের যন্ত্রণা।
এই একই ছবি ঘুরে ফিরে আসছে আসানসোল-দুর্গাপুর-রানিগঞ্জ শিল্পাঞ্চলের উপনগরীগুলিতে। পঞ্চাশের দশকে তৈরি কেন্দ্রীয় সরকারি সংস্থাগুলি একের পর এক বন্ধ হয়েছে। ‘রুর অব ইন্ডিয়া’ তকমা নেহাতই স্মৃতি হয়ে যাওয়ার কারণ হিসেবে উঠে এসেছে কেন্দ্রীয় নীতি, শ্রমিক আন্দোলন, পুঁজির অভাব, পুরোনো প্রযুক্তি, ইত্যাদি। বাম আমলে ওঠা কেন্দ্রীয় বঞ্চনার অভিযোগ তৃণমূলের আমলেও রয়েছে। সিআউটিইউ বর্ধমান জেলা সভাপতি বিনয়েন্দ্রকিশোর চক্রবর্তী বলেন,‘‘ মানুষ বুঝতে পারছেন কেন্দ্র-রাজ্য, কোনও সরকারই কথা রাখেনি। আমরা এখনও শ্রমিকদের পাশে আছি।’’ তৃণমূলের শ্রমিক নেতা হরেরাম সিংহের পাল্টা অভিযোগ, ‘‘বন্ধ হতে শুরু করেছে অনেক আগেই। তখন বামেরা কী করছিলেন ? আমাদের সাংসদেরা এ নিয়ে সব সময় সরব হয়েছেন।’’ আর যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগের তির, সেই বিজেপি এ নীরব।
এই চাপানউতোরে কিছু এসে যায় না বন্ধ সংস্থার অধিকাংশ কর্মীর সন্তানদের। ভিন্ রাজ্যে কর্মরত ওঁরা। ওখানেই ভোট দেন। এখানে শুধু বৃদ্ধ বাবা-মায়ের টানে ফেরা। আর কর্মস্থলে ফিরে যাওয়ার সময় ঘুরপাক খায় প্রশ্ন— ঠিক সময় যদি পৌঁছনো না যায়? যেমন পারেননি এমএএমসির প্রাক্তন কর্মী শিশির ঘোষের ছেলে। মর্গে রাখতে হয়েছে মৃতদেহ। বডোদরা থেকে এসে শেষকৃত্য করতে লেগে গিয়েছে দু’দিন।