ভোটের হাওয়ায় মিশছে পাহাড়ও

জেলা সদর বর্ধমান তো বটেই, ভোটের সপ্তাহখানেক আগে গলসি, ভাতার থেকে শিল্পনগরী দুর্গাপুর— স্পষ্ট মিলল না ভোট-অঙ্কের হিসেব। শহর থেকে গ্রামে কানাঘুষো, এই কেন্দ্রে লড়াই এ বার জমবে।

Advertisement

চিরন্তন রায়চৌধুরী

শেষ আপডেট: ২৫ এপ্রিল ২০১৯ ০৩:২২
Share:

পিচঢালা রাস্তার পাশে জঙ্গল। তার মধ্যে সার-সার ‘হানাবাড়ি’। দুর্গাপুরের সিটি সেন্টার থেকে কিলোমিটার দশেক দূরে, আরা মোড়ের কাছে ফার্টিলাইজার কলোনি এখন এমনই। সেই বসতির পুরনো দিনের গল্প বলছিলেন বছর সত্তরের ধরণীধর চট্টরাজ। বললেন, ‘‘প্রায় ৭০০ পরিবার থাকত এখানে। এখন ৭০টাও হয়তো নেই। তখন বিকেলে অফিস ছুটির পরে গল্পগুজব, খেলাধুলো, কখনও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে সময় যে কী ভাবে চলে যেত, টের পেতাম না।’’ আর এখন? ‘‘পানাগড়ে বেসরকারি সার কারখানার বদলে সরকার এখানকার সার কারখানার দিকে নজর দিলে এমন হাল হতো না। সন্ধের পরে দুষ্কৃতীদের আনাগোণায় ঘর থেকে বেরতেই ভয় লাগে’’— বললেন তিনি। এমন পরিস্থিতির জন্য রাজ্য থেকে কেন্দ্র, দুই সরকারকেই বিঁধলেন কলোনির একটি জীর্ণ আবাসনের বাসিন্দা সুবোধকুমার মুখোপাধ্যায়। তিনি বলেন, ‘‘তৎকালীন বামফ্রন্ট হোক বা কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন বিজেপি, পাশে কাউকে পাইনি। তৃণমূল কী করে, তার অপেক্ষায় আছি।’’

Advertisement

প্রশ্ন শুনেই একগাল হাসি তিনকোনিয়া বাসস্ট্যান্ড লাগোয়া চায়ের দোকানির। বললেন, ‘‘ঠান্ডা হয়ে যাবে, তাড়াতাড়ি চায়ে চুমুক দিন।’’ বর্ধমান-দুর্গাপুরে ভোটের হাওয়া কোন দিকে— জিজ্ঞাসা ছিল এটাই। এক মুহূর্ত ভেবে উত্তর, ‘‘আর তো কয়েকটা দিন, তার পরে তো সবাই ফল জানতেই পারবেন।’’ একই প্রশ্নে গলসির এক কৃষিজীবীর মন্তব্য, ‘‘ভোট তো আগে দিই। তার পরে দেখা যাক।’’

জেলা সদর বর্ধমান তো বটেই, ভোটের সপ্তাহখানেক আগে গলসি, ভাতার থেকে শিল্পনগরী দুর্গাপুর— স্পষ্ট মিলল না ভোট-অঙ্কের হিসেব। শহর থেকে গ্রামে কানাঘুষো, এই কেন্দ্রে লড়াই এ বার জমবে।

Advertisement

২০১৪ পর্যন্ত ওই লোকসভা কেন্দ্র দখলে ছিল সিপিএমের। ওই বছরের ভোটে জেতেন তৃণমূলের মমতাজ সংঘমিতা। নিকটতম বামদলের প্রতিদ্বন্দ্বীকে ১ লক্ষের কিছু বেশি ভোটে পিছনে ফেলেছিলেন তিনি। এ বার মমতাজ বলছেন, ‘‘আমার মিছিল, জনসভায় ভিড় জমছে।’’ তাতে কী জয় নিয়ে নিশ্চিত? বর্ধমানের ভাড়াবাড়িতে বসে তৃণমূল প্রার্থীর মন্তব্য, ‘‘সব কিছু দেখে তো ভালই মনে হচ্ছে।’’ বিপক্ষে বিজেপির ‘নামী’ প্রার্থীতে চাপ কি বেড়েছে? একবাক্যে ওড়ালেন বিদায়ী সাংসদ। বললেন, ‘‘তেমন কিছু টের পাচ্ছি না। আমার এখানে অনেক উন্নয়ন হয়েছে। মানুষ তা জানেন।’’ তাঁর শ্লেষ, ‘‘উন্নয়নের প্রয়োজন তো ছিল পাহাড়ে।’’

উন্নয়নের প্রশ্নে পাল্টা রাজ্যের শাসকদলকেই বিঁধলেন সুরেন্দ্র সিংহ অহলুওয়ালিয়া। বুদবুদে প্রচারের ফাঁকে বিজেপি প্রার্থী বলেন, ‘‘তৃণমূলের ৮ বছরের শাসনে মানুষের নিরাশা বেড়েছে, বেড়েছে সন্ত্রাস। যদি সত্যিই এখানে কাজ হয়ে থাকে, তা হলে পঞ্চায়েত, পুরসভা নির্বাচনে ভোট দেওয়ার অধিকার কেন কাড়া হল!’’ জেতা নিয়ে কতটা আশাবাদী? ধন্দ রাখলেন অহলুওয়ালিয়াও। বললেন, ‘‘এটা প্রতিদ্বন্দ্বিতা। তার ফল ঠিক করবে জনতাই। এটুকু বলতে পারি, আমি এখানকার ছেলে, বণর্পরিচয়ও বর্ধমানে।’’

দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯

বাইরে গনগনে আঁচ ঢালছে রোদ্দুর। মুরাদপুরে বাদশাহী রোডের পাশে ছোট্ট বাড়ির দাওয়ায় দেখা মিলল কংগ্রেসের রণজিৎ মুখোপাধ্যায়ের। বললেন, ‘‘আগের কয়েকটা ভোটে এ সব গ্রামে আমাদের দলের প্রচারই করা যায়নি। এ বার কংগ্রেস প্রার্থীকে দেখে সকলে খুশি। রাহুল গাঁধীর ‘ন্যায়’ প্রকল্পের কথাও জানেন অনেকে।’’ লড়াইয়ে কি অন্যদের টক্কর দিতে পারবেন? রণজিৎবাবুর মন্তব্য, ‘‘আমি নীতি, আদর্শের কথা বলছি। বাংলার বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে সেগুলো হয়তো মানুষের মনে প্রতিফলিত হতে পারছে না।’’

মোদী-মমতা-রাহুলের মতো মুখ নেই বামেদের, নেই একা কেন্দ্রে সরকার গঠনের ক্ষমতা— সেই কথা জেনেও কেউ, বিশেষত তরুণ প্রজন্ম কেন বামদলকে ভোট দেবেন? ওই কেন্দ্রের সিপিএম প্রার্থী আভাস রায়চৌধুরীর মন্তব্য, ‘‘তরুণ প্রজন্ম হয়তো বাম-শাসন সে ভাবে দেখেনি। কিন্তু গত কয়েক বছরে তৃণমূলের খারাপটা দেখেছে। আর বিজেপি প্রার্থী পাহাড়ের বিশ্বাসভঙ্গ করে এসেছেন। মিছিল-মিটিংয়ে তাই তরুণ প্রজন্মের মুখে বামেদের নিয়ে আবেগ দেখতে পাচ্ছি।’’ বর্ধমানে সিপিএমের সদর দফতরে বসে তাঁর অভিযোগ, ‘‘কৃষি থেকে শিল্প, এই কেন্দ্রে সব-ই বিপন্ন। দুর্গাপুরে রাষ্ট্রায়ত্ত্ব থেকে রাজ্য সরকারি কারখানা ধুঁকছে। বিভিন্ন এলাকার কিসানমান্ডিতে ফড়েদের রমরমা।’’

‘‘প্রার্থী দেখে নয়, কেন্দ্রে মজবুত সরকার গড়তে পারে এমন দলকেই ভোট দেওয়া দরকার’’— ভারতীয় মজদুর সঙ্ঘের নেতা উজ্জ্বল মুখোপাধ্যায় বললেন এমনই। তাঁর অভিযোগ, বামফ্রন্ট থেকে তৃণমূল, সবার আমলে এই কেন্দ্রে একের পর এক শিল্প সঙ্কটে পড়েছে। সমস্যা হয়েছে কৃষিতেও। তাঁর মতে, ‘‘রাষ্ট্রহিত, শ্রমিক-কল্যাণ ও শিল্পের জন্যে কেন্দ্রে প্রয়োজন বিজেপিকেই।’’ যা শুনে সিটু নেতা পঙ্কজ রায় সরকারের মন্তব্য, ‘‘শিল্পনগরী দুর্গাপুরকে বাঁচাতে পারবে, দিল্লিতে এমন নীতির সরকার চাই। মানুষ নির্বিঘ্নে ভোট দিতে পারলে শহরের ঐতিহ্য বজায় থাকবে, আশা রাখি।’’

পঞ্চায়েত থেকে পুরভোট—গ্রাম থেকে শহরের অনেক প্রান্তেই তাতে ভোট না দিতে পারার নালিশ শোনালেন কেউ কেউ। জানালেন, এ বার সুযোগ পেলে জবাব দিতে চান।

লোকসভা ভোটে দুর্গাপুর-বর্ধমান কেন্দ্রে ওই জবাবের ফল কী হবে, তার হিসেব ভোটবাক্সেই কষবেন এই আসনের আমজনতা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন