ঘুম ভাঙানিয়া পদ্মার ভোটে চুপ করে আছে চর

বিএসএফ ক্যাম্পে ভোটার কার্ড জমা রেখে রোশন আলি তাঁর খেটো লুঙ্গিটা দু-ভাঁজ করে পদ্মায় মাছ ধরতে ভেসে পড়েন। 

Advertisement

রাহুল রায়

নির্মলচর  শেষ আপডেট: ১৯ এপ্রিল ২০১৯ ০৪:২৮
Share:

ভগবানগোলা নির্মলচরের বন্যার সময়ের আশ্রয়স্থল। নিজস্ব চিত্র

পদ্মার জলজ হাওয়ায় নূয়ে পড়া তেঁতুল গাছে ঘর বাঁধছে ঝাঁক ঝাঁক গাঙ শালিখ।

Advertisement

—‘‘ঘর বাঁধা দ্যাখতিছেন? ফি বচ্ছর অমন যত্ন করি চরের মাইনষ্যেও ঘর বাঁধে। তবে কি জানেন, পদ্মার মায়া-দয়া নাই। এই দ্যাখেন না, ভুটের (ভোট) পরেই সেই দিন আসত্যাছে!’’

বিএসএফ ক্যাম্পে ভোটার কার্ড জমা রেখে রোশন আলি তাঁর খেটো লুঙ্গিটা দু-ভাঁজ করে পদ্মায় মাছ ধরতে ভেসে পড়েন।

Advertisement

নদীতে এখন ইলিশ নেই। তবে, জাল মারলেই পাবদা আর পাঙাসের উচ্ছ্বল হুটোপুটি। রোশন জানেন, প্রলম্বিত ভোট পর্ব মেটার আগেই ফের ঘর বাঁধতে হবে। তার আগে পাবদা-পাঙাসে কিঞ্চিৎ বাড়তি আয় তুলে রাখতে দিনভর পদ্মার রুপোলি জলে ডিঙি নিয়ে ভেসে আছেন রোশন। রাত তাঁর ঘুম-হারা।

দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯

মুর্শিদাবাদের ভগবানগোলা ২ নম্বর ব্লকে বিস্তীর্ণ পদ্মার বুকে ‘চরজাগানিয়া’ গান গেয়ে এখনই রাত জাগছে নির্মলচর। চরের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে থাকা মহিষমারি, আলেখপাড়া, শয়তানপাড়ার মানুষ লণ্ঠন হাতে নদীর কিনারে ঘুরে বেড়ান। কান পেতে তাঁরা শোনার চেষ্টা করেন পাড় ভাঙার নিদারুণ শব্দ। নদী ‘ডাক’ দিচ্ছে বুঝলেই হাঁক পাড়েন, ‘নদী জাগছে গো-ও-ও!’ রাত চরা হাওয়া ডাকহরকরা হয়ে সেই বার্তা ছড়িয়ে দেয় গ্রাম থেকে পড়শি গ্রামে। ঘর বাঁধার তোড়জোড় নতুন করে শুরু হয় তাঁদের।

আলেখপাড়ার মুখে সজনের ডালে সার দিয়ে ঘাসফুল ফুটেছে। নোনা হাওয়ায় ফ্যাকাসে হয়ে গিয়েছে সস্তা কাপড়ের দলীয় পতাকা। শয়তানপাড়ায় ডুমো শিমুলের মতো এক মুঠো লাল ঝাণ্ডাও উঁকি দিচ্ছে সোলার আলোর স্তম্ভে। চরের হুহু হাওয়ায় ভোটের রোদ্দুরে আঁচ পড়েছে এক ফালি।

তবে, ভোট ঘোষণার পরে নিশ্চুপে দিন গড়িয়ে গেলেও প্রার্থীদের কেউই চরের কাদায় পা রাখার সময় পাননি। তবে, ‘দলজ’ ভাইয়েরা মূল ভূখণ্ড ছেড়ে চরে আসছেন। ভোট চাওয়ার ফাঁক ফোঁকর খুঁজে চরের মানুষজনকে সতর্ক করে যাচ্ছেন তাঁরাও, ‘‘এই চৈত্ত (চৈত্র) মাস থিকাই সতর্ক থাকনের সময়। নদী জাগত্যাছে, মনে থাকে যেন কথাডা।’’

নির্মলচরের এগারোটা গ্রামের সাড়ে পাঁচ হাজার ভোটারের জন্য খান পাঁচেক বুথ। নদীর ওপারে, আখরিগঞ্জের বিভিন্ন দলীয় কার্যালয় থেকে পতাকা আর ফ্লেক্স এনে ডাঁই করে রাখা হয়েছে ঘাটে। তা নিয়ে আটপৌরে মিছিল চরের কাদা মাটি ভেঙে ঘুরছে। আর দলীয় নেতারা চেনা মানুষের সঙ্গে দেখা হলে ভোট-ভিক্ষার আগে শুনিয়ে রাখছেন

‘পদ্মা হইতে সাবধান’ বাণী। নদী ডাকলেও নির্মলচরের ভরসা ফ্লাড শেল্টারটা বছর তিনেক হল বেহাত হয়ে গিয়েছে। বদলে গিয়েছে তার ঠিকানা, ‘মহিষমারি বিওপি (বর্ডার আউট পোস্ট)’। পদ্মার কোলে সেই তিনতলা বাড়িটা দখল নিয়েছে বিএসএফের ব্যাটেলিয়ান। সাঁঝ নামতেই দপ করে সেখানে জ্বলে ওঠে আলো। জেনারেটরের ঘর ঘর শব্দ হারিয়ে যায় পদ্মার গর্জনে। শেষ বিকেলে বিদ্যুতের আলো দেখতে ক্যাম্পের কিনারে ভিড় করে

চরের কিশোর-কুল। বিস্ময়ে হাঁ-মুখ, ওরা পরস্পরকে শুধোয়, ‘‘আমাগো গাঁয়ে অমন ডুমো আলো কবে জ্বলবা রে!’’ ক্যাম্পের বেড়ার ধারে তাদের সোল্লাশ শুনে চেঁচিয়ে ওঠেন টহলদারি জওয়ান, ‘‘উধার কৌন?’’ ছেলেপুলেরা টিপন্নি কাটে, ‘‘আমাগো বানভাসি ঘরটা ছিনায়ে এখন ‘উধার কৌন!’’ পায়ের বুড়ো আঙুল দিয়ে বেলে

মাটি ঝরিয়ে বছর বারোর জালাল শেখ রাগে গর গর করে।

জালালের মতোই বিএসএফ নিয়ে বীতশ্রদ্ধ চরের বাসিন্দারা। রমজান মাস আসছে। দাওয়া দাওয়ায় গুন গুন করছে চাপা ক্ষোভ, বিএসএফের ‘অত্যাচার’ যে দল রুখতে পারবে, ভোট তারই।

চর প্রান্তে পদ্মা। তারপর ফের অনন্ত নদী। সেখানেই নতুন চরে তিসি কলাইয়ের ফলন লক লক করছে। গ্রামবাসীরা সেখানেও পা রাখতে পারেন না। বিএসএফের ফতোয়া নদী উজিয়ে ওই চরে কক্ষনো নয়। কেন? প্রশ্ন করে স্থানীয় শয়তানপাড়ার গোলাম মুর্শেদকে উর্দিধারীর থাপ্পর খেয়ে ফিরতে হয়েছে। বিএসএফের ব্যাটালিয়ন কমান্ড্যান্ট পাল্টা প্রশ্ন রাখছেন, “দেশের নিরাপত্তা আগে না চরের মানুষের নিত্য নতুন চাহিদা, কোনটাকে প্রাধান্য দেব বলুন তো?”

তা হলে?

ভাঙনের ভ্রূকুটির মাঝে ভোটের চৌকাঠে দাঁড়িয়ে নির্মলচর এখন প্রশ্ন হাতড়ায়, আসন্ন নির্বাচনে এই বিএসএফ-কে ‘রুখবে’ কে!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন