সোনারপুরে বামেদের মিছিলে ঢুকে পড়ে তৃণমূলের প্রচারকারী একটি অটো। পরে পুলিশ সেটিকে সরিয়ে নিয়ে যায়। বৃহস্পতিবার। ছবি: শশাঙ্ক মণ্ডল
ঘরে ঘরে কেন বিদ্যাসাগর মশাইয়ের ছবি টাঙিয়ে রাখেন না বাঙালি মেয়েরা?
‘পূর্ব-পশ্চিম’ উপন্যাসের একটি চরিত্রের মুখে একদা আফশোস করেছিলেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। বাংলার মেয়েদের উত্তরণে বীরসিংহের খর্বকায় বাঙালির বিস্তর অবদান সত্ত্বেও কেন তাঁরা বিদ্যাসাগরের পুজো করেন না, কার্যত সেই প্রশ্নই ছুড়ে দিয়েছিলেন সুনীল। ভোট-পার্বণে বাঙালি-গরিমার উদ্যাপনের মঞ্চ এ বছর খানিক অন্য কথাও বলে গেল।
বৃহস্পতিবার, শহরে ২০১৯-এর ভোটপ্রচারের শেষ দিনটিতেও বলা যায়, বিদ্যাসাগরেরই জয়জয়কার! বর্ণপরিচয়-স্রষ্টার মূর্তি ভাঙা নিয়ে বিজেপি-র বিরুদ্ধে তোপ দাগার পাশাপাশি, তৃণমূলের প্রচারের টি-শার্টেও এ বার ‘বাঙালির গর্ব’ বিদ্যাসাগরের অধিষ্ঠান। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের রোড শো থেকে দমদমে সৌগত রায়ের প্রচার— সর্বত্র এ দিন বীরসিংহের সন্তানই বিরাজমান। যাদের বিরুদ্ধে বিদ্যাসাগরের মূর্তি ভাঙার অভিযোগ, সেই বিজেপি-ও অবশ্য ‘পাপক্ষালনে’ মরিয়া। যাদবপুরের বিজেপি প্রার্থী অনুপম হাজরার সভায় তাঁর পাশে বিদ্যাসাগরবেশী বহুরূপীকে দেখে কিন্তু লোকের হাসিই পেয়েছে। দমদম সেন্ট্রাল জেলের মাঠে শমীক ভট্টাচার্যের সমর্থনে নরেন্দ্র মোদীও স্বভাবতই মূর্তি ভাঙা নিয়ে তৃণমূলের বিরুদ্ধেই পাল্টা তোপ দেগেছেন। শমীকও বলছেন, ‘‘আসলে যারা শ্যামাপ্রসাদের মূর্তি ভেঙেছে, তারাই বিদ্যাসাগরের মূর্তিও ভেঙেছে— কোনও ফারাক নেই!’’
দিল্লি ও রাজ্যের দুই শাসক দলের মধ্যে টক্কর অবশ্য স্রেফ বিদ্যাসাগরেই আটকে থাকেনি। নির্বাচন কমিশনের নির্দেশে প্রচারের দিন এক দিন কমে আসায় বিস্তর সমস্যা! পাড়ায় পাড়ায় অটোর চক্কর। স্লোগান-যুদ্ধ। দুপুরে চেতলা লকগেট রোডের বস্তিতে তৃণমূলপ্রার্থী মালা রায়! সেই বস্তি যেখানে অমিত শাহ কার বাড়িতে ভাত-ডাল-পোস্ত বসে খেয়েছিলেন।
দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯
কথা ছিল, এ দিন জোকা থেকে তারাতলা— পদযাত্রা করবেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এর পরে সত্যনারায়ণ পার্কে কলকাতা উত্তরের প্রার্থী সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সভায় যাবেন। সময় কমে যাওয়ায় সুদীপের সমর্থনে সভায় যেতে পারেননি ‘দিদি’! তার বদলে জোকা-তারাতলা ছাড়াও তাঁর হন্টন-মানচিত্রে যাদবপুর থেকে বালিগঞ্জ, হাজরা থেকে গোপালনগর। যাদবপুর থেকে রোড শোয়ে শামিল সেখানকার প্রার্থী মিমি চক্রবর্তী। মালা বললেন, ‘‘যাদবপুর থেকে রোড শোটা হয়তো এক দিন বাদে হত! কিন্তু আমরা একসঙ্গে ১৫, ১৬, ১৭ তিনটি দিনই রোড শোয়ের অনুমতি চেয়ে রেখেছিলাম!’’
‘‘শেষ দিন শহরে সংস্কৃতি জগতের বিশিষ্টদের নিয়ে রোড শোয়ের পরিকল্পনা ছিল, কিন্তু ভেস্তে গেল,’’ বলছেন কলকাতা দক্ষিণের সিপিএম প্রার্থী নন্দিনী মুখোপাধ্যায়। কংগ্রেসের মিতা চক্রবর্তীরও একই সুর, ‘‘এক দিনে কার্যত দু’দিনের প্রচার সেরে রাখতে হচ্ছে।’’ সন্ধ্যা থেকে পরপর জনসভায় ব্যস্ত সব প্রার্থীই। যাদবপুরের সিপিএম প্রার্থী বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্য সকালে ভাঙড়ে হেঁটে রোড শোয়ের পরে বিকেলে সোনারপুরে ঘুরছেন।
কলকাতা উত্তরের সিপিএম প্রার্থী কনীনিকা বসু ঘোষ শেষ দু’টি সকাল, টালাপার্ক ও বেলেঘাটার সুভাষ সরোবর— দু’টি জায়গায় প্রাতর্ভ্রমণকারীদের মধ্যে প্রচারের পরিকল্পনা রেখেছিলেন। এ দিন একই সঙ্গে পরপর দু’টি পার্ক তাঁকে ‘কভার’ করতে হল। কনীনিকার আফশোস, সন্ধ্যায় কাঁকুড়গাছিতে জঙ্গলমহলের দাপুটে নেত্রী দেবলীনা হেমব্রম হঠাৎ অসুস্থতায় এ দিন আসতে পারেননি। তবে জোড়াসাঁকোয় প্রকাশ কারাট সভা করেছেন। একটি দিন কমলেও যা প্রচার হয়েছে, তাতে উজ্জীবিত দমদমের সিপিএম প্রার্থী নেপালদেব ভট্টাচার্যও। সীতারাম ইয়েচুরিকে পাশে নিয়ে রোড শোয়ে তাঁর মুখে পরীক্ষার ভাল ছাত্রসুলভ অভিব্যক্তি। বছরভর ফাঁকিবাজি না করার আত্মবিশ্বাস!
‘‘প্রচারের দিন কমায় বিজেপি-র সমস্যা হয়নি কে বলল! আমারও তো বড়বাজারে একটি রোড শো ছাড়তে হল,’’ বলছেন কলকাতা উত্তরের প্রার্থী রাহুল সিংহ। কলকাতা দক্ষিণের চন্দ্র বসু পূর্ণ দাস রোডে ডাকাত-কালীকে পুজো দিয়ে প্রচার শুরু করেছিলেন, প্রচার শেষও করলেন সেখানেই। শহরের চিরকেলে প্রচার-রীতির মধ্যে তবু ভেসে উঠেছেন বিদ্যাসাগর। পুজো-আচ্চা-ঢাকি-রণপা-ঝাঁঝালো বক্তৃতার ভিড়ে তিনিই যা ব্যতিক্রম।