মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও রাহুল গাঁধী। —ফাইল চিত্র
করণদিঘিতে নির্বাচনী জনসভা রাহুল গাঁধীর। তার আগেই তোপ দেগে রেখেছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ‘আরএসএস-এর সমর্থনে ভোটে লড়ছে কংগ্রেস’, চোপড়ায় দাঁড়িয়ে অভিযোগ তুলেছিলেন তৃণমূল নেত্রী। কিছুদিন আগে মালদহের চাঁচলের সভায় তৃণমূলের বিরুদ্ধে যে আক্রমণের ঝাঁজ ছিল, করণদিঘিতে ততটা না হলেও মমতার বক্তব্যের জবাব দিলেন কংগ্রেস সভাপতি। তৃণমূলকে নিশানা করে রাহুলের পাল্টা কটাক্ষ, ‘‘কংগ্রেস কখনও বিজেপির সঙ্গে সমঝোতা করেনি, কিন্তু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় করেছেন।’’ কর্মসংস্থান নিয়ে প্রধানমন্ত্রী ও বাংলার মুখ্যমন্ত্রীকে এক পংক্তিতে বসিয়ে জনতার উদ্দেশে রাহুলের প্রশ্ন, ‘‘দু’জনেই চাকরির প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, কিন্তু আপনারা কি চাকরি পেয়েছেন?’’
বিজেপি তথা মোদীর রাফাল দুর্নীতি, আর নিজেদের ন্যূনতম আয় প্রকল্প (ন্যায়)— মূলত এই দু’টিই এ বারের লোকসভা ভোটে রাহুলের প্রচারের অন্যতম হাতিয়ার। বাংলায় এসেও সেই দুই অস্ত্রেই শান দিলেন। মমতার চেয়েও রাহুলের ভাষণের বেশিরভাগ সময় জুড়ে ছিলেন নরেন্দ্র মোদী। করণদিঘির নাগোর জুটপার্ক ময়দানের সভায় রাফাল নিয়ে রাহুল বলেন, ‘‘মোদী সবাইকে চৌকিদার বানিয়েছেন। কিন্তু উনি রাফালে দুর্নীতি করেছেন। ৩০ হাজার কোটি টাকা পাইয়ে দিয়েছেন অনিল অম্বানীকে। তাই মোদী দেশবাসীর চৌকিদার নন, অনিল অম্বানীর চৌকিদার।’’ রাহুল বলছেন ‘চৌকিদার’, জনতা আওয়াজ তুলছে ‘চোর হ্যায়’। করণদিঘির সভাতেও সেই স্লোগান উঠল। রাহুল হুঙ্কার ছাড়লেন, ‘‘মোদী ভয় পেয়েছেন, চুপসে গিয়েছেন। ভাষণ দিতে উঠে জনতার সঙ্গে চোখে চোখ মেলাতে পারেন না, খালি এদিক, সেদিক দেখেন। ক্ষমতায় এলে এই চৌকিদারের বিরুদ্ধে তদন্ত হবে। উনি জেলে যাবেন।’’
২০১৪ সালের ভোটের আগে মোদী প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন আম জনতার ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে ১৫ লাখ টাকা ঢুকিয়ে দেবেন। ‘‘১৫ লাখ পেয়েছেন?’’— জনতার উদ্দেশে এই প্রশ্ন ছুড়ে দিয়ে রাহুল ঢুকে পড়লেন ‘ন্যায়’ প্রকল্পে। বললেন, ‘‘আমাদের দলের সেরা অর্থনীতিবিদদের ডেকে জিজ্ঞেস করলাম, দেশের গরিব মানুষদের জন্য কত টাকা দেওয়া সম্ভব। ওনারা হিসেব দিলেন, ৭২ হাজার। সেই অনুযায়ী যাদের মাসিক আয় ১২ হাজার টাকার কম, বছরে সরাসরি ৭২ হাজার ঢুকে যাবে তাঁদের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে।’’ কিন্তু টাকা আসবে কোথা থেকে? জবাব দিয়েছেন কংগ্রেস সভাপতি। আশ্বস্ত করেছেন, ‘‘মোদী বিজয় মাল্যকে ৪৫ হাজার কোটি দিয়েছেন। অনিল অম্বানীকে ৩০ হাজার কোটি টাকা দিয়েছেন। কংগ্রেস ক্ষমতায় এলে এই সব টাকা উদ্ধার করে দেওয়া হবে গরিবের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে।’’
আরও পড়ুন: ভোট শেষ না হওয়া পর্যন্ত মোদীর বায়োপিকে নিষেধাজ্ঞা নির্বাচন কমিশনের
আরও পড়ুন: মোদী জিতলে বাজি পুড়বে পাকিস্তানে? ইমরানের সমর্থন নিয়ে খোঁচা বিরোধীদের
কংগ্রেসের ইস্তাহারে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে, কৃষিঋণ মেটাতে না পারলে সেই কৃষককে জেলে পোরা যাবে না। কংগ্রেস ক্ষমতায় এলে এই আইন চালু করা হবে। করণদিঘির সভাতেও সেই প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন রাহুল। তিনি বলেন, ‘‘আমি মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দিই না। মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান, ছত্তীসগঢ়ে আমরা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম ক্ষমতায় আসার ১০ দিনের মধ্যে কৃষিঋণ মকুব করব। সেখানকার কৃষকদের জিজ্ঞেস করে আসুন আপনারা। সবাই বলবে তিন দিনের মধ্যে সেই ঋণ মকুব করে দিয়েছে কংগ্রেস সরকার।’’ রাহুলের আরও সংযোজন, ‘‘বড় শিল্পপতি ঋণ নিয়ে শোধ না করলে তাঁর কিছু হয় না, আর কৃষক ঋণ শোধ করতে না পারলে তাঁকে জেলে পোরা হয়। আমরা ক্ষমতায় এলে এই আইন পরিবর্তন করব।’’
সারা দেশের প্রেক্ষিতে কংগ্রেসের মূল শত্রু যে বিজেপি, এ পর্যন্ত রাহুলের বক্তব্যে সেটাই ফুটে উঠেছে। কিন্তু এ রাজ্যে কংগ্রেসের আর এক শত্রু তৃণমূল কংগ্রেস। সেই দলের নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আবার রাহুলের হেলিকপ্টার নামার আগেই আক্রমণ শানিয়ে রেখেছিলেন, আরএসএস-এর সঙ্গে আঁতাঁতের। করণদিঘিতে রাহুল জবাব দিলেন, ‘‘মমতাজি বলছেন, কংগ্রেস বিজেপির বিরোধিতা করে না। তা হলে রাফাল ইস্যু কে তুলল? চৌকিদারকে চোর কে বানাল?’’ এ বার সরাসরি তৃণমূল নেত্রীকে রাহুলের তির, ‘‘কংগ্রেস কখনও কোথাও বিজেপির সঙ্গে জোট করেনি। কোথাও করেছে বলতে পারবেন? কিন্তু মমতাজি করেছেন।’’
এর সঙ্গে কর্মসংস্থান প্রশ্নেও মমতা-মোদীকে একযোগে কাঠগড়ায় তুলেছেন রাহুল গাঁধী। ১৫ লাখের মতোই জনতার উদ্দেশে আবার প্রশ্ন করেছেন, ‘চাকরি পেয়েছেন’? কেউ চাকরির প্রতিশ্রুতি পূরণ করেননি, বলেন রাহুল। একই সঙ্গে রাহুলের প্রতিশ্রুতি, কংগ্রেস ক্ষমতায় এলে ‘‘কৃষিভিত্তিক শিল্প-কারখানা তৈরি হবে। কৃষক সরাসরি সেখানে গিয়ে ফসল বিক্রি করতে পারবেন। উন্নতমানের শিক্ষার ব্যবস্থা করা হবে। যুবক-যুবতীরা চাকরি পাবেন।’’
মমতাকে আক্রমণ বলতে এই টুকুই। অথচ কয়েক দিন আগেও উত্তরবঙ্গেরই মালদহের চাঁচোলে এসে মমতার বিরুদ্ধে সারদা-নারদা নিয়ে কটাক্ষ করেছিলেন। মৌসম নূরকে ‘বেইমান’ বলে তির ছুড়েছিলেন। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে দাঁড়িয়েও মোদীর নিশানায় মোদী। এ দিন রাহুলের এই নরম সুর কি তবে অন্য কোনও রাজনৈতিক বার্তা বহন করছে। এখনই নিশ্চিত নয় রাজনৈতিক শিবির।
প্রয়াত প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সির খাস তালুক রায়গঞ্জ আসন। তাঁর স্ত্রী দীপা দাশমুন্সি এই কেন্দ্রে কংগ্রেসের প্রার্থী এবং তাঁর সমর্থনেই রাহুলের জনসভা। করণদিঘির এই জনসভাতেই কার্যত রাজনীতিতে অভিষেক হল তাঁর ছেলে মিছিল-এর। এর আগে মায়ের সঙ্গে ছোটখাটো রাজনৈতিক কর্মসূচিতে অংশ নিলেও সেই অর্থে এই প্রথম এত বড় জনসভায় ভাষণ দিলেন মিছিল। রাহুলের বক্তব্যেও সব শেষে এসেছে প্রিয়রঞ্জনের প্রসঙ্গ। তাঁর কথা মাথায় রেখেই দলীয় প্রার্থীকে ভোট দেওয়ার আর্জি জানিয়েছেন রাহুল।