ফণীর দু’দিন আগের কথা। বাঁকুড়া শহর থেকে বেরিয়ে সতীঘাটা সেতু পেরিয়ে হাইওয়ের মুখের চায়ের দোকান। আচমকা ঝড়বৃষ্টিতে সেখানে দাঁড়িয়ে পড়েছেন অনেকে। কলেজ থেকে বাড়িমুখো বেশ কয়েক জন যুবক। ঝোড়ো হাওয়ায় উড়ছে চায়ের দোকানের প্লাস্টিক। ছুটছে কলেজ পড়ুয়াদের কথার তুফানও। এবং ঘুরে ফিরে সেই ভোট। চর্চার বিষয় নরেন্দ্র মোদীর বাঁকুড়া সফর। সঞ্জীব, রথীন, সুজয়, হাঁকু, চয়নরা সবাই মোদীর সভায় যেতে চান। যদিও তাঁরাই জানাচ্ছেন, সবাই মোদীকে ভোট দেবেন না। তবুও বাঁকুড়ার মাঠে এক বার তাঁরা দেখতে যাবেন মোদীকে।
সেই জটলায় খুঁচিয়ে তুলি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের রোড শোয়ের প্রসঙ্গ। জানতে চাই, ওই একই দিনে তো মুখ্যমন্ত্রীর রোড-শো আছে। যাবেন না আপনারা? তাঁরা জানান, মুখ্যমন্ত্রী তো প্রায়ই আসেন। তা ছাড়া, শহরের বিভিন্ন ওয়ার্ড থেকে কাউন্সিলররা লোক নিয়ে যাবেন। ফলে লোকের অভাব হবে না— জানায় সেই জটলা।
সে দিনই দুপুরে খাতড়া শহরের এক পান-বিড়ির দোকানে দাঁড়িয়ে ভোট-গল্পে শুনেছিলাম অদ্ভুত এক কথা। এক বৃদ্ধের কাছে জানতে চেয়েছিলাম, এ বার ভোটের কী অবস্থা? তাচ্ছিল্যের সঙ্গে তাকিয়ে তিনি বলেছিলেন,‘‘ভোট হলে, ভোট হবে।’’ মানে বুঝিনি। পানের দোকানের মালিক বললেন, ‘‘বুইলেন না দাদু কী বইললেন? উনি বইললেন, ভোট হলে, ঠিক জায়গাই ভোট হবে। বুইলেন? পঞ্চায়েতে ভোট হয় নাই তো!’’ তারও আগে রানিবাঁধে গিয়ে পরিস্থিতি আরও স্পষ্ট হয়েছিল। কে কত লিড দেবেন, বাঁকুড়া লোকসভার তৃণমূল প্রার্থী সুব্রত মুখোপাধ্যায় তার হিসেব নিচ্ছিলেন। এক যুব নেতা সপাটে বলে বসলেন, ‘‘চিন্তা করবেন না, বহু বুথে ভোটই হবে না। সব আমরাই করব।’’
দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯
এ বারের বাঁকুড়ার ভোটে চুম্বকে এটাই বাস্তবতা। এক দিকে ‘আমরা বাহিনীর’ চামড়া গোটানো সংগঠন, অন্য দিকে নির্বিঘ্নে ভোট দেওয়ার জন্য মুখিয়ে থাকা মানুষ। যাঁদের সম্বল শুধু মাত্র আবেগ। আর মাঝখানে দাঁড়িয়ে সিপিএমের অমিয় পাত্র। ফেলে আসা দিনের সংগঠন ও আবেগের ভরসায় তিনি। তবে শাসক দলের কাছে আরও একটি ভরসার জায়গাও রয়েছে। তা হল প্রার্থী সুব্রত মুখোপাধ্যায়।
বিজেপি আর সিপিএম যাঁকে ‘বহিরাগত’ বলতেও ছাড়ছে না। খণ্ডন করতে সুব্রতবাবু বলছেন, ‘‘গুজরাতের মোদী যদি বারাণসীর সেবা করতে পারেন, তা হলে কলকাতা থেকে এসে বাঁকুড়া দেখতে পারব না কেন?’’ তৃণমূল প্রার্থী জানাচ্ছেন, আদতে তিনিও রাঢ়বঙ্গের মানুষ। বর্ধমানের নাদনঘাটই তাঁর আদি-ঘাট। ছলের অভাব নেই তৃণমূলেরও। বিজেপির প্রার্থীর নাম সুভাষ সরকার। আরও এক সুভাষ সরকারকে তারা ময়দানে হাজির করেছে। সুব্রতবাবুর কথায়, ‘‘শুনলাম দু’জন সুভাষ সরকার আমার বিরুদ্ধে লড়ছেন। দু’জনেই নাকি ডাক্তার। কোনটা আসল জানি না।’’
যা শুনে বিজেপি প্রার্থী সুভাষ সরকার বলছেন, ‘‘সুব্রতবাবু শ্রদ্ধেয় মানুষ। তাঁর বিরুদ্ধে একটি কথাও বলব না। কিন্তু তাঁর সব চেষ্টাই বৃথা হবে। সিপিএমের ‘ভৈরবরা’ এখন তৃণমূলের ‘ভাইপো’ হয়েছে। সেই বাহিনী যে ভাবে পঞ্চায়েত ভোট লুট করেছে আর বালি, পাথর, কয়লা, কাঠ, কংসাবতী-দামোদরের নদী ঘিরে সিন্ডিকেট চালাচ্ছে, তাতে মানুষ তিতিবিরক্ত। ভোট মেশিনেই তার জবাব দেবে।’’ কে ভাইপো? সুভাষবাবু জানাচ্ছেন, তিনিও ঠিক জানেন না। তবে বাঁকুড়াবাসী নাকি জানেন।
তৃণমূল প্রার্থীও মানছেন। কুকথা আর মানহানির আবহে বাঁকুড়া একটি দ্বীপ মাত্র। তিনি স্বীকার করেছেন, কোনও প্রার্থীই কাউকে ব্যক্তি আক্রমণ করছেন না। কারণ, আক্রমণের বেশির ভাগটাই ব্যয় করতে হচ্ছে বাঁকুড়ার জন্য তিনি কী কী করেছেন তা বলতে। সেই সঙ্গে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের শ্রী-সিরিজের কথা বলতেও ভুলছেন না সুব্রতবাবু। আর ভাইপোদের কারবার বলতেই সিপিএম-বিজেপির সময় চলে যাচ্ছে। যদিও ভাইপোরাই বাঁকুড়ায় তৃণমূলের একমাত্র ভরসা। ‘ভোটটা নাকি তাঁরাই করাবেন’— এ-ও শোনা যাচ্ছে সর্বত্র।
অঙ্ক অবশ্য অন্য কথা বলছে। ২০১৪-এর লোকসভায় তৃণমূল প্রার্থী মুনমুন সেন সিপিএম প্রার্থী বাসুদেব আচারিয়াকে প্রায় ৯৮ হাজার ভোটে হারিয়েছিলেন। তার মধ্যে ৫০ হাজার ব্যবধান এসেছিল রানিবাঁধ আর রায়পুর থেকে। প্রায় ২৫ হাজার ব্যবধান এসেছিল বাঁকুড়া সদর থেকে। এ বারে পরিস্থিতি ভিন্ন। বাসুদেব আচারিয়ার পরিবর্তে সিপিএম প্রার্থী হয়েছেন অমিয় পাত্র। বিজেপির হয়ে লড়ছেন সুভাষবাবুই। কিন্তু গত বিধানসভা ভোটের পর থেকে সিপিএম ক্রমেই প্রাসঙ্গিকতা হারিয়েছে। গত পঞ্চায়েত ভোটেও প্রধান বিরোধী দল হিসেবে উঠে এসেছে বিজেপি। যে রানিবাঁধ ও রায়পুর বিধানসভায় তৃণমূল সবচেয়ে বেশি ভোট পেয়েছিল, সেই জঙ্গলমহলে সমানে টক্কর দিচ্ছে পদ্মফুল। জঙ্গলমহলে পঞ্চায়েতে বিজেপির এক কর্মী খুনও হয়েছিলেন। আর গ্রামবাসীদের প্রতিরোধে এক তৃণমূল যুব নেতার গাড়ি জ্বলেছে। বিস্তর দাপাদাপির পরেও বেশ কয়েকটি পঞ্চায়েত দখল করেছে বিজেপি। সেই পরিপ্রেক্ষিতে জঙ্গলমহলে স্বস্তিতে নেই শাসক দল। রানিবাঁধ, রায়পুর, তালডাঙরা, শালতোড়ায় শাসক দলের তাই ভরসা ভোটে নয়, ভোট করানোয়। বাঁকুড়া লোকসভার মধ্যেই পড়ছে পুরুলিয়ার রঘুনাথপুর বিধানসভা কেন্দ্র। গত পঞ্চায়েতে শাসকের থেকেও তাদের ভাল ফল হয়েছে বলে দাবি বিজেপির। বিজেপির অভিযোগ, গণনা কেন্দ্রে কারচুপি করে রঘুনাথপুর পঞ্চায়েত সমিতির অধিকাংশ আসন দখল নিয়েছিল তৃণমূল। এ বার সাধারণ ভোটারেরা প্রকাশ্যেই বলছেন, ভোট দেওয়ার সুযোগ পেলে তাঁরাও এক বার দেখবেন।
দেখতে হচ্ছে সুব্রতবাবুকেও। শুধু নিজের ভোট নয়, অমিয় পাত্র কত ভোট পাচ্ছেন, কত ভাল প্রচার করছেন, কেন সব স্থানে যাচ্ছেন না, তা নিয়েও উদ্বেগে তৃণমূল প্রার্থী। বলছেনও, ‘‘সিপিএমের আরও একটু ভাল করা উচিত। আরও প্রচার করা উচিত।’’ যা শুনে অমিয়বাবুর জবাব, সিপিএম ভালই করবে। ভোটের পরেই সুব্রতবাবু তা বুঝবেন। বাঁকুড়ার মাটিতে আর যেই জিতুন তৃণমূল জিতছে না, তা-ও আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলছেন অমিয় পাত্র। বাকুঁড়ার এক সময়ের ‘শেষ কথা’ যদিও ভোট মরসুমের পড়ন্ত বিকেলে পার্টি অফিসেই কথা বলতে পছন্দ করলেন। জানালেন, সিপিএম মরে যায়নি। শহরে যা রোড শো হয়েছে, তাতেই প্রমাণ হয়ে গিয়েছে। তবে রামের নামে নতুন ভোটারদের মধ্যে কিঞ্চিৎ যে উন্মাদনা রয়েছে তা-ও মানলেন সিপিএমের ওই নেতা।
সেই উন্মাদনাকেই সংগঠন দিয়ে রুখতে চায় তৃণমূল। হ্যাঁ, অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের তৃণমূল। সুব্রত মুখোপাধ্যায় সেখানে ঢালমাত্র। আসলে ভোট সামলাচ্ছেন অভিষেকের লোকেরাই। তাতে অমিয় যদি চাহিদা মতো ‘পাত্রস্থ’ হন, তা হলে সুভাষের দিল্লি যাওয়া নিয়ে সংশয় থাকবে।