ভোট শিকেয় তুলে শুধুই তারকা-স্তুতি

কোনও মতে ভক্তকে পাশ কাটিয়ে কার্যালয়ে ঢুকে ঘাটালের বিদায়ী সাংসদ তথা এ বারের তৃণমূল প্রার্থী দীপক অধিকারী (দেব) বললেন, ‘‘উফ! এই নিয়েই চলতে হয়।

Advertisement

নীলোৎপল বিশ্বাস

কলকাতা শেষ আপডেট: ১৫ মে ২০১৯ ০১:০৬
Share:

দর্শনপ্রার্থী: ভোটের বুথে দেবের সঙ্গে নিজস্বী তুলছেন এক ভক্ত। ছবি: দেবস্মিতা ভট্টাচার্য।

প্রায় ৪০ ডিগ্রি গরম আর ধুলো ভরা রাস্তা পেরিয়ে ১২ মে ছুটছেন তিনি। সদ্য এক গুলিবিদ্ধের পরিবারকে আশ্বস্ত করে চড়া রোদে স্থানীয় তৃণমূল কার্যালয়ে ঢুকছেন। কালো এসইউভি থেকে নামা তারকা প্রার্থীর গায়ে গায়ে হাঁটতে শুরু করলেন এক যুবক। হাতের মোবাইল ফোনের সেলফি ক্যামেরা চালু করে দিয়ে ঘামতে থাকা তারকাকে বললেন, ‘‘আপনি দেব, আমি জিৎ। চলুন আমরা দুই পৃথিবী গান করি। আমার সঙ্গে গলা মেলান!’’

Advertisement

কোনও মতে ভক্তকে পাশ কাটিয়ে কার্যালয়ে ঢুকে ঘাটালের বিদায়ী সাংসদ তথা এ বারের তৃণমূল প্রার্থী দীপক অধিকারী (দেব) বললেন, ‘‘উফ! এই নিয়েই চলতে হয়। গুলিবিদ্ধের ভেঙে পড়া পরিবারের সঙ্গে কথা বলে বেরিয়ে এ সব নাচ-গান ভাল লাগে?’’ আশাহত ভক্ত বললেন, ‘‘দেবদার সঙ্গে লাইভ করব বলে এত ক্ষণ অপেক্ষা করছিলাম। এখনও ভোটটাই দিইনি। থাক আর যাব না!’’

রাজ্যে ছ’দফা ভোটগ্রহণ পর্ব অতিক্রান্ত। যেখানেই তারকা প্রার্থী দাঁড়িয়েছেন, সেখানেই দেখা গিয়েছে এই চিত্র। ভোটের দিন শান্তিপূর্ণ ভোট হচ্ছে কি না দেখতে বেরোলে তাঁদের নিয়েই হুলুস্থূল চলেছে সর্বত্র। ভোটের বুথে দেব, মুনমুন সেন, শতাব্দী রায়ের মতো তারকার গতি কমে গিয়েছে সেলফি, অটোগ্রাফের আব্দার মেটাতে গিয়ে। ভোটের লাইন ছেড়ে ভোটারেরা ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন তখন তারকাদের ক্যামেরা-বন্দি করতে। ফিরে এসে লাইনে দাঁড়াতে গিয়ে তাঁদেরই শুনতে হল, ‘‘যাও! আরও ছবি তোলো! পুলিশকে বলে দেব, বেলাইনে যেন কাউকে ঢুকতে না দেওয়া হয়।’’ কিন্তু বলবেন কাকে? নিরাপত্তারক্ষীরাও তখন তারকাচ্ছন্ন। বন্দুক একপাশে দাঁড় করিয়ে রেখে তারকাদের দিকে পেন আর কাগজ এগিয়ে দিয়ে তাঁদেরও বলতে শোনা গিয়েছে, ‘‘আপনাদের তো এ ভাবে সব সময়ে পাওয়া যায় না। তাই একটা ছবি নিয়ে রাখছি।’’

Advertisement

আগামী ১৯ তারিখ রাজ্যে শেষ দফার নির্বাচন। শহর কলকাতার পাশাপাশি বারাসত, দমদম, যাদবপুর, বসিরহাটের মতো কেন্দ্রে ভোট রয়েছে ওই দিন। এই দফায় রয়েছেন মিমি, নুসরতের মতো তারকা প্রার্থীরা। তাঁদের ঘিরেও ভোট বুথের চিত্রটা আলাদা হবে না বলেই মত অনেকের। সদ্য ভোট মিটে যাওয়া তারকা প্রার্থী মুনমুন সেন চোখ টিপে বললেন, ‘‘মানুষ আমাদের ছুঁতে চায়। তবে আমাদের দেখে নিয়ে, ছবি তুলে ওঁরা ঠিকঠাক ভোট দিয়েছেন বলেই আমার বিশ্বাস।’’

ভোটের দিন মুনমুনের সঙ্গে ঘুরে অবশ্য দেখা গিয়েছিল অন্য চিত্র। আসানসোলের এক বুথে তখন ঢুকেছেন সুচিত্রা-কন্যা। বোর্ড ঘেরা ইভিএম মেশিনের সামনে দাঁড়িয়ে ছিলেন এক ব্যক্তি। মুনমুনকে দেখেই ভোট দেওয়া ছেড়ে সেলফি তুলতে হাজির তিনি। কয়েক দফা ছবি তোলার আব্দার জানিয়েও ভিড়ের মধ্যে আশাপূরণ না হওয়ায় ফের তিনি ফিরে যান ইভিএমের সামনে। প্রিসাইডিং অফিসার তাঁকে বলে দেন, ‘‘হয়ে গিয়েছে। পরের জনকে ছেড়ে দিন।’’ তাতে অবশ্য একটুও দুঃখিত দেখাল না ওই ব্যক্তিকে। ভোটও হল না, সেলফিও না? ভদ্রলোকের উত্তর, ‘‘ওঁকে দেখে নিয়েছি, এতেই আনন্দ।’’ আর এক তারকা প্রার্থী শতাব্দীকে দেখতে গিয়ে আবার ভোটার কার্ডই হারিয়ে ফেলেছিলেন এক যুবক। বললেন, ‘‘হুড়োহুড়ির মধ্যে লাইন ছেড়ে একটা ছবি তুলতে গিয়েছিলাম। ভোটার কার্ডটা তখনই কোথাও পড়ে যায়। বিকেল সাড়ে ৪টে নাগাদ ওটা ফিরে পাই। তার পরে ভোট দিই।’’ যুবকের অভিযোগ, এক রাজনৈতিক দলের বুথ-কর্মী ইচ্ছে করেই কার্ডটা লুকিয়ে রেখেছিলেন।

মনোরোগ চিকিৎসক অনিরুদ্ধ দেব বলেন, ‘‘উৎসব মানেই এখন ছবি তোলা। পুজোর সময়ে মণ্ডপে এখন বেশি ভিড়ের জট হয় ক্যামেরায় ছবি তোলার জন্য। ভোটও তো উৎসব। সেই উৎসবে যদি তারকার দেখা পাওয়া যায়, ছবি তো উঠবেই। তাতে ভোট হোক চাই না হোক, কী যায় আসে!’’

মনে পড়ে যায় আর এক দৃশ্য।

তাঁদের কর্মীকে বুথে বসতে দেওয়া হয়নি অভিযোগ পেয়ে একটি স্কুলের বুথে ঢুকছিলেন দেব। ঘিয়ে রঙের হুডি, চোখে নীল চশমা পরা তারকাকে দেখে পথ আটকে দাঁড়ান লাল জুতো পায়ে এক যুবক। হঠাৎ চিৎকার শুরু করেন, ‘‘লে পাগলু ডান্স, ডান্স!’’ অভিনেতা বললেন, ‘‘সাইড দিন প্লিজ়!’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন