লোকসভা কেন্দ্র: কোচবিহার

বিজেপিকে এখন তাড়া করছে ‘তৃণমূল অতীত’

যুবরাজের মৃগয়ায় বেরোনোর ঢংয়ে প্রচারে বেরোলেন ৩৩ বছরের যুবক ভোটপ্রার্থী। তাঁকে ঘিরে টগবগে তরুণ বলয় আর ওয়াই ক্যাটেগরির সশস্ত্র নিরাপত্তারক্ষী।

Advertisement

রোশনী মুখোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ০৮ এপ্রিল ২০১৯ ০২:৫৫
Share:

কোচবিহারের বিজেপি প্রার্থী নিশীথ প্রামাণিক। - নিজস্ব চিত্র

‘‘দাদা, একটা মোবাইল দেবেন?’’

Advertisement

দরাজ গলায় জবাব এল, ‘‘পাবি বাবা, পাবি।’’

যুবরাজের মৃগয়ায় বেরোনোর ঢংয়ে প্রচারে বেরোলেন ৩৩ বছরের যুবক ভোটপ্রার্থী। তাঁকে ঘিরে টগবগে তরুণ বলয় আর ওয়াই ক্যাটেগরির সশস্ত্র নিরাপত্তারক্ষী। গাড়ির ঢেউ তুলে চলছেন। সঙ্গীদের মুক্ত হস্তে দান করছেন। ভোর-রাত পর্যন্ত বৈঠক করছেন। বেলা পর্যন্ত ঘুমোচ্ছেন। এবং মধ্য দুপুরে প্রচারে বেরোচ্ছেন।

Advertisement

তিনি কোচবিহার লোকসভা কেন্দ্রের বিজেপি প্রার্থী নিশীথ প্রামাণিক। মাত্র চার মাস আগেও যিনি ছিলেন তৃণমূলে। গত বছর পঞ্চায়েত ভোটেও তৃণমূলের হয়ে এলাকা দাপিয়ে বেড়িয়েছেন। গত ডিসেম্বরে ‘দল-বিরোধী’ কাজের জন্য তৃণমূল তাঁকে বহিষ্কার করার পর ফেব্রুয়ারি মাসে বিজেপিতে যোগ গিয়েই পদ্মফুল প্রতীকে প্রার্থী হয়েছেন।

বিপরীতে রয়েছেন বাম আমলে মন্ত্রীর দায়িত্ব সামলে ফরওয়ার্ড ব্লক ছেড়ে আসা পোড়খাওয়া নেতা পরেশ অধিকারী। কোচবিহারে দলের বিদায়ী সাংসদ পার্থপ্রতিম রায়কে টিকিট না দিয়ে এ বার ‘বহিরাগত’ পরেশবাবুকে প্রার্থী করেছে তৃণমূল। যার ফলে পার্থ কিঞ্চিৎ ‘মনঃক্ষুণ্ণ’ বলে জনশ্রুতি আছে। ২০১৬ সালে কোচবিহার লোকসভা কেন্দ্রের উপনির্বাচনে ৪ লক্ষ ১৩ হাজার ভোটে জিতে সাংসদ হন যুব তৃণমূলের এই জেলা সভাপতি। তিন বছরেই সাংসদ তহবিলের পুরো টাকা খরচ করেছেন। পেশায় স্কুলে ইংরেজির শিক্ষক পার্থর ভাবমূর্তি নিয়েও তেমন কোনও প্রশ্ন নেই। তা সত্ত্বেও তৃণমূল তাঁকে প্রার্থী করল না কেন, সেই প্রশ্নটি ভাসছে কোচবিহারের হাওয়ায়।

অর্থাৎ, কোচবিহার লোকসভায় লড়াইয়ের কেন্দ্রে এ বার শুধুই তৃণমূল। এক জন প্রচ্ছন্ন তৃণমূল। এক জন প্রত্যক্ষ তৃণমূল। আর এক জন কি প্রতিপক্ষ তৃণমূল?

প্রথম জনের ‘তৃণমূল অতীত’ বিজেপিকে তাড়া করছে। নিশীথের বিরুদ্ধে চুরি, ডাকাতি-সহ ১১টি ফৌজদারি মামলা বিচারাধীন। এখন তৃণমূল তাঁর বিরুদ্ধে ওই পুরনো অভিযোগের কথা টেনে প্রচার করছে। যদিও নিশীথের দাবি, ‘‘আমাকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মিথ্যা মামলায় ফাঁসানো হয়েছে।’’ কিন্তু বিজেপিরই একাংশ তাঁকে ‘স্মাগলার’ বলে অভিযোগ তুলে বিক্ষোভ দেখাল কেন? বস্তুত, জেলা বিজেপি এবং আরএসএস-এর সকলে এখনও মন থেকে নিশীথকে মানতে পারছেন না। তাঁদের প্রশ্ন, পঞ্চায়েতে ভোটে সন্ত্রাস করার অভিযোগে যিনি বিদ্ধ, তাঁকে ভোটাররা পছন্দ করবেন কেন? নিশীথ অবশ্য বলছেন, ‘‘আমি প্রার্থী হওয়ার পর যে বিক্ষোভ হয়েছে, তাতে বিজেপির কেউ ছিলেন না। ওটা তৃণমূলের সাজানো।’’

প্রত্যক্ষ তৃণমূল প্রার্থী পরেশবাবুর বিরুদ্ধেও প্রচার আছে— তাঁর মেয়েকে স্কুল সার্ভিস কমিশন মারফত শিক্ষকতার চাকরি ‘পাইয়ে দেওয়া’ হয়েছে। এসএসসি-র চাকরিপ্রার্থীরা যখন রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে আন্দোলন করছেন, তখন এই প্রচার পরেশবাবুকে বিপদে ফেলতে পারে বলে মনে করছে বিরোধীরা। পরেশবাবুর অবশ্য বক্তব্য, ‘‘ও সব অসত্য প্রচার। আমার তৃণমূলে যোগদান এবং আমার মেয়ের চাকরি পাওয়ার সময় ঘটনাচক্রে মিলে গিয়েছে!’’

দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯

তৃতীয় জন পার্থ অবশ্য নিজেকে ‘প্রতিপক্ষ তৃণমূল’ হিসাবে মানতে রাজি নন। তাঁর বক্তব্য, ‘‘পরেশবাবুর জন্য প্রথম কর্মিসভা আমিই করেছি। দলনেত্রীর প্রার্থীকে মানতে আমার কোনও অসুবিধা নেই।’’ তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও জানিয়েছেন, পার্থকে দলের অন্য কাজে লাগানো হবে। দিনহাটার বিধায়ক উদয়ন গুহ ফরওয়ার্ড ব্লক থেকে আসায় প্রাচীন তৃণমূলের সকলের সঙ্গে তাঁর বনিবনা নেই বলেও শোনা যায়। তিনি কি পরেশবাবুর জন্য প্রচার করছেন? দিনহাটার নাজিরহাটে প্রচারসভার ফাঁকে উদয়নবাবু বলেন, ‘‘আমার বিধানসভায় আমি প্রচার করছি।’’

শাসক তৃণমূল অবশ্য দৃশ্যত নিশ্চিন্ত। দলের কোচবিহার জেলা সভাপতি রবীন্দ্রনাথ ঘোষ বলছেন, ‘‘আমরা পাঁচ লক্ষের বেশি ভোটে জিতব।’’ পঞ্চায়েতে সন্ত্রাস, ভোট দিতে না দেওয়ার অভিযোগও ‘অপপ্রচার’ বলে উড়িয়ে দিচ্ছেন রবীন্দ্রনাথবাবু। কিন্তু কোচবিহারে তৃণমূল গোষ্ঠী-দ্বন্দ্বে জর্জরিত বলে দলেরই একাংশের অভিযোগ। রবীন্দ্রনাথবাবুর অবশ্য দাবি, ‘‘দলে কোনও গোষ্ঠী-দ্বন্দ্ব নেই। একটিই গোষ্ঠী। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের গোষ্ঠী।’’ রবীন্দ্রনাথবাবুর প্রত্যয়ী সংযোজন, ‘‘আমাদের ২ লক্ষ ৩০ হাজার কর্মী বুথ স্তরে কাজ করছেন। আর বিজেপির সব বুথে সংগঠনই নেই! শুধু গাড়ি নিয়ে রাস্তায় প্রচার করে কি ভোট হয়?’’ কোচবিহারের অনেক বাসিন্দাই কর্ম অথবা বিবাহসূত্রে প্রতিবেশী রাজ্য অসমে থাকেন। এনআরসি-র ফলে তাঁদের অনেকেই যে ভোগান্তির শিকার হয়েছেন, ভোটের মাঠে বিজেপিকে হারাতে তা-ও মনে করাচ্ছেন

তৃণমূল প্রার্থী।

জলপাইগুড়ির কেন্দ্রীয় সমবায় ব্যাঙ্কের প্রাক্তন চেয়ারম্যান গোবিন্দ রায়ের রাজবংশী পরিচয় কাজে লাগিয়ে তাঁকে জলপাইগুড়ির বেরুবাড়ি থেকে এনে কোচবিহারে প্রার্থী করেছে ফরওয়ার্ড ব্লক। তাঁকে প্রার্থী করা নিয়ে বামফ্রন্টের অন্দরে ক্ষোভ আছে। তার উপরে তিনিও অভিযোগের ঊর্ধ্বে নন। আলু কেলেঙ্কারিতে জড়িত থাকার অভিযোগে ৯৮ দিন জেলে থাকতে হয়েছিল তাঁকে। তিনি অবশ্য ওই অভিযোগের অসত্যতা সবিস্তার ব্যাখ্যা করছেন। আর মজা করে বলছেন, ‘‘দুই ফুলের দ্বন্দ্ব, মাঝখানে জিতে যাবে গোবিন্দ!’’ তবে প্রচারের জৌলুসে তৃণমূল এবং বিজেপির ধারে-কাছেও নেই বামফ্রন্ট প্রার্থী। তিন বছর আগে কোচবিহার লোকসভায় উপনির্বাচনের পর থেকেই জেলায় তৃণমূল এবং বিজেপির পরে তৃতীয় স্থানে নেমে গিয়েছে বামেরা। এ বার তাদের লড়াই আরও ভোটক্ষয় ঠেকানোর।

কোচবিহারের কংগ্রেস প্রার্থী পিয়া রায়চৌধুরী অন্য তিন দলের প্রার্থীদের থেকে একটি বিষয়ে আলাদা। তাঁর বিরুদ্ধে কোনও অভিযোগমূলক প্রচার নেই। স্কুলে ভূগোলের শিক্ষিকা পিয়া কোচবিহার শহরে থাকেন। বাসে চেপে ৬০ কিলোমিটার দূরে শীতলখুচিতে স্কুলে যাওয়া-আসা তাঁর। কবিতা লেখেন, কবিতা শোনান। কিন্তু কংগ্রেস যে লড়াইতে আছে, শহরে ঘুরে তা বোঝার উপায় নেই। পিয়া অবশ্য বলছেন, ‘‘প্রচারে বেরিয়ে আমি দারুণ সাড়া পাচ্ছি।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন