বাড়ি ঢুকে কিঞ্চিৎ বিমর্ষ? শিয়রে সিবিআই ডাকের খাঁড়া, তাই? চিকিৎসকদের অবশ্য নিদান, সাত দিন মনে দাগা দেওয়া চলবে না!। ছবি: সুদীপ্ত ভৌমিক।
ছাড়া পেলেন বটে। তবে আগামী এক সপ্তাহ মন্ত্রীমশাইয়ের মনের উপরে কোনও চাপ দেওয়া যাবে না।
বুধবার পরিবহণমন্ত্রী মদন মিত্রকে এসএসকেএম থেকে ছাড়ার সময়ে পরিজনদের এটাই পইপই করে বলেছেন চিকিৎসকেরা। যাঁঁদের হুঁশিয়ারি, “সপ্তাহখানেক ওঁর উপরে মানসিক চাপ তৈরি না-হলেই ভাল। হলে কিন্তু ফের অসুস্থ হয়ে পড়তে পারেন।”
অর্থাৎ, শারীরিক ভাবে আপাত সুস্থ মন্ত্রীর মানসিক অবস্থাকে এখনও পুরোপুরি ফিটনেস সার্টিফিকেট দেওয়া যাচ্ছে না। এক মনের ডাক্তারের কথায়, “ওঁর বারবার প্যানিক অ্যাটাক হচ্ছে। মনের উপর চাপ তো পড়বেই!” মদনবাবু পুজোর মুখেও এক বার হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। তখন সিবিআই তাঁর পূর্বতন আপ্ত সহায়ক ও ঘনিষ্ঠ এক ব্যক্তিকে সমন পাঠিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করেছিল। আর তিনি এই দফায় হাসপাতাল ভর্তি হওয়ার ঠিক পরে পরে সিবিআই তাঁকে তলব করেছে, সারদা-কাণ্ডে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য। দলে মদনকে যাঁরা সহ্য করতে পারেন না, তাঁদের বক্তব্য, সিবিআই-ডাকের আঁচ পেয়েই উনি হাসপাতালে ঢুকে আশ্রয় নিয়েছিলেন।
এমতাবস্থায় তাঁর মানসিক শান্তি নিয়ে চিকিৎসকেরা যতই উদ্বিগ্ন হোন না কেন, মন্ত্রীমশাই ততটা ভাবিত নন। অন্তত বহিরঙ্গে। এ যাত্রায় বেসরকারি-সরকারি দু’টি হাসপাতাল মিলিয়ে মোট দশ দিন রোগশয্যায় কাটিয়ে বাড়ি ফিরে এ দিন তাঁর দাবি, মনের উপরে কোনও চাপ নেই। তা হলে কি পুরোপুরি সুস্থ? অভিজ্ঞ চিকিৎসকের মতো গলা ভারী করে মন্ত্রী বলেছেন, “ফুসফুসের দুর্বলতা রয়েই গিয়েছে।”
মঙ্গলবার এসএসকেএমের ডাক্তারেরা জানিয়েছিলেন, মদনবাবুর সব সময়ের জন্য ফিজিওথেরাপিস্ট (বেডসাইড ফিজিওফেরাপিস্ট) দরকার। এ দিন তাঁকে ছাড়ার সময়ে এসএসকেএমের মেডিক্যাল বোর্ডের বলবৎ করা বিধি-নিষেধেও বলা হয়েছে, আরও অন্তত সাত দিন ওঁকে বাড়িতে বেডসাইড ফিজিওথেরাপিস্ট রাখতে হবে। কিন্তু এ দিন মন্ত্রীমশাই হাসপাতালে যে ভাবে হেঁটে হেঁঁটে অ্যাম্বুল্যান্সে উঠলেন, আর বাড়ি পৌঁছে অ্যাম্বুল্যান্স থেকে হেঁটে নামলেন, তাতে তাঁর শারীরিক সক্ষমতা সম্পর্কে প্রশ্ন তোলার যৌক্তিকতা ঘিরে বিতর্ক বাঁধার যথেষ্ট অবকাশ। তবে মেডিক্যাল বোর্ডের পর্যবেক্ষণ, মদনবাবু এখনও পুরো ফিট নন। সাত দিন বাদে বোর্ড ফের তাঁকে পরীক্ষা করবে।
গত সপ্তাহে বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি থাকাকালীন মদনবাবু সিবিআইয়ের ডাক পান। দু’দিনের মধ্যে তিনি মিন্টো পার্কের বেসরকারি হাসপাতালটি থেকে তড়িঘড়ি চলে যান এসএসকেএমে। তার আগে অবশ্য কৌঁসুলি মারফত সিবিআই’কে জানিয়ে দিয়েছিলেন, সুস্থ হয়ে উঠে তিনি-ই যাবেন সিবিআইয়ের দরজায়। স্বভাবতই এ দিন হাসপাতাল ছাড়ার পরে মন্ত্রীর দিকে ধেয়ে এল একটাই প্রশ্ন সিবিআইয়ের কাছে যাচ্ছেন কবে?
মন্ত্রী বলেন, “এ বার সিবিআই বললেই চলে যাব।” তাঁর সংযোজন, “আমার দলের কেউই তো বলেননি যে, যাব না! সিবিআই আমাকে সময় দিয়েছিল। আমি অসুস্থ থাকায় যেতে পারিনি। সিবিআই-কে তা জানিয়েওছি। আমি যে ছাড়া পেয়েছি, নিশ্চয়ই ওঁরা খবর পেয়ে গিয়েছেন।” ডাক্তারেরা তো টেনশন নিতে বারণ করেছেন। না-নিয়ে পারবেন? মদনের জবাব, “চেষ্টা করব, যাতে টেনশন না হয়।” নিজের অফিসে গিয়ে কাজ শুরু করবেন কবে?
সাদা পাজামা, হলুদ কুর্তা আর পায়ে কালো স্নিকার পরে ভবানীপুরের বাড়ির সামনে চেয়ারে বসে থাকা মন্ত্রীমশাই বললেন, “এখনই নয়। এখন একটু বিশ্রাম চাই।” বাড়ি থাকলে বিশ্রাম হবে?
মদনবাবু জানাচ্ছেন, তিনি আপাতত ভবানীপুরের বাড়িতে থাকবেন না। “ভাবছি, স্ত্রীকে নিয়ে ক’দিন দক্ষিণেশ্বরের বাড়িতে থাকব। ওটা তো আমার বিধানসভা এলাকাও। ওখানে একটু সময়ও দেওয়া দরকার।” বলেন পরিবহণমন্ত্রী।
ঘটনা হল, মদনবাবু হাসপাতালে ভর্তি থাকার সময় এক শোভনদেব চট্টোপাধ্যায় ছাড়া দলীয় সতীর্থদের কেউই দেখা করতে যাননি। বেসরকারি হাসপাতালে থাকাকালীন দলনেত্রী দু’বার ফোন করেছিলেন। এক বার মিলেছে অভয়, এক বার ভর্ৎসনা। হাসপাতাল ছাড়ার আগে নেত্রীর সঙ্গে কথা হয়েছে কিনা জানতে চাইলে এ দিন মদন বলেন, “মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজে রাস্তায় আছেন।”
হাসপাতাল-সূত্রের খবর, মুখ্যমন্ত্রী তথা স্বাস্থ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নির্দেশ আসার পরেই এ দিন মেডিক্যাল বোর্ড বসিয়ে মদনকে ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় এসএসকেএম। নেত্রীর কাছ থেকে মন্ত্রীর মুক্তি-সঙ্কেত আসার খবর সকালেই মদন-ঘনিষ্ঠেরা জেনে যান। হাসপাতাল চত্বরে ইতিউতি জটলা শুরু হয়। বেলা দেড়টা নাগাদ মেডিক্যাল বোর্ড জানিয়ে দেয়, মন্ত্রীকে বাড়ি নিয়ে যেতে বলা হয়েছে। বোর্ডের কী রায়?
মেডিক্যাল বোর্ডের সদস্য অরুণাভ সেনগুপ্ত বলেন, মদনবাবুর হাইপার টেনশন, ডায়াবেটিস, ইস্কিমিক হার্ট ডিজিজ, অবস্ট্রাকটিভ সিওপিডি, স্লিপ অ্যাপনিয়া, পিঠে টিউমার (লাইপোমা), এবং মানসিক অবসাদ রয়েছে। তাঁকে মনোবিদের পরামর্শ নিতে বলা হয়েছে। সম্প্রতি প্রস্টেটে কিছু সমস্যা (প্রস্টোমেগ্যালি) দেখা দিয়েছে। কিডনিতেও সামান্য গোলমাল ধরা পড়ায় নেফ্রোলজিস্ট রাজেন পাণ্ডেকে মেডিক্যাল বোর্ডে আনা হয়েছে। ডাক্তারবাবুরা জানান, মন্ত্রীকে আগামী এক সপ্তাহ পূর্ণ বিশ্রামে থাকতে হবে। বাড়িতে থেকে নিয়মিত ওষুধপত্র খেতে হবে, সঙ্গে ফিজিওথেরাপি। শরীরে এত সব সমস্যা নিয়ে সিবিআইয়ের বাড়তি চাপ উনি নিতে পারবেন কি?
মন্ত্রীমশাইয়ের এক অনুগামীর মন্তব্য, “মেডিক্যাল বোর্ড কী কী বলেছে, সিবিআই নিশ্চয়ই তা শুনেছে। এ বার ওদেরই সিদ্ধান্ত নিতে হবে।” আর মন্ত্রীমশাই মুখে ‘সিবিআই ডাকলেই চলে যাব’ বললেও তাঁর বডি ল্যাঙ্গুয়েজ যেন বলছে, তিনি আর আগের মানুষটি নেই। সব কিছুকে ‘ডোন্ট কেয়ার’ করা মদন মিত্র কি তা হলে ভয় পেলেন?
প্রশ্ন শুনে সোজা হয়ে বসলেন। ছুড়ে দিলেন পাল্টা প্রশ্ন “দেখে কী মনে হচ্ছে?”
সত্যি বলতে কী, মন্ত্রীমশাইয়ের গলায় সেই ‘মদন মিত্রসুলভ’ জোশটাই যেন পাওয়া গেল না!