মাস তিনেক আগে তাঁর এজলাসেই এসেছিল সারদা কেলেঙ্কারিতে ধৃত ক্রীড়া ও পরিবহণমন্ত্রী মদন মিত্রের জামিনের আবেদনের মামলা। তার পরে সেটি সরিয়েও নেওয়া হয়। নিম্ন আদালত এবং কলকাতা হাইকোর্টের অন্য বেঞ্চ ছুঁয়ে বৃহস্পতিবার মামলাটি শেষ পর্যন্ত ফিরে এল বিচারপতি নিশীথা মাত্রের ডিভিশন বেঞ্চেই। আজ, শুক্রবার তার শুনানি হতে পারে।
হাইকোর্টের বিভিন্ন বিচারপতি এর আগে ব্যক্তিগত ও অন্যান্য কারণে মন্ত্রীর মামলাটি নিতে চাননি। তবে বিচারপতি মাত্রের বেঞ্চ কখনওই বলেনি যে, তারা মদনবাবুর জামিনের আবেদন শুনবে না। বস্তুত, প্রথম বারেই মামলাটি যখন ওই এজলাসে যায়, বেঞ্চ তা শুনতে তৈরিই ছিল। কিন্তু আবেদনকারীরা নিম্ন আদালতে চলে যাওয়ায় সে-বার ওই বেঞ্চে আর শুনানি হয়নি। প্রবীণ আইনজীবীরা অনুমান করছিলেন, মামলাটি যদি বিচারপতি মাত্রের এজলাসে ফিরে আসে, তাঁর বেঞ্চ সেটি শুনতেও পারে। কারণ, আগের দফায় ওই বেঞ্চ মামলাটি শুনতে রাজি ছিল। এ দিন হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি মঞ্জুলা চেল্লুরের কার্যালয় মামলাটি ফেরত পাঠায় বিচারপতি মাত্রের বেঞ্চেই। তাই শুনানির সম্ভাবনা উজ্জ্বল হয়েছে বলে হাইকোর্ট সূত্রের খবর।
তবে বিচারপতি মাত্রের বেঞ্চে ফেরত আসার আগে মামলাটিকে নিম্ন ও উচ্চ আদালত মিলিয়ে পেরিয়ে আসতে হয়েছে দীর্ঘ পথ। সারদা গোষ্ঠীর আর্থিক কেলেঙ্কারিতে ধৃতদের মধ্যে প্রাক্তন পুলিশকর্তা রজত মজুমদার, ব্যবসায়ী সৃঞ্জয় বসু, ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের কর্মকর্তা দেবব্রত ওরফে নিতু সরকারের মতো অনেকেই এর আগে জামিন পেয়ে গিয়েছেন। কেউ নিম্ন আদালতে। কেউ বা হাইকোর্টে। মামলা শুনতে কয়েক জন বিচারপতির অনীহা ছাড়াও অন্যান্য কারণে মদনবাবুর জামিনের মামলা বিলম্বিত হচ্ছে। কখনও শুনানি পিছিয়েছে সব পক্ষ মামলার নথি না-পাওয়ায়। কখনও বা এক পক্ষের কৌঁসুলিই হাজির হননি আদালতে।
সারদা কাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগে গত ১২ ডিসেম্বর মদনবাবুকে গ্রেফতার করে সিবিআই। দু’দফায় তাঁকে নিজেদের হেফাজতে নিয়ে জেরাও করে ওই কেন্দ্রীয় তদন্ত সংস্থা। আদালত মদনবাবুকে জেল-হাজতে পাঠায়। কিন্তু অসুস্থতার কারণে জেল-কর্তৃপক্ষ তাঁকে এসএসকেএম হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে দেন। কাগজে-কলমে জেল হেফাজতে থাকলেও চিকিৎসাধীন বন্দি হিসেবে মদনবাবু এখন ওই হাসপাতালেরই বাসিন্দা।
পিজি-র উডবার্ন ওয়ার্ড থেকেই জামিন চেয়ে বারবার নিম্ন আদালতে আবেদন জানাতে থাকেন মদনবাবু। সেখানে একাধিক বার আর্জি খারিজ হয়ে যাওয়ায় তিনি হাইকোর্টের দ্বারস্থ হন। কিন্তু বিচারপতি অসীম রায় ও বিচারপতি ইন্দিরা বন্দ্যোপাধ্যায় ব্যক্তিগত কারণ দেখিয়ে জামিনের আবেদন শুনতেই চাননি। ব্যক্তিগত কারণটা কী, বিচারপতি রায় তা জানাননি। আর বিচারপতি বন্দ্যোপাধ্যায় জানিয়েছিলেন, তিনি মদনবাবুর ছেলের বিয়ের অনুষ্ঠানের নিমন্ত্রণ পেয়েছিলেন। তিনি সেখানে না-গেলেও ব্যক্তিগত কারণে ওই অভিযুক্তের জামিনের আবেদনের মামলা শুনতে পারবেন না।
বিচারপতি ইন্দিরা বন্দ্যোপাধ্যায় মামলা ছেড়ে দেওয়ার পরে প্রধান বিচারপতি চেল্লুরের কার্যালয় গত ২১ এপ্রিল জামিনের আবেদনটি পাঠিয়ে দেয় বিচারপতি মাত্রের ডিভিশন বেঞ্চে। পরের দিন মামলাটি শুনানির জন্য উঠলে মদনবাবুর আইনজীবী শেখর বসু ও মিলন মুখোপাধ্যায় ওই বেঞ্চে জানান, তাঁরা আগে আলিপুর জেলা জজের আদালতে জামিনের আবেদন জানাতে চান। তাই হাইকোর্ট থেকে মামলাটি প্রত্যাহার করে নিতে চাইছেন। মন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ মহল সূত্রের খবর, হাইকোর্টে যখন জামিনের আবেদন জানানো হয়েছিল, সিবিআই তখনও মদনবাবুর বিরুদ্ধে নিম্ন আদালতে চার্জশিট পেশ করেনি। চার্জশিট দাখিলের পরে নিয়ম অনুযায়ী প্রথমে নিম্ন আদালতে জামিনের আর্জি জানানোটাই প্রথা। সেখানে আবেদন খারিজ হয়ে গেলে আর্জি জানাতে হয় জেলা জজের আদালতে। সেখানেও আর্জি নামঞ্জুর হলে আবেদনকারী উচ্চ আদালতের দ্বারস্থ হতে পারেন। তাই বিচারপতি মাত্রের বেঞ্চ থেকে মামলা সরিয়ে নিয়ে মন্ত্রী নিম্ন আদালতে যান।
কিন্তু আলিপুর জেলা জজের আদালতে সুবিচার মিলবে না বলে আশঙ্কা করছিল সিবিআই। তাই মদনবাবু নিম্ন আদালতের দ্বারস্থ হলেও সেই মামলা অন্য কোনও আদালতে পাঠানোর জন্য হাইকোর্টে আবেদন জানায় কেন্দ্রীয় তদন্ত সংস্থা। হাইকোর্টের বিচারপতি রঞ্জিতকুমার বাগ তখন মামলাটি কলকাতার নগর দায়রা আদালতে পাঠানোর নির্দেশ দেন। মদনবাবুর জামিনের আবেদন খারিজ করে দেন নগর দায়রা আদালতের বিচারক। তার পরে ফের আইনজীবী মারফত হাইকোর্টে জামিনের আবেদন জানান মন্ত্রী। সেই মামলা যায় বিচারপতি গিরীশ গুপ্তের ডিভিশন বেঞ্চে। মদনবাবুর তরফে আইনজীবী সুরেন্দ্রকুমার কপূর জামিনের আবেদন শোনার জন্য বিচারপতি গুপ্তের ডিভিশন বেঞ্চে একাধিক বার আবেদন জানান। কিন্তু বিচারপতি গুপ্ত জানিয়ে দেন, শুধু মদনবাবুর জামিনের আর্জি নয়, ব্যক্তিগত কারণে তিনি সারদা সংক্রান্ত কোনও মামলাই শুনবেন না। ফলে হাইকোর্টে মদনবাবুর জামিনের আবেদনের শুনানির ভবিষ্যৎ আবার অনিশ্চিত হয়ে পড়ে।
শেষ পর্যন্ত মামলাটি বিচারপতি মাত্রের বেঞ্চে ফিরে আসায় সেটির শুনানির সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে।