দিদি আর নেই। দুঃসংবাদটা বৃহস্পতিবারই পেয়েছিলাম। কিন্তু মন মানতে চাইছে না।
সেই কবে থেকে মহাশ্বেতাদিদিকে দেখে আসছি। কখনও তাঁকে পর বলে মনে হয়নি। সমিতির মাথা গোপীবল্লভ সিংহ দেও আমাকে দিদির রান্না করে দেওয়ার দায়িত্ব দিয়েছিলেন। প্রথমে তাঁকে দেখে কিছুটা জড়তা ছিল। কিন্তু মিশতে মিশতে দেখেছি, তিনি কত আপন!
লেখিকার সঙ্গে সমিতির প্রাণপুরুষ গোপীবল্লভ সিংহ দেও।
কত কথা যে আজ মনে পড়ছে। পুরুলিয়ায় ট্রেন থেকে নেমে গাড়িতে চড়ে পুঞ্চার রাজনওয়াগড়ে আসতেন। এখানে নামার পরে প্রথমেই ডাক পড়ত আমার। হেসে কখনও জড়িয়ে ধরতেন। মনে হতো আমাদের কতকালের আপনজন। জিজ্ঞেস করতেন, তিলু কেমন আছিস, সবাই ভাল আছে তো? তিনি আসছেন শুনেই আমি চায়ের ব্যবস্থা করে রাখতাম। দিদি লাল চা খেতে খুব পছন্দ করতেন। এসেই বাইরে বসতেন। জমে যেত আড্ডা। আড্ডায় ক’কাপ চা যে উড়ে যেত...।
দুপুরের ভাতে করলা সেদ্ধ অবশ্যই তাঁর চাই। দিদি আসবেন জেনে আমি বাজার থেকে সেরা উচ্ছে কিনে রাখতাম। উচ্ছে সেদ্ধ খেতে বড্ড ভালবাসতেন তিনি। পছন্দ করতেন ভুট্টা সেদ্ধ খেতেও। এ ছাড়া দিদির প্রিয় ছিল মুড়ি। সেই সঙ্গে কখনও সখনও তেলেভাজাও খেতেন। আমিই তেলেভাজা তৈরি করে দিতাম।
দিদি এলে এই ঘরে তখন কত ব্যস্ততা। কেউ হাঁক দিত ‘তিলু চা কর’, কেউ জানতে চাইত ‘রান্না হল কি না’। তারই মধ্যে রান্নাঘরে ঢুকে কখন পিছনে এসে দিদি দাঁড়াতেন ঠাহর করতে পারতাম না। পিঠে হাত রেখে হাসিমুখে মাঝে মধ্যেই বলতেন, ‘‘ধীরে ধীরে কর।’’ নিমেষে সমস্ত ক্লান্তি উধাও হয়ে যেত। একবার দিদিকে দেশি মুরগি রান্না করে খাইয়েছিলাম। দিদি খুব প্রশংসা করেছিলেন। ভুলব কী করে সে সব কথা।
মহাশ্বেতাদেবীর সংস্পর্শে স্বাধীনতা সংগ্রামী লছু শবর।
শুধু রান্না করাই নয়, দিদি রাজনওয়াগড়ে এলে তাঁর বিছানা গোছানো থেকে রাতের বিছানা ঠিক করে দেওয়া, দিনের অনেক কাজই করতাম আমি। দিদি গল্প করতে বসলে নাওয়াখাওয়া ভুলে যেতেন। আমিই গিয়ে মনে করিয়ে দিতাম।
কতদিন আগের কথা। কিন্তু মনে হচ্ছে যেন কিছুক্ষণ আগেই তিনি এখানে ছিলেন। হয়তো এখনই চা করে দিতে ডাক দেবেন। কিন্তু বাস্তবটা অন্য। আর কোনও দিনই দিদির জন্য লাল চা করতে পারব না, ভেবে মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে আছে। শুধুই তাঁ কথা মনে পড়ছে। উনি যে আমার নিজের দিদিই ছিলেন কি না!
ছবি: প্রদীপ মাহাতো ও সমিতি থেকে সংগৃহীত।