Cash for Query

শুরু করেছিলেন একা, ক্রমে নিজের দল তো বটেই, অন্য বিরোধী নেতাদেরও ‘মিত্র’ করে নিয়েছেন মৈত্র মহুয়া

মহুয়ার পাশে দাঁড়িয়েছেন অধীর চৌধুরী। এথিক্স কমিটির ‘তৎপরতা’, মহুয়ার বিরুদ্ধে অতিরিক্ত দ্রুত পদক্ষেপের দিকে এগিয়ে যাওয়া দেখে সরব হয়েছিলেন সিপিএমের নেতা মহম্মদ সেলিম ও সীতারাম ইয়েচুরিও।

Advertisement

আনন্দবাজার অনলাইন সংবাদদাতা

কলকাতা শেষ আপডেট: ০২ ডিসেম্বর ২০২৩ ১৯:৫৭
Share:

মহুয়া মৈত্র। —পিটিআই।

শুরুতে তাঁর লড়াই তিনি একাই লড়ছিলেন। গোড়ার দিকে সে ভাবে প্রকাশ্যে তাঁর পাশে দাঁড়ায়নি তাঁর দলও। খানিকটা ‘ধরি মাছ, না ছুঁই পানি’ গোছের প্রতিক্রিয়া ছিল কুণাল ঘোষ, ডেরেক ও’ব্রায়েনদের। কিন্তু বিরোধী শিবিরের কংগ্রেস এবং সিপিএম নেতারা তাঁর সমর্থনে মুখ খুলতে শুরু করেছিলেন। আগামী সোমবার সংসদের শীতকালীন অধিবেশনে যখন তাঁকে বহিষ্কারের প্রস্তাব নিয়ে সিদ্ধান্ত নেবে লোকসভা, তখন মহুয়া মৈত্র আর ‘একা এবং একক’ থাকবেন না।

Advertisement

কারণ, শনিবার তাঁর সমর্থনে লোকসভার স্পিকারকে চিঠি দিয়েছেন লোকসভায় কংগ্রেসের দলনেতা অধীর চৌধুরী। সর্বদল বৈঠকে মহুয়াকে লোকসভা থেকে বহিষ্কারের প্রসঙ্গ তুলে সরব হয়েছেন তৃণমূলের লোকসভার দলনেতা সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়। দেড় মাসের মধ্যে পরিস্থিতি বদলে গিয়েছে। মহুয়ার পাশে দাঁড়িয়ে বিরোধী শিবির এখন এককাট্টা।

গত ১৫ অক্টোবর তৃণমূল সাংসদ মহুয়ার বিরুদ্ধে ‘ঘুষ ও উপহারের বিনিময়ে প্রশ্ন’ করার অভিযোগ উঠেছিল। অভিযোগ করেছিলেন বিজেপির সাংসদ নিশিকান্ত দুবে এবং মহুয়ার প্রাক্তন বান্ধব জয় অনন্ত দেহাদ্রাই। মহুয়ার বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি ব্যবসায়ী দর্শন হীরানন্দানির কাছ থেকে ‘ঘুষ’ নিয়ে সংসদে আদানি শিল্পগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে প্রশ্ন তুলেছেন। সেই প্রশ্নে মহুয়া আদানির সঙ্গে জুড়ে দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকেও। মহুয়ার বিরুদ্ধে ‘ঘুষের বিনিময়ে প্রশ্ন’ অভিযোগের ভিত্তিতে লোকসভার এথিক্স কমিটি তদন্ত করে। তার পরে কমিটি স্পিকারের কাছে সুপারিশ পাঠিয়েছে, মহুয়ার সাংসদ পদ খারিজ করা হোক।

Advertisement

প্রথমে অভিযোগ ওঠার পর তৃণমূলের মুখপাত্র কুণাল বা তৃণমূলের রাজ্যসভার নেতা তথা জাতীয় মুখপাত্র ডেরেকরা বলেছিলেন, এটা মহুয়ার নিজের লড়াই। এই লড়াই তাঁকেই লড়তে হবে। ডেরেক আরও বলেছিলেন, এথিক্স কমিটি সিদ্ধান্ত নে‌ওয়ার পর দল যা বলার বলবে। মহুয়ার দল যখন ওই কথা বলছে, তখন সরাসরি তাঁর পাশে দাঁড়িয়েছিলেন প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর। আনন্দবাজার অনলাইনকে অধীর বলেছিলেন, ‘‘আমি মনে করি না মহুয়া মৈত্র কোনও ভুল করেছেন। সাংসদ প্রশ্ন তুলবেনই। কিন্তু অপছন্দের প্রশ্ন হলে তাঁর মুখ বন্ধ করা হবে, এটা কোনও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় হতে পারে না!’’ এমনিতে তৃণমূলের সঙ্গে অধীরের সম্পর্ক আদায়-কাঁচকলায়। কিন্তু কৃষ্ণনগরের তৃণমূল সাংসদের পাশে দাঁড়িয়ে বহরমপুরের কংগ্রেস সাংসদ বলেছিলেন, ‘‘কোনও সরকারেরই উচিত নয় কোনও এক জন বা দু’জন শিল্পপতির পাশে দাঁড়ানো।’’

অনেকেই মনে করেন, রাহুল গান্ধীর নির্দেশেই অধীর প্রকাশ্যে মহুয়ার পাশে দাঁড়িয়েছেন। শনিবার অধীর স্পিকারকে যে চিঠি লিখেছেন, তার নেপথ্যেও রাহুলের ভূমিকা রয়েছে বলেই কংগ্রেস মহলের একাংশের বক্তব্য। যা থেকে এটা স্পষ্ট যে, মোদী এবং আদানি বিরোধিতার প্রশ্নে তৃণমূলের এই সাংসদ রাহুলের রাজনৈতিক সমর্থন পাচ্ছেন।

নিজের লড়াই অবশ্য একাই শুরু করেছিলেন মহুয়া। দলনেত্রীকে জানিয়ে তিনি একের পর এক সংবাদমাধ্যমে সাক্ষাৎকার দেওয়া এবং এক্স (সাবেক টুইটার) হ্যান্ডলে পোস্ট করা শুরু করেন। এক দিকে যখন এথিক্স কমিটিতে বিরোধী শিবির তাঁর সমর্থনে সরব হচ্ছে (সেই ব্যবস্থাও মহুয়া তৈরি রেখেছিলেন), তখন বাইরে মহুয়া তাঁর বিরুদ্ধে তোলা সমস্ত অভিযোগ খণ্ডন করতে শুরু করেন। সঙ্গে তুলতে থাকেন পাল্টা প্রশ্নও। যখন ‘আনুষ্ঠানিক’ ভাবে তৃণমূল তাঁর পাশে দাঁড়ায়নি, তখন ‘ব্যক্তিগত’ পর্যায়ে মহুয়ার পক্ষ নিয়ে বিবৃতি দিয়েছেন রাজ্যের মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম এবং লোকসভায় মহুয়ার সতীর্থ সাংসদ শতাব্দী রায়।

অতঃপর এথিক্স কমিটির ‘তৎপরতা, অতি সক্রিয়তা’ এবং মহুয়ার বিরুদ্ধে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ার তাড়নার বিরুদ্ধে মুখ খোলেন সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম এবং সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরিও। যাঁরা সাধারণ ভাবে তৃণমূলের কঠোর বিরোধিতা করেন। পশ্চিমবঙ্গ সংক্রান্ত কোনও রাজনৈতিক প্রশ্নে যে বিরোধিতা আরও জোরালো হয়। এর পরে প্রকাশ্যেই মহুয়ার পাশে দাঁড়ান তৃণমূলের সর্বময় নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। অভিষেক যেমন বলেন, মহুয়া একাই তাঁর লড়াই লড়ার পক্ষে যথেষ্ট, তেমনই পাশাপাশি বলেন, মহুয়ার বিরুদ্ধে ‘প্রতিহিংসার রাজনীতি’ করা হচ্ছে। তার কিছু দিন পরেই মমতা বলেন, ‘‘এদের (বিজেপি) প্ল্যান এখন মহুয়াকে (লোকসভা থেকে) তাড়ানো। (লোকসভার) এখন আর তিন মাস বাকি আছে। মহুয়া যেগুলো ভিতরে বলত, সেগুলোই এখন বাইরে বলবে! মূর্খ না হলে ভোটের তিন মাস আগে কেউ এ কাজ করে!’’ তার মধ্যে তৃণমূলের অন্দরে সাংগঠনিক রদবদলে কৃষ্ণনগরের সাংসদ মহুয়াকে কৃষ্ণনগর সাংগঠনিক জেলার সভাপতির দায়িত্ব দেওয়া হয়। সেই সিদ্ধান্ত থেকেও এই ‘বার্তা’ স্পষ্ট ছিল যে, দলগত ভাবে তৃণমূল মহুয়ার পাশে রয়েছে।

শনিবার সংসদে সর্বদল বৈঠকের আগে লোকসভার স্পিকার চিঠি দিয়েছেন অধীর। তাতে তিনি লিখেছেন, ‘টাকা নিয়ে প্রশ্ন’ করার ঘটনাটি নিয়ে যখন তদন্ত চলছে, তখন সেটি সম্পূর্ণ গোপন থাকার কথা। যে হেতু এটি অত্যন্ত ‘স্পর্শকাতর’ একটি বিষয়। কিন্তু এথিক্স কমিটির চেয়ারম্যান এবং সদস্যেরা বিষয়টি গোপন না রেখে তা শুধু প্রকাশ্যেই আনেননি, তা নিয়ে নিজেদের মতো মতামতও দিচ্ছেন। অধীর চিঠিতে যা লিখেছেন, একই দিনে সর্বদল বৈঠকে একই কথা বলেছেন তৃণমূলের লোকসভার দলনেতা সুদীপও। যে ঘটনাপ্রবাহ বলছে, আগামী সোমবার যখন লোকসভায় মহুয়াকে বহিষ্কারের প্রস্তাব আনবেন স্পিকার, বিরোধী শিবির রণং দেহি মেজাজেই থাকবে।

মহুয়া নিজে কী মনোভাব নিয়ে সে দিন লোকসভায় ঢুকবেন? শনিবার বিকেলে ভারমুক্ত সাংসদ জবাব দিলেন, ‘‘যেমন সব সময় থাকি— হ্যাপি অ্যান্ড আপরাইট!’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন