জঙ্গলমহলের ছাত্রীদের সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
জেলা সফরের শুরুতেই পুরুলিয়ার পাঞ্চেত ব্যারাজে হাঁটার সময় গ্রামের মানুষের কাছ থেকে জল সমস্যার কথা শুনে তা মেটানোর নির্দেশ দিয়েছিলেন জেলাশাসককে। মঙ্গলবার বাঁকুড়ায় জঙ্গলমহলের মঞ্চ থেকেও সরাসরি বাসিন্দাদের সমস্যার কথা জানতে চাইলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এলাকায় উন্নয়নের কাজ ভাল ভাবে করার জন্য গ্রামসভা, পঞ্চায়েত সমিতি, জেলা পরিষদের পদাধিকারীদের নির্দেশও দিয়ে গেলেন তিনি।
বাঁকুড়ার জঙ্গলমহল রাইপুরের সবুজ সঙ্ঘের মাঠে এ দিন দুপুরে প্রকাশ্য প্রশাসনিক সভা করেন মমতা। এ দিন সভামঞ্চ থেকেই ১০০টির বেশি প্রকল্পের উদ্বোধন ও শিল্যানাস করেন মুখ্যমন্ত্রী। সভা শুরু হয় দুপুর দেড়টা নাগাদ। কিন্তু তার আগে দুপুর ১২টা থেকেই সভাস্থলে লোকসমাগম শুরু হয়ে যায়। চড়া রোদ থাকায় ছাউনির ব্যবস্থা করা হয়েছিল। কিন্তু সেই ছাউনির বাইরে মাঠ ছাড়িয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায় হাজার হাজার মানুষকে। দুপুর ২ টো ৪০ মিনিটে মমতা সভামঞ্চে পৌঁছন। ঠাসা ভিড় দেখে খুশি গোপন করেননি মুখ্যমন্ত্রী। বলেন, “এত রোদেও আপনারা যে এত কষ্ট করে দীর্ঘক্ষণ বসে রয়েছেন, তার জন্য ধন্যবাদ। বুঝতে পারছি এলাকায় শান্তি বিরাজ করছে।’’
নিজেদের আবেদন নিয়ে পোস্টার হাতে আইসিডিএস কর্মীরা।
মঞ্চ থেকেই বারবার দর্শকদের সঙ্গে কথাবার্তা চালাচ্ছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পরে এই নিয়ে ষষ্ঠবার বাঁকুড়ার জঙ্গলমহল সফরে এলেন মমতা। এর আগে জনতার কাছ থেকে অভাব অভিযোগ শুনেছেন। কিন্তু, এ বারের মতো প্রকাশ্যে মঞ্চ থেকেই অভাব-অভিযোগ লিখিত ভাবে জানানোর আহ্বান আগে কখনও জানাননি। তাই মুখ্যমন্ত্রীর কাছ থেকে এমন অপ্রত্যাশিত আহ্বানে যারপরনাই বিস্মিত গাঁয়ের আমজনতা। সভার শেষ দিকে মঞ্চের সামনে ফুলদানি হাতে স্বনির্ভর গোষ্ঠীর মহিলাদের হাত নাড়া দেখেই মমতা তড়িঘড়ি পুলিশকে নির্দেশ দেন, ‘‘ওরা আমার জন্য ফুলদানি নিয়ে এসেছে। নিয়ে আসুন, ওদের নাম ঠিকানা নিয়ে নিন।’’ বেড়ার ও-ধার থেকে পুলিশ ফুলদানি নিয়ে যেতে দেরি করছে দেখে অসহিষ্ণু মমতা বলেই ফেলেন, “কাগজটা আমায় দিন। এত দেরি হচ্ছে। কাগজটা তো চাইছি?’’ এর পর তিনি আমজনতার উদ্দেশে বলেন, “কারও কোনও অভাব অভিযোগ থাকলে, চিঠিপত্র থাকলে পুলিশের হাতে দিয়ে দিন। আমার হাতে পৌঁছে যাবে।’’
মুখ্যমন্ত্রীর কথা শুনেই মঞ্চের একপাশে দাঁড়ানো সারেঙ্গার চিলতোড় গ্রামের বাসিন্দা লাল্টু গরাই এক টুকরো কাগজ নিয়ে বেড়ার পাশে ছুটে যান। স্থানীয় এক আইসিডিএস কর্মীও এগিয়ে যান। পুলিশ তাঁদের কাছ থেকে চিরকুট নিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর হাতে তুলে দেয়। মমতা মঞ্চে দাঁড়িয়েই লাল্টুর চিরকুট পড়ে বলেন, “লাল্টু এ বার উচ্চ মাধ্যমিক দিয়েছেন। কিন্তু, কলেজের পড়াশোনার টাকা নেই।’’ এর পরেই তিনি জানতে চান, ‘এই চিঠিটা কার? কে দিয়েছে?’ মঞ্চ থেকে দূরে দাঁড়ানো লাল্টুর দিকে ঘুরে বলেন, “ওর পড়াশোনার সব ব্যবস্থা করার জন্য বলে যাচ্ছি।’’ এক আইসিডিএস কর্মীর বেতন বাড়ানোর দাবি শুনে মমতা অবশ্য সাফ জানিয়ে দেন, “আইসিডিএস প্রকল্পের ৫০ শতাংশ টাকা বন্ধ করে দিয়েছে কেন্দ্রীয় সরকার। আমরা প্রকল্প চালানোর চেষ্টা করছি। এই অবস্থায় এখনই বেতন বাড়ানো সম্ভব নয়। পরিস্থিতি ভাল হলে অবশ্যই বাড়ানো হবে।’’
প্রকাশ্য মঞ্চ থেকে আমজনতার হাত থেকে সরাসরি অভিযোগ অভাব নেওয়ার এমন দৃশ্য দেখে অনেকেই খুশি, অনেকের গলায় আবার আক্ষেপের সুর। প্রথম সুযোগেই মুখ্যমন্ত্রীর কাছে অভিযোগ সরাসরি জানাতে পেরে লাল্টু যেমন ভীষণ খুশি। তাঁর কথায়, “আমাদের অভাবের সংসার। এ দিন মুখ্যমন্ত্রী আসছেন জেনে তাঁর কাছে আমার সমস্যার কথা জানাব ভেবে একটা চিঠি লিখে রেখেছিলাম। কপাল জোরে সহজেই সুযোগ পেলাম। মুখ্যমন্ত্রী চিঠি দেখেই যেভাবে আমার পড়াশোনার ব্যবস্থা করার জন্য বলেছেন, তাতে আমি সারা জীবন ওঁর কাছে কৃতজ্ঞ থাকব।’’ রাইপুরের শ্যামসুন্দরপুর গ্রামের নিয়তি সিংহ মহাপাত্র, প্রলয় সিংহ মহাপাত্রদের অবশ্য আক্ষেপ, “আমাদের মাথা গোঁজার এক টুকরো ছাদ নেই। মুখ্যমন্ত্রীকে সরাসরি অভিযোগ জানাতে পারব জানলে বাড়ি থেকে লিখে নিয়ে আসতাম। এমন সুযোগ হারালাম। মুখ্যমন্ত্রী জানলে অবশ্যই আমাদের বাড়ির একটা ব্যবস্থা করে দিতেন।’’
সামনেই বিধানসভা ভোট। সেই ভোটকে যে পাখির চোখ করছেন তৃণমূল নেত্রী এদিন বেশকিছু প্রকল্পের শিলান্যাস, উদ্বোধন ও ঘোষণার পাশাপাশি দলের বিভিন্ন স্তরের জন প্রতিনিধিদের ভাল করে কাজ করার নির্দেশের মধ্যে তা স্পষ্ট হল মঙ্গলবার। সভায় তৃণমূল নেত্রী বলেন, “গ্রামসভা, পঞ্চায়েত সমিতি, জেলা পরিষদে যাঁরা দায়িত্বে রয়েছেন তাঁদেরকে ভাল করে কাজ করতে হবে। দীর্ঘদিন ধরে সিপিএমের আমলে কাজ হয়নি। তাই এলাকার মানুষের প্রত্যাশা আমাদের কাছে অনেক বেশি।’’ নাম না করে মাওবাদীদের প্রসঙ্গও এসেছে তাঁর বক্তব্যে। বলেছেন, “সারেঙ্গা ছিল মুক্তাঞ্চল। বাইরে থেকে এখানে মানুষ আসতে ভয় পেত। সারেঙ্গা, রাইপুর, ঝাড়গ্রাম, লালগড়, বান্দোয়ান, বাঘমুন্ডি – সব এলাকা থমথমে ছিল। বিকেলের পর বাস চলাচল করত না। সেই পরিস্থিতি আর নেই। শান্তি বিরাজ করছে।’’
তৃণমূল নেতৃত্বের দাবি, এ দিন সভায় ৫০ হাজারের বেশি মানুষ এসেছিলেন। আশেপাশের রানিবাঁধ, সারেঙ্গা, সিমলাপাল, খাতড়া, হিড়বাঁধ, তালড্যাংরা, থেকেও বাসে করে হাজার হাজার তৃণমূল কর্মী-সমর্থকেরা সভায় ভিড় করেন। বহু এলাকা থেকে বাস তুলে নেওয়ায় বহু মানুষ চূড়ান্ত হয়রানির শিকার হন।
ছবি: উমাকান্ত ধর।