মোদী সরকার ঝুটা-গন্দা, সুর আরও চড়ল মমতার

মানুষের ভোগান্তি আশঙ্কা করে প্রথম রাতেই গর্জে উঠেছিলেন তিনি। অথচ মুলায়ম-মায়াবতী-চিদম্বরমরা তখন ছিলেন সাবধানী! তথাকথিত কালো টাকা বিরোধী অভিযানের সমালোচনা করলে পাছে ভুল বার্তা যায়!

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

কলকাতা শেষ আপডেট: ১৩ নভেম্বর ২০১৬ ০৩:২০
Share:

মানুষের ভোগান্তি আশঙ্কা করে প্রথম রাতেই গর্জে উঠেছিলেন তিনি। অথচ মুলায়ম-মায়াবতী-চিদম্বরমরা তখন ছিলেন সাবধানী! তথাকথিত কালো টাকা বিরোধী অভিযানের সমালোচনা করলে পাছে ভুল বার্তা যায়! কিন্তু জনতার দুর্ভোগ দেখে তাঁরাও এখন মুখ খোলায় কেন্দ্র-বিরোধী আক্রমণে আর আগল রাখলেন না মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।

Advertisement

টাকা তুলতে গিয়ে মানুষের কী ভোগান্তি হচ্ছে তা নিজের চোখে দেখতে শনিবার দুপুরে পথে নেমেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। তার পর নবান্নে ফিরে মানুষকে ‘ভাতে মারার’ দায়ে সরাসরি প্রধানমন্ত্রীকে কাঠগড়ায় তুলে ঝাঁঝিয়ে বলেন, ‘‘মোদী সরকার নয়, ব্যাধি সরকার চলছে কেন্দ্রে। এই সরকার কালা, ঝুটা, গন্দা!’’ কেন্দ্রের ‘কালো নীতি’ প্রত্যাহারের দাবিতে সংসদের আসন্ন অধিবেশনে একজোট হওয়ার জন্য সিপিএম-সহ সমস্ত বিরোধী দলকে আহ্বানও জানান তিনি। তাঁর কথায়, ‘‘সিপিএম-ও কেন্দ্রের এই পদক্ষেপের বিরোধিতা করছে। ওঁদের সঙ্গে আমার মতাদর্শের ফারাক রয়েছে ঠিকই। কিন্তু মানুষের দুর্ভোগের সময়ে এ সব ভাবলে চলবে না। এ ব্যাপারে সংসদে ওঁদের সঙ্গেও সমন্বয় করে চলব।’’

মমতার এই মন্তব্য বিজেপি নেতৃত্বের কপালের ভাঁজ গভীর করেছে। একে তো যত দিন যাচ্ছে, তত ধৈর্য হারাচ্ছেন সাধারণ মানুষ। তার উপর সংসদে বৃহত্তর বিরোধী ঐক্য গড়ে তোলার যে চেষ্টা মমতা করছেন, তাতে তাঁরা রাজনৈতিক ভাবে আরও কোণঠাসা হবেন। শুধু সপা-বিএসপি বা কংগ্রেস নয়, শিবসেনা, এডিএমকে, বিজু জনতা দলের মতো বিজেপির শরিক ও বন্ধু দলগুলিকেও পাশে পাওয়ার চেষ্টাও চালাচ্ছেন মমতা। তৃণমূল সূত্রের আশা, সাধারণ মানুষকে যে ভাবে হেনস্থা হতে হচ্ছে, তাতে সংসদে কেন্দ্র-বিরোধী বাতাবরণ তৈরি হলে এই দলগুলিও হাত গুটিয়ে বসে থাকতে পারবে না।

Advertisement

বস্তুত কলকাতায় বসে মমতা সাংবাদিক বৈঠক করলেও তাঁর নজর যে সর্বভারতীয় মঞ্চের দিকে ছিল, তা বেশ কিছু কথায় পরিষ্কার হয়ে যায়। তৃণমূল নেত্রী জানান, নোট বাতিলের বিষয়টি নিয়ে কলকাতাবাসী গুজরাতি, মারওয়াড়িদের সঙ্গে তিনি কথা বলেছেন। পঞ্জাবিদের সঙ্গেও বলবেন। সকলেই হয়রানির কথা জানিয়েছেন তাঁকে। জাতীয় রাজনীতির উদ্দেশে বার্তা দেওয়ার জন্য সাংবাদিক বৈঠকে হিন্দিতেও প্রশ্নের জবাব দেন মমতা।

তৃণমূলে এক মমতা ঘনিষ্ঠ নেতা এ দিন বলেন, ‘‘আসলে মানুষের সুবিধা অসুবিধার বিষয়ে দিদির দূরদর্শিতা

অনেকের থেকে বেশি। তিনি প্রথম দিনই বুঝতে পেরেছিলেন, মোদী সরকারের এই ‘হঠকারী’ সিদ্ধান্তে নাজেহাল হতে হবে সাধারণ মানুষকে। কিন্তু বাকি দলগুলি নিজেদের ভাবমূর্তি নিয়ে বেশি সচেতন হয়ে পড়েছিল। এমনকী ইতস্তত করছিল কংগ্রেসও। এখন দেশ জুড়ে জনতার দুর্ভোগ দেখে তাঁদের যেমন চোখ খুলেছে, তেমন দিদির রাজনৈতিক পথেরই জয় হয়েছে।’’ এর ফলে জাতীয় রাজনীতিতে তাঁদের গুরুত্ব আরও বাড়ল বলেই মনে করছেন তৃণমূল নেতৃত্ব।

তবে নোট বাতিলটাই একমাত্র বিষয় নয়। বরাদ্দ ছাঁটাই, একশো দিনের কাজ প্রকল্পের মজুরি সরাসরি শ্রমিকদের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে পাঠানো ইত্যাদি বেশ কিছু ঘটনায় কেন্দ্রের ওপর চটে রয়েছেন মমতা। সমস্ত বিরোধী দলকে এককাট্টা করার সুযোগ তিনি এমনিতেই খুঁজছিলেন। পরিস্থিতি বুঝে নোট বাতিলের বিষয়টিকেই তিনি প্রধান হাতিয়ার করে নিয়েছেন।

প্রশ্ন হল, বিজেপি কী করবে?

বিজেপি সূত্রের মতে, জাতীয় রাজনীতিতে মমতা হঠাৎ সক্রিয় হয়ে ওঠায় তাদের উৎকণ্ঠা ছিলই। তাই নোট বাতিল নিয়ে মমতার বিরোধিতাকে অঙ্কুরেই আঘাত করতে চেয়েছেন অমিত শাহ-অরুণ জেটলিরা। এ ব্যাপারে নীতীশ কুমার-নবীন পট্টনায়করা যে তৃণমূলের সঙ্গে নেই, তা বলে বিরোধী ঐক্যে ফাটলটা তুলে ধরতে চাইছেন। বিরোধী ঐক্য ঘেঁটে দেওয়ার সেই চেষ্টা চলবে।

ঘটনা হল, রাজনৈতিক ভাবে মমতাকে বিজেপি-র এই আক্রমণের পাশাপাশি ঘটনাচক্রে চিট ফাণ্ড কেলেঙ্কারির তদন্তে সিবিআই হঠাৎই ফের সক্রিয় হয়ে উঠেছে। এ ব্যাপারে তৃণমূল সাংসদ শতাব্দী রায়কে এরই মধ্যে নোটিস ধরিয়েছে তারা। লোকসভায় তৃণমূল দলনেতা সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়কেও নোটিস পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

কিন্তু এতে দমে না গিয়ে বিজেপি-র বিরুদ্ধে আরও আক্রমণাত্মক হওয়ারই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তৃণমূলনেত্রী। সরাসরি প্রধানমন্ত্রীকে বিঁধে মমতা এ দিন বলেন, ‘‘দেশকে ভাসিয়ে দিয়ে প্রধানমন্ত্রী চলে গেলেন বিদেশে! ওখান থেকে আবার বলছেন, ৩০ ডিসেম্বরের পর মজা দেখিয়ে ছাড়ব! আর কী মজা দেখাবেন? মানুষের খাওয়াদাওয়া বন্ধ হয়ে গেছে। এ বার কি আর্মিকে দিয়ে গুলি করে মারবেন?’’ তা ছাড়া বিদেশে গিয়ে ঘরোয়া পরিস্থিতি নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর এ রকম হুঁশিয়ারি বার্তা নিয়েও সমালোচনা করেন মমতা। বলেন, ‘‘বিদেশের মাটিতে দাঁড়িয়ে প্রধানমন্ত্রী দেশের মানুষকে ধমকাচ্ছেন, এমনটা জন্মেও দেখিনি।’’ বিজেপি-র বিরুদ্ধে সরাসরি অভিযোগ এনে মমতা বলেন, এক শ্রেণির কালো কারবারি এবং দালালকে সুবিধা পাইয়ে দিতেই এই পদক্ষেপ করেছে কেন্দ্র। তাঁর কথায়, ‘‘শুনছি রাস্তায় কিছু লোক বেরিয়ে কালো কারবার করছে। ওঁদের মধ্যে বিজেপি-র লোকও আছে।’’

সব মিলিয়ে নোট বাতিলের প্রশ্নে মোদী সরকারের সঙ্গে তাঁর সংঘাত যে চরম আকার নিতে চলেছে তা এ দিন স্পষ্ট করে দিয়েছেন মমতা। সেই জল কোথায় গড়ায় সেটাই দেখার।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন