আইআরসিটিসি মেনে নিল, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় রেলমন্ত্রী থাকাকালীন সারদা গোষ্ঠীর সঙ্গে গাঁটছড়া বেধেছিল ভারতীয় রেল। এমনকী, পূর্ব ভারতে নিজেদের পর্যটন ব্যবসা প্রসারে সারদার সংস্থাকে সরাসরি সেলস্ এজেন্ট হিসেবে নিযুক্ত করেছিল তারা। রেলের অধীনস্থ ইন্ডিয়ান রেলওয়ে ক্যাটারিং অ্যান্ড ট্যুরিজম কর্পোরেশনের (আইআরসিটিসি) তরফে আনুষ্ঠানিক বিবৃতি দিয়েই বৃহস্পতিবার এই কথা স্বীকার করে নেওয়া হয়েছে। তবে সারদা ট্যুর অ্যান্ড ট্রাভেল্স সংস্থাটির প্রয়োজনীয় অভিজ্ঞতা না থাকা সত্ত্বেও কী ভাবে তাদের সঙ্গে রেল গাঁটছড়া বাধল, বিরোধীদের তোলা এই মূল প্রশ্নটিই এড়িয়ে যান আইআরসিটিসি কর্তৃপক্ষ। তাঁদের দাবি, সারদাকে কোনও বাড়তি সুবিধা দেওয়া হয়নি।
এই পরিস্থিতিতে বিরোধীরা এ বার সরাসরি মুখ্যমন্ত্রীর পদত্যাগ দাবি করেছে। প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরী থেকে বিজেপির রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহ পর্যন্ত সকলেরই বক্তব্য, তদন্তে স্বচ্ছ প্রমাণ হওয়ার আগে মুখ্যমন্ত্রীর উচিত পদ থেকে সরে দাঁড়ানো। হাওয়ালা কেলেঙ্কারির সময় অভিযোগ ওঠায় ঠিক যেমনটা করেছিলেন লালকৃষ্ণ আডবাণী।
সারদা-চুক্তি নিয়ে এ দিন কী বলেছে আইআরসিটিসি? তাদের তরফে বলা হয়েছে, কমিশনের ভিত্তিতে অন্যান্য সংস্থার মতোই রেলের সঙ্গে কাজ করত সারদা। তাই তাদের বাড়তি কোনও সুবিধা দেওয়ার প্রশ্ন নেই। কিন্তু অভিযোগ রয়েছে, সে কাজের জন্য ন্যূনতম যে অভিজ্ঞতার প্রয়োজন, তা ছিল না সারদা সংস্থার। সেটা জেনেও কার্যত নিয়মের তোয়াক্কা না করে সারদাকে ‘এমপ্যানেল’ করে আইআরসিটিসি। প্রাক্তন বিচারপতি অশোক গঙ্গোপাধ্যায়ের বক্তব্য, এই ধরনের কাজের জন্য অন্তত পাঁচ বছর কাজ করার অভিজ্ঞতা দরকার। কিন্তু এ ক্ষেত্রে যখন চুক্তি হয়, সারদা গোষ্ঠীর ওই সংস্থাটির বয়স তখন মোটে তিন বছর।
প্রশ্ন উঠেছে, তা হলে সারদার সংস্থাকে ‘এমপ্যানেল’ করার পিছনে কি কোনও নির্দেশ বা চাপ ছিল? এই সংক্রান্ত কোনও প্রশ্ন বা অভিযোগেরই জবাব দিতে চাননি আইআরসিটিসি কর্তৃপক্ষ। সংস্থার পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, যা বলার, তা বিবৃতিতেই বলা হয়েছে। সেই বিবৃতিতে তারা দাবি করেছে, পর্যটন সংক্রান্ত প্যাকেজ বিক্রি করাটা তাদের ব্যবসার একটি অংশ। সেই প্যাকেজ বিক্রির জন্য অন্যান্য সংস্থার মতোই কমিশনের ভিত্তিতে সারদা সংস্থাকেও নিয়োগ করা হয়। কিন্তু পর্যাপ্ত অভিজ্ঞতাহীন একটি অপরিচিত সংস্থাকে কেন এ ভাবে দায়িত্ব দিল আইআরসিটিসি? অভিযোগ, মমতা ঘনিষ্ঠ এক আমলার চাপেই ওই কাজ করতে বাধ্য হয়েছিল আইআরসিটিসি। যদিও আইআরসিটিসি এই প্রশ্নের জবাব এড়িয়ে গিয়েছে।
এই সংক্রান্ত বিষয়ে মুখ খুলতে চায়নি রেল মন্ত্রকও। রেল বোর্ডের চেয়ারম্যান অরুণেন্দ্র কুমারের কাছে এ বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে তিনি মুখ খুলতে চাননি। প্রাক্তন রেল প্রতিমন্ত্রী অধীর চৌধুরীর দাবি, “আইআরসিটিসি রেলের একটা সংস্থা (পিএসইউ)। রেলের ক্ষমতাসীন কর্তাব্যক্তিদের ইন্ধন ছাড়া সারদা বরাত পায়নি। সিবিআইয়ের মুখ্যমন্ত্রীকে জেরা করা উচিত।”
এর মধ্যেই প্রাক্তন রেলমন্ত্রী তথা তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক মুকুল রায় বৃহস্পতিবার আবার রেল-সারদা প্রশ্নে ভিন্ন ব্যাখ্যা পেশ করেছেন। এর আগে তিনি বলেছিলেন, ওই চুক্তির সময় তিনি রেলমন্ত্রী ছিলেন না। তাঁর ওই মন্তব্য নিয়ে দলের অন্দরে ব্যাপক জলঘোলা হয়েছিল। ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন তৃণমূল নেত্রীও। এ দিন উত্তরবঙ্গ ফেরত মুখ্যমন্ত্রীকে স্বাগত জানাতে কলকাতা বিমানবন্দরে গিয়েছিলেন মুকুলবাবু। সেখানে তিনি বলেন, “কী অভিযোগ রয়েছে! আইআরসিটিসি রেলের অধীনে রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা। মন্ত্রকের সঙ্গে সরাসরি যোগ নেই।” তাঁর আরও দাবি, “তৃণমূলের বিরুদ্ধে কোনও অভিযোগ নেই। বাম আমলেই সারদা তৈরি ও বেড়ে উঠেছিল!” মুকুলবাবুর এ দিনের বক্তব্যকে বিতর্কের মুখে ‘ভোলবদল’ বলেই ব্যাখ্যা করছে তৃণমূলের একাংশ।
সিবিআই সূত্রের কিন্তু বক্তব্য, আমানতকারীদের মনে ভরসা জোগানোর জন্য রেল ও সারদার মধ্যে পরিকল্পনামাফিকই ওই চুক্তি করা হয়েছিল। যাতে রেলের মতো কেন্দ্রীয় সরকারি দফতরের সঙ্গে যুক্ত থাকার কথা বলে জনমানসে আস্থা অর্জন করা যায়। নিজেদের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীদের উপস্থিত করিয়ে জনগণের ভরসা অর্জনই ছিল সারদার সাফল্যের অন্যতম চাবিকাঠি। সিবিআই সূত্রের খবর, সে সময়ে সারদা ট্যুর অ্যান্ড ট্র্যাভেল্স দু’বছরে প্রায় ৪০ কোটি টাকা বাজার থেকে তুলেছিল। সেই টাকা কোন খাতে ব্যয় হয়েছে, তা-ও খতিয়ে দেখছে সিবিআই।
স্বাভাবিক ভাবেই বিরোধীরা এই বিষয়টিকে হাতিয়ার করে মমতাকে সরাসরি আক্রমণ করেছেন। এর আগে মমতার দাবি ছিল, সারদা কেলেঙ্কারি প্রকাশ্যে না আসা পর্যন্ত তিনি ওই সংস্থা বা সংস্থার কর্ণধার কারও নামই শোনেননি। কিন্তু এ দিন আইআরসিটিসি সরকারি ভাবেই স্বীকার করে নিয়েছে, ২০১০-১১ সালে অর্থাৎ মমতা রেলমন্ত্রী থাকাকালীনই পূর্ব ভারতে তাদের সেলস্ এজেন্ট হিসাবে কাজ শুরু করে সারদার সংস্থা। এই সূত্র ধরেই অধীর এ দিন অভিযোগ করেছেন, “মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় রেলমন্ত্রী থাকাকালীন সুদীপ্ত সেনকে চিনতেন। তাঁর সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা ছিল। রেলের চেয়ার, রেলের ক্ষমতা ব্যবহার করে তিনি সুদীপ্তকে সুযোগ পাইয়ে দিয়েছিলেন।” এই সূত্রেই অধীরের বক্তব্য, “মুখ্যমন্ত্রী যদি সততা, স্বচ্ছতার প্রতীক হন, তা হলে আমার দাবি, উনি পদত্যাগ করুন! সিবিআই যত ক্ষণ না তাঁকে ক্লিনচিট দিচ্ছে, তত ক্ষণ মুখ্যমন্ত্রীর চেয়ার থেকে তাঁর দূরে থাকা উচিত।” একই সুরে সিপিএমের যুব সংগঠন ডিওয়াইএফআই-ও দাবি তুলেছে, সারদার সঙ্গে রাজ্য সরকার এবং রেলমন্ত্রী থাকাকালীন স্বয়ং মমতার যোগাযোগের অভিযোগও প্রকাশ্যে এসে পড়েছে, তাতে মুখ্যমন্ত্রীর ক্ষমতায় থাকার নৈতিক অধিকার নেই। সংগঠনের রাজ্য সম্পাদক জামির মোল্লা জানিয়েছেন, দুর্নীতির বিষয়টি তাঁদের প্রচার-আন্দোলনের অঙ্গ হবে। বিজেপির রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহেরও বক্তব্য, হাওয়ালা কেলেঙ্কারিতে নাম জড়ানোয় সব পদ থেকে সরে দাঁড়ান আডবাণী। তদন্তে নির্দোষ প্রমাণ হওয়ার পর তিনি ফের পদে যোগ দেন। একই সঙ্গে রাহুলবাবুর কটাক্ষ, “রেল-সারদা-কাণ্ডে তৃণমূলের এক সর্বভারতীয় নেতা সম্প্রতি বলেছেন, তাঁর আমলে ও-রকম কিছু হয়নি। এর পর বলবেন, তিনি টাকা খাননি!” সারদা-কাণ্ডকে কেন্দ্র করে তৃণমূল নেতাদের মধ্যে অবিশ্বাসের সম্পর্ক তৈরি হয়েছে বলেও দাবি করেন রাহুলবাবু।
চাঁদনি চকে ভোটপ্রচারে মুকুল রায়। বৃহস্পতিবার। —নিজস্ব চিত্র।
বামফ্রন্ট অবশ্য এখনও সরাসরি মুখ্যমন্ত্রীর পদত্যাগ দাবি করেনি। তবে এ দিন বামফ্রন্টের বৈঠকে ঠিক হয়েছে, তৃণমূল নেতৃত্বকে এ ব্যাপারে লাগাতার আক্রমণ চালিয়ে যাওয়া হবে। বামফ্রন্টের চেয়ারম্যান বিমান বসু বলেন, “কাগজে বেরোচ্ছে, ২০১২ সালে ডেলো বাংলোতে মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে সুদীপ্ত সেনের বৈঠক হয়েছিল। ওই বৈঠকে সাংসদ কুণাল ঘোষ এবং তৃণমূলের এক প্রভাবশালী নেতা উপস্থিত ছিলেন। আর উনি ২০১৩ সালের পয়লা বৈশাখ জানালেন, সারদার কথা তিনি ওই দিন প্রথম শুনলেন!” তাঁর দাবি, “রাজ্যবাসী সত্য জানতে চায়। কার কথায় ভবানীপুরের ক্লাবগুলিকে সুদীপ্ত টাকা দিয়েছিলেন, রাজ্যবাসী তা-ও জানতে চায়!”
মুখ্যমন্ত্রীর পদত্যাগের দাবি নিয়ে মুকুলবাবু বা দলের অন্য কোনও নেতা এ দিন কোনও মন্তব্য করতে চাননি। বরং, মুকুলবাবু ফের বলেছেন, “আসল অপরাধীদের আড়াল করার জন্যই সিবিআই বারবার এমন করে। অমিত শাহকেও সিবিআই গ্রেফতার করেছিল। চার্জশিটও দিয়েছিল। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকেও সিবিআই জেরা করেছে।”