ছাত্রছাত্রীদের সামনে মমতার ধমক কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যকে

তার পরেই মাইকে উপাচার্যকে খোঁজাখুঁজি শুরু করেন মুখ্যমন্ত্রী। তিনি উপাচার্যকে প্রশ্ন করেন, ‘‘সরকারের দিক থেকে ছাড়পত্র পাওয়ার পরেও আপনি নিয়োগ করেননি কেন?’’ তার পরে জবাবদিহি চাওয়ার সুরে ফের প্রশ্ন করেন, ‘‘কেন করেননি নিয়োগ?’’ তারও পরে সুর নামিয়ে তিনি বলেন, ‘‘দয়া করে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব নিয়োগ করুন।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

তারকেশ্বর শেষ আপডেট: ০২ জুন ২০১৭ ০৪:৩৫
Share:

ছবি: সংগৃহীত।

বেশ কয়েকটি প্রশাসনিক বৈঠকে জনপ্রতিনিধি থেকে পুলিশকর্তাদের নাম ধরে ধরে ধমকেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এ বার পড়ুয়াদের সামনে দাঁড় করিয়ে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অস্থায়ী উপাচার্য আশুতোষ ঘোষকে সমানে ধমকালেন, জবাবদিহি চাইলেন তিনি।

Advertisement

শুধু ধমকচমক নয়, ছাত্রছাত্রীদের সমস্যা না-মিটলে তিনি যে তাঁদের পক্ষে চলে যাবেন, হুমকির সুরে এমন কথাও শোনা গেল মুখ্যমন্ত্রীর গলায়। বৃহস্পতিবার তারকেশ্বরে প্রশাসনিক বৈঠকে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের অস্থায়ী উপাচার্য তথা আন্তর্জাতিক রসায়ন-বিজ্ঞানী আশুতোষবাবুকে তিনি যে-ভাবে হেনস্থা করেছেন, তাতে প্রাক্তন উপাচার্যদের অনেকেই ব্যথিত।

এ দিনের প্রশাসনিক সভায় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিনিধি হিসেবে ছিলেন সেখানকার তৃণমূল ছাত্র পরিষদ (টিএমসিপি) পরিচালিত ছাত্র সংসদের কিছু নেতা। কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের সভানেত্রী রুমানা আখতার মুখ্যমন্ত্রীর কাছে অভিযোগ করেন, ‘‘কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রায় ৩০০ শিক্ষক-পদ খালি। ফলে ছাত্র-শিক্ষক অনুপাত নষ্ট হচ্ছে।’’

Advertisement

তার পরেই মাইকে উপাচার্যকে খোঁজাখুঁজি শুরু করেন মুখ্যমন্ত্রী। তিনি উপাচার্যকে প্রশ্ন করেন, ‘‘সরকারের দিক থেকে ছাড়পত্র পাওয়ার পরেও আপনি নিয়োগ করেননি কেন?’’ তার পরে জবাবদিহি চাওয়ার সুরে ফের প্রশ্ন করেন, ‘‘কেন করেননি নিয়োগ?’’ তারও পরে সুর নামিয়ে তিনি বলেন, ‘‘দয়া করে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব নিয়োগ করুন। এর জন্য কো-অর্ডিনেশন কমিটির সঙ্গে কথা বলার কোনও প্রয়োজন নেই।’’

উপাচার্য আশুতোষবাবু বলেন, ‘‘করছি ম্যাডাম।’’ রুমানা যে-হেতু প্রশ্নটি ইংরেজিতে করেছিলেন, তাই উপাচার্যকে ইংরেজিতেই উত্তর দিতে বলেন মুখ্যমন্ত্রী। তার পরেই তিনি উপাচার্যের উদ্দেশে বলেন, ‘‘আমি কিন্তু কিছু কিছু কথা শুনছি। আপনি ভয় পেয়ে গিয়ে রাতে ওদের সঙ্গে আলোচনায় বসে যাচ্ছেন। ফলে কিছু হচ্ছে না। আপনি কাকে নেবেন কি নেবেন না, সেটা বলে দেওয়ার ওরা কে! এটা একমাত্র আপনার বিষয়। আপনাকে ওরা জ্ঞান দেবে?’’

হতচকিত আশুতোষবাবুর মৃদু জবাব, ‘‘না ম্যাডাম।’’

মুখ্যমন্ত্রী থামেননি। তিনি বলেন, ‘‘এর ফলে ভোগান্তি হচ্ছে পড়ুয়াদের। সাত দিনের মধ্যে নিয়োগ প্রক্রিয়া চালু করতে হবে। নইলে কিন্তু আমি পড়ুয়াদের পক্ষে গিয়ে দাঁড়াব।’’

আরও পড়ুন: কাটমানি খাওয়া চলবে না, কড়া বার্তা মমতার

কিন্তু ‘ওদের’ বলতে ঠিক কাদের সঙ্গে কথা বলার জেরে উপাচার্যকে এ ভাবে হেনস্থা করলেন মুখ্যমন্ত্রী?

বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রের খবর, শিক্ষক, শিক্ষাকর্মী, আধিকারিকদের সমবায় সমিতির নির্বাচনে সম্প্রতি ধরাশায়ী হয়েছেন তৃণমূলপন্থীরা। ‘ওদের’ বলতে মুখ্যমন্ত্রী বিজয়ী বাম শিক্ষাকর্মী ও শিক্ষক সংগঠনের নেতাদেরই বোঝাতে চেয়েছেন। উপাচার্য অবশ্য এ বিষয়ে কোনও মন্তব্য করতে চাননি।

উপাচার্যের ব্যক্তিগত হেনস্থা ছাড়াও এই প্রসঙ্গে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের স্বাধিকারে ফের সরকারি হস্তক্ষেপের অভিযোগ উঠছে। মুখ্যমন্ত্রী এ দিন যে-ভাষা ও ভঙ্গিতে উপাচার্যকে ধমকেছেন এবং নির্দেশ দিয়েছেন, তা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাধিকারে হস্তক্ষেপেরই সামিল বলে মনে করছেন শিক্ষক-নেতাদের কেউ কেউ।

টিএমসিপি নেতা কুণাল সামন্ত অভিযোগ করেন, বিভিন্ন পরীক্ষার ফল প্রকাশে দেরি হওয়ায় পড়ুয়াদের অসুবিধা হচ্ছে। শুনেই উপাচার্যকে মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশ, ‘‘অ্যাকাডেমিক ক্যালেন্ডার তৈরি করতে হবে। অন্য কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ফল প্রকাশ করতে হবে আগেই। কী করে করবেন, সেটা আপনার বিষয়। কিন্তু করতেই হবে।’’ তিনি অভিযোগের সুরে উপাচার্যকে বলেন, ‘‘আপনি তো কোনও বিষয়েই প্রস্তাব পাঠান না। কেন পাঠান না?’’

বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) যে নন-নেট রিসার্চ স্কলারদের বৃত্তি বন্ধ করে দিয়েছে, এ দিনের বৈঠকে মুখ্যমন্ত্রীর কাছে সেই বিষয়টি তোলেন এক পড়ুয়া।

মুখ্যমন্ত্রী আশ্বাস দেন, ‘‘আমরা ইউজিসি-কে একটা স্ট্রং লেটার (কড়া চিঠি) দেবো। আমরা এর বিরোধিতা করবো। প্রয়োজন হলে আমাদের যে-মেধাবৃত্তি আছে, তা থেকে (ওই বৃত্তি) দেওয়া যেতে পারে।’’ পড়ুয়াদের প্রতি তাঁর পরামর্শ, ‘‘তার আগে ফেসবুক, টুইটার, সোশ্যাল নেটওয়ার্কে এই নিয়ে প্রচার চালাও। তোমরা আমার নাম করে বলবে যে, আমি তোমাদের সঙ্গে আছি।’’

টানা ধমকধামক-নির্দেশের পরে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, ‘‘আজ আশুবাবুকে অনেক দায়িত্ব দিলাম। তোমাদের মধ্যে যে-সব রিসার্চ স্কলার রয়েছে, তারা গিয়ে ওঁকে একটু ধরবে। মনে করিয়ে দেবে, যেন ভুলে না-যান।’’

প্রকাশ্যে এ ভাবে হেনস্থা হওয়ার পরে অনেকেই আশুতোষবাবুর কাছে জানতে চান, তিনি পদত্যাগের কথা ভাবছেন কি না। উপাচার্য কথা বাড়াননি। বিতর্কে জড়াতে চাননি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন