হয় চুপ, নয় ক্ষমাতেই খুশি ‘দিদি’র প্রমীলা বাহিনী

শাসক দলের সাংসদ বলছেন, দলের ছেলেদের দিয়ে ‘রেপ’ করিয়ে দেবেন! মেয়েদের প্রতি এত বড় অসম্মানেও মুখ ফুটে শাস্তির দাবি করতে পারলেন না ওঁরা। ওঁদের মধ্যে কেউ দলের বিধায়ক, কেউ সাংসদ, কেউ দলীয় নেত্রী, কেউ বা দিদি-ঘনিষ্ঠ অভিনেত্রী! টেলিভিশনে সোমবার দিনভর তাপস পালের মন্তব্য নিয়ে তুমুল শোরগোল হয়েছে। মঙ্গলবারও খবরের শিরোনাম দাদার কীর্তি-ময়। সোশ্যাল মিডিয়ায় ছিছিক্কারের ঢেউ। তার পরেও শাসক দলের অনেক মহিলা বিধায়ককেই দিনের শেষে অবলীলায় বলতে শোনা গেল, “উনি ঠিক কী বলেছেন, শুনিনি। বিষয়টা জানি না।”

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

কলকাতা শেষ আপডেট: ০২ জুলাই ২০১৪ ০৩:২০
Share:

শাসক দলের সাংসদ বলছেন, দলের ছেলেদের দিয়ে ‘রেপ’ করিয়ে দেবেন! মেয়েদের প্রতি এত বড় অসম্মানেও মুখ ফুটে শাস্তির দাবি করতে পারলেন না ওঁরা। ওঁদের মধ্যে কেউ দলের বিধায়ক, কেউ সাংসদ, কেউ দলীয় নেত্রী, কেউ বা দিদি-ঘনিষ্ঠ অভিনেত্রী!

Advertisement

টেলিভিশনে সোমবার দিনভর তাপস পালের মন্তব্য নিয়ে তুমুল শোরগোল হয়েছে। মঙ্গলবারও খবরের শিরোনাম দাদার কীর্তি-ময়। সোশ্যাল মিডিয়ায় ছিছিক্কারের ঢেউ। তার পরেও শাসক দলের অনেক মহিলা বিধায়ককেই দিনের শেষে অবলীলায় বলতে শোনা গেল, “উনি ঠিক কী বলেছেন, শুনিনি। বিষয়টা জানি না।” মহিলা হিসেবে তাপসবাবুর মন্তব্যে তাঁরা অসম্মানিত বোধ করছেন কি না, সে কথা জানাতেও তাঁরা কুণ্ঠিত। রাজ্যের মন্ত্রী তথা মহিলা তৃণমূলের সভানেত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য, হলদিয়ার শিউলি সাহা বা জোড়াসাঁকোর বিধায়ক স্মিতা বক্সী নির্বিবাদী সুরে জানালেন, দল তাপসবাবুর কাছে লিখিত বিবৃতি চেয়েছে। এ ব্যাপারে তাঁদের আর কোনও বক্তব্য নেই। শাস্তি চাওয়ার ধারেকাছেই গেলেন না তাঁরা।

অথচ তৃণমূলের নেত্রীরা বলিয়ে-কইয়ে নন, এ রকম মোটেই নয়। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন প্রশ্নে ঝটিতি প্রতিক্রিয়া জানিয়ে থাকেন তাঁরা। বিশেষত সেটা যদি আত্মপক্ষ সমর্থনের ব্যাপার হয়। পার্ক স্ট্রিট ধর্ষণের ঘটনার পরে মুখ্যমন্ত্রী যখন সেটাকে ‘সাজানো ঘটনা’ বলেছিলেন, তার কিছু দিন পরেই সাংসদ কাকলি ঘোষদস্তিদার ধর্ষিতার চরিত্র নিয়ে আঙুল তুলেছিলেন। গোটা ঘটনাটিকে টাকাপয়সার বখরা নিয়ে বচসা বলে বর্ণনা করেছিলেন। এ দিন কাকলি প্রত্যাশিত ভাবেই তাপস নিয়ে মন্তব্য এড়িয়ে গিয়ে বলেছেন, “মহিলাদের সুরক্ষার বিষয়ে আমাদের দল গুরুত্ব দেয়। মুখ্যমন্ত্রী এ জন্য অনেক পরিকল্পনা নিচ্ছেন। সাংসদ তহবিলের টাকায় সিসিটিভি লাগানো হচ্ছে।” নীরব থেকেছেন রাজ্য মহিলা কমিশনের সদস্য, প্রাক্তন বিধায়ক এবং সাংসদ সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়ের স্ত্রী নয়না বন্দ্যোপাধ্যায়।

Advertisement

বিষয়টা এড়িয়ে গিয়েছেন বিধায়ক ফিরোজা বিবি, অসীমা পাত্র বা হরিণঘাটার নীলিমা নাগরা-ও। কেউ বললেন, সারাদিন বিধানসভায় ব্যস্ত থাকায় টিভি দেখার সময়ই পাননি। কেউ বললেন, এমএলএ হস্টেলে টিভি খারাপ। নন্দীগ্রাম আন্দোলন থেকে উঠে আসা বিধায়ক ফিরোজা বললেন, টিভিতে নেতা-মন্ত্রীদের বক্তব্য বিকৃত করে দেখানো হয়। তাই চাক্ষুষ না দেখে মন্তব্য করতে চান না। শিশু ও সমাজকল্যাণ দফতরের প্রতিমন্ত্রী শশী পাঁজা এবং দলের শ্রমিক সংগঠনের নেত্রী দোলা সেন অবশ্য সাংসদের অশালীন ভাষা ব্যবহারের নিন্দা করেছেন।

কেন চুপ দলের বড় অংশটি? দলের অন্দরের একটি সূত্রের দাবি দলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় গোটা ঘটনাটির নিন্দায় কতটা সরব হবেন বা হবেন না, সেটা না-বুঝে আগ বাড়িয়ে মুখ খুলে বিপদ ডেকে আনতে চান না কেউই। উস্কানিমূলক কুকথার স্রোত রাজ্য রাজনীতিতে গত কয়েক বছর ধরেই বইছে। খোদ তাপস এর আগেও মারধরের হুমকি দিয়ে কথা বলেছেন। বীরভূমের দুই দাপুটে নেতা অনুব্রত মণ্ডল এবং মনিরুল ইসলামরা খুনের হুমকি দিয়ে, নিজমুখে খুন করার কথা কবুল করেও বহাল তবিয়তে ঘুরছেন। দলনেত্রী তাঁদের বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নেওয়া তো দূর, তাঁদের কার্যকলাপের নিন্দা পর্যন্ত করেননি। বরং অনুব্রতর বিরুদ্ধে সংবাদমাধ্যম সরব হওয়ায় প্রকাশ্য সভায় অনুব্রতকে প্রশ্রয়ের সুরে বলেছেন, “কিছু চেয়েছিল দিসনি নাকি? মুড়ি-নারকেল দিলে তো পারতিস!’’ এই আবহে তাপসকে নিয়ে কড়া কথা বললে ‘দিদি’ তা পছন্দ করবেন কি না, সেই সংশয় অনেকের মনেই ছিল।

বলতে মানা সবিস্তার দেখতে ক্লিক করুন...

সংশয় বাড়িয়ে দিয়েছিলেন মমতা নিজেও। এ দিন অনেক ক্ষণ পর্যন্ত তাঁকে বিষয়টি নিয়ে সরাসরি মন্তব্য করতে দেখা যায়নি। পরে ডায়মন্ড হারবারের সাংবাদিক সম্মেলনে তিনি বলেন, তাপস ‘বিগ ব্লান্ডার’ করেছেন। কিন্তু তাপসকে শাস্তি দেওয়া হবে কি না, সে প্রশ্ন করতেই রেগে যান তিনি। তুলনায় ধারাবাহিক ভাবে কুকথার বিরোধিতা করে আসছেন সাংসদ শতাব্দী রায়। এর আগে তাপসই হোন বা অনুব্রত, উস্কানিমূলক কথা সমর্থন করেননি শতাব্দী। এ দিনও বলেছেন, “মানুষ তাপস পাল এমন নন। কোনও ভাবে শারীরিক বা মানসিক অসতর্ক মুহূর্তে এ সব বলে ফেলেছেন। ওঁরও মেয়ে রয়েছে। জনসমক্ষে ওঁর ক্ষমা চাওয়া উচিত।”

জঙ্গলমহলে ব্যস্ত থাকায় সোমবার টিভি দেখার ফুরসত পাননি মুনমুন সেন। কিন্তু লোকমুখে যেটুকু শুনেছেন, তাতে দলের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হচ্ছে বলেই মত সুচিত্রা-কন্যার। তাঁর দেখা তাপসের সঙ্গে টিভিতে দেখা তাপসকে মেলাতে পারেননি সাংসদ সন্ধ্যা রায়ও। বলছিলেন, “জ্ঞানত তাপস এমন উক্তি করতে পারে বলে বিশ্বাস করতে পারছি না! দেখা হলে ওকে জিজ্ঞাসা করব কী হয়েছিল। ওকে বকব।”

সন্ধ্যা-মুনমুন-শতাব্দীরা টালিগঞ্জ ইন্ডাস্ট্রির সিনিয়র সদস্য। কিন্তু এক ঝাঁক নবীন অভিনেত্রী ইদানীং শাসক দলের খুবই ঘনিষ্ঠ। সরকারি অনুষ্ঠানে, নির্বাচনী প্রচারে সদা সর্বদা তাঁদের দেখা মেলে। দিন কয়েক আগে ইডেনে কেকেআরের সংবর্ধনায় তাঁদের অংশগ্রহণ নিয়ে যখন কটাক্ষ করেছিলেন কৌতুকশিল্পী মীর, এঁরা সে দিন তৎক্ষণাৎ প্রতিবাদে মুখর হয়েছিলেন। তাঁদের অগ্রজ সহকর্মীর কাজকর্মে তাঁরাই নীরব ও নির্বিকার। বেশির ভাগই ব্যস্ত বা বিষয়টি জানেন না বলে এড়িয়ে গেলেন।

জুন মালিয়া এবং লকেট চট্টোপাধ্যায় অবশ্য তাপসের ক্ষমা চাওয়ার দাবি তুলেছেন। জুন রাজ্য মহিলা কমিশনেরও সদস্য। তাঁর দাবি, “কমিশনের পরের বৈঠকে তাপসদার বক্তব্য নিয়ে আলোচনা হবে। সবাই মিলে একটা সিদ্ধান্ত হবে হয়তো।”

তাপসের শাস্তির দাবি তোলা হবে কি? কেউই সদুত্তর দিতে পারেননি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন