ব্যাঙ্কক এশিয়া কাপে তিরন্দাজিতে ব্রোঞ্জ এনেছিলেন নয়াগ্রামের মনিকা সরেন। দরিদ্র পরিবারের মেয়েটির আক্ষেপ ছিল উন্নত সরঞ্জামে অনুশীলন করতে পারলে ফল আরও ভাল হত। শুক্রবার কন্যাশ্রী দিবসে নজরুল মঞ্চে মনিকার হাতে তিরন্দাজির সরঞ্জাম তুলে দিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। মনিকা জানালেন, তাঁর লক্ষ্য বিশ্বকাপ ২০১৬। ছবি: দেবাশিস রায়।
কন্যাশ্রীকে আর শুধু প্রকল্প হিসেবে দেখতে চাইছেন না মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। চাইছেন স্কুল পড়ুয়ারা রীতিমতো এই প্রকল্প নিয়ে পড়াশোনা করে পরীক্ষা দিক। তাই শুক্রবার কন্যাশ্রী দিবসের অনুষ্ঠানের মঞ্চ থেকেই সরকারি স্কুলের ছেলেমেয়েদের পাঠ্যক্রমের বিষয় হিসেবে কন্যাশ্রীকে অন্তর্ভুক্ত করার কথা ঘোষণা করলেন তিনি।
এ দিন মঞ্চে উপস্থিত মন্ত্রী ও আমলাদের সামনেই মুখ্যসচিব সঞ্জয় মিত্রকে সামনে ডেকে নেন মমতা। মাইক্রোফোনে বলেন, ‘‘কন্যাশ্রী একটা সাবজেক্ট হওয়া উচিত। কন্যাশ্রীতে নথিভুক্ত মেয়েদের সঙ্গে কথা বলে একটা পরিকল্পনা তৈরি করে সিলেবাস কমিটিতে পাঠাতে হবে। আমরা যেটা করব একেবারে এ টু জেড করব।’’ এর পরেই মুখ্যমন্ত্রী যোগ করেন, ‘‘এখানে সবাই আছেন। সবার সামনেই ঘোষণা করলাম। আগামী কন্যাশ্রী দিবসে এটা শেষ করে প্রেজেন্ট করতে হবে। কন্যাশ্রী একটা অভিধান হয়ে যাবে এক দিন। সবাই নিজের জন্মদিন যেমন মনে রাখেন, তেমনই কন্যাশ্রী দিবস মনে রাখবেন। আজ যে কন্যাশ্রী, আগামী দিনে তিনিই ভাগ্যশ্রী। কন্যাশ্রী জিন্দাবাদ।’’
মঞ্চে শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ও ছিলেন। অনুষ্ঠানের শেষে তাঁকে কন্যাশ্রীর স্কুলপাঠ্যে অন্তর্ভুক্তি বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে মন্ত্রী বলেন, ‘‘কী ভাবে বিষয়টা হবে, সেটা ভাবতে হবে। সবার সঙ্গে, শিক্ষাবিদদের সঙ্গে কথা বলতে হবে। আমার মনে হচ্ছে কন্যাশ্রী প্রকল্পে নথিভুক্ত কিছু মেয়ের জীবনের সাফল্যের কথা সিলেবাসে ঢোকানো হবে। তবে মুখ্যমন্ত্রী ঠিক কী চাইছেন তা নিয়ে ওঁর সঙ্গে আলাদা করে আমি কথা বলব।’’ মুখ্যমন্ত্রী এ দিন ইঙ্গিত দিয়েছেন, পাঠ্যসূচি তৈরি হবে ছাত্রীদের সঙ্গে কথা বলে। তবে কি শুধু ছাত্রীরাই তৈরি করবে গোটা পাঠ্যসূচি? সে বিষয়ে অবশ্য সদুত্তর দিতে পারেননি কেউ।
তবে মুখ্যমন্ত্রীর এ দিনের সিদ্ধান্তে শিক্ষাবিদদের একটা বড় অংশ বিস্মিত। একটি সরকারি প্রকল্প কী ভাবে স্কুলের পাঠ্যসূচিতে ঢুকতে পারে, তা তাঁদের বোধগম্য হচ্ছে না। মীরাতুন নাহার বললেন, ‘‘মাথাটা বোধহয় চাপে পড়ে সত্যিই গোলমাল হয়ে গিয়েছে। আমার জ্ঞানবুদ্ধিতে এর আর কোনও অর্থ বার করতে পারছি না।’’ আবার পবিত্র সরকারের মন্তব্য, ‘‘আমার ক্ষুদ্র বুদ্ধিতে এটা বোধগম্য হচ্ছে না। তবে মুখ্যমন্ত্রী হয়তো ভাবছেন এটা একটা বিশাল কীর্তি যার জন্য তিনি অমর হয়ে থাকবেন।’’
মুখ্যমন্ত্রী অবশ্য এ দিন শুধু এই ঘোষণাতেই থামেননি। যে সব কিশোরী এই প্রকল্পে নথিভুক্ত হয়েছে, তাদের আঠারো বছর বয়স হলে সরকারি তরফে একটি শংসাপত্র দেওয়ার কথাও জানিয়েছেন। পরবর্তী কালে উচ্চশিক্ষা বা সরকারি চাকরি পাওয়ার ক্ষেত্রে এটি তাদের ‘বায়োডাটা’কে সমৃদ্ধ করবে বলেও মন্তব্য করেন মমতা। সমাজকল্যাণ মন্ত্রী শশী পাঁজা ও সচিব রোশনী সেনকে ডেকে বলেন, ‘‘আপনারা দয়া করে শুনে নিন, এই শংসাপত্র কন্যাশ্রীর মেয়েদের দেওয়াটা কিন্তু বাধ্যতামূলক ও খুব গুরুত্বপূর্ণ।’’
কন্যাশ্রী কতটা সফল এবং বিদেশে কতটা সমাদৃত তা বোঝাতে গিয়ে এ দিন নাম না-করে বিরোধী শিবির বিশেষত বিজেপিকে বিঁধেছেন মুখ্যমন্ত্রী। সেই সঙ্গেই ইঙ্গিত দিয়েছেন, গঠনমূলক সমালোচনাও তিনি শুনতে রাজি। তাঁর কথায়, ‘‘আমাকে অনেকের অপছন্দ হতে পারে, তা বলে আমার রাজ্যকে অপমান করার সাহস যেন কেউ না দেখায়। আমি সমালোচনা ভালবাসি, তাতে কাজ অনেক ইতিবাচক ও গঠনমূলক হয়। কিন্তু কিছু লোক নিজে কুচুটে আর পরের কোনও ভাল দেখতে পায় না। মন্থরা আর কৈকেয়ীয়ের মতো। মুখটা দেখলে মনে হয় সেটা কুঁকড়ে রয়েছে। শুধু শব্দদূষণ করে।’’
সম্প্রতি রাজ্যে নারী নির্যাতনের ঘটনায় বিজেপির প্রবল সমালোচনার মুখে পড়তে হয়েছে তাঁর সরকারকে। নাম না করে এ দিন বিজেপিকে তারই জবাব ফিরিয়ে দিয়েছেন মমতা। বলেছেন, ‘‘এখানে মেয়েদের উপর অত্যাচার হচ্ছে বলে চিৎকার করছেন। একজন খারাপ হওয়া মানে সবাই খারাপ নয়। কেউ জন্ম থেকে খারাপ হয় না। কেউ ভুল করলে তাঁকে শোধরাতে হয়।’’ তাঁর আরও বক্তব্য, ‘‘যাঁরা কুটুস-কুটুস করে কৈকেয়ী আর মন্থরাগিরি করছে তারা একবার এটা তো বলতে পারে যে, কন্যাশ্রী খুব ভাল হয়েছে। ২৭ লক্ষ মেয়ের অনলাইন নথিভুক্তকরণ হয়ে গিয়েছে।’’
অনুষ্ঠানের মঞ্চেই মুখ্যমন্ত্রী এ দিন ঘোষণা করেছেন অষ্টম, নবম ও দশম শ্রেণির মোট ৪০ লক্ষ ছাত্র ও ছাত্রীকে কন্যাশ্রী প্রকল্প থেকে সাইকেল দেওয়া হবে।