বিষণ্ণ মঞ্জুলকৃষ্ণ ঠাকুর। পাশে ছেলে সুব্রত। নিজস্ব চিত্র
সকাল দেখে নাকি বোঝা যায়, দিনটা কেমন যাবে। সোমবারটা সে দিক থেকে ব্যতিক্রম হয়ে রইল মঞ্জুলকৃষ্ণ ঠাকুরের কাছে।
শুরুটা হয়েছিল বেশ খোশমেজাজেই। সকাল তখন সাতটা হবে। রাজ্যের প্রাক্তন মন্ত্রী বলছিলেন, “গত রাতে বৃষ্টি হয়েছে। মনে হচ্ছে, আমাদের জন্য পুষ্পবৃষ্টি।” ‘আমাদের’ মানে, পিতা এবং পুত্র। ‘আমাদের’ মানে, বিজেপি। তৃণমূল ছেড়ে, মন্ত্রিত্ব ছেড়ে সদ্য বিজেপিতে নাম লিখিয়েছেন মঞ্জুল। তাঁর ছেলে সুব্রত ঠাকুরই বনগাঁ লোকসভা আসনে বিজেপি প্রার্থী।
বিকেলবেলা পুষ্পবৃষ্টি হল ঠিকই, তবে সুব্রত বা মঞ্জুলের জন্য নয়। বৌদি মমতাবালার জন্য। তৃণমূল সমর্থকেরা শুধু ফুল ছিটিয়েই ক্ষান্ত হলেন না, বাজি-পটকাও ফাটলো যথেষ্ট। পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকল মঞ্জুলের বিরক্তি। শেষ অবধি বাড়ির বাইরে মোতায়েন পুলিশের কাছে গিয়ে মঞ্জুলকৃষ্ণ নালিশ ঠুকে এলেন, ‘‘এত শব্দ কেন? এত বাজি কেন? আমরা নিরাপত্তার অভাব বোধ করছি!”
ঠাকুরবাড়ির অন্দরমহলে চিড় ধরেছে অনেক দিনই। মঞ্জুলের দাদা কপিলকৃষ্ণের মৃত্যুতেই খালি হয়েছিল বনগাঁ লোকসভা আসনটি। সেই ইস্তক দেওর-বৌদির কাজিয়া চলছেই। এ দিন মমতা-ব্রিগেডের কাছে একেবারে পর্যুদস্ত হয়ে গেলেন দেওর-পক্ষ। মমতার প্রার্থী মমতাবালা দেওর-পুত্রকে একেবারে তিন নম্বরে নামিয়ে দিয়েছেন। এতটা নাকানিচোবানি খেতে হবে, ভাবেননি বাবা-ছেলে কেউই।
সকাল সকাল মতুয়া মহাসঙ্ঘ কার্যালয়ের বারান্দায় দাঁড়িয়ে মোবাইলে কথা বলছিলেন সুব্রত। বেশ আত্মবিশ্বাসী গলাতেই ও দিকের শ্রোতাকে বললেন, “মনে হচ্ছে, ফল ভালই হবে।” একটু পরে সাদা পাজামা-পাঞ্জাবি, জহর কোট গায়ে চাপিয়ে বাবা-মা আর বড়মা বীণাপাণি দেবীকে প্রণাম করে বেরিয়ে গেলেন দীনবন্ধু মহাবিদ্যালয়ের উদ্দেশে। গণনা চলছিল সেখানেই। সঙ্গে গেলেন বিজেপির জেলা নেতা শঙ্কর চট্টোপাধ্যায়।
অন্য দিকে সাড়ে আটটা নাগাদ স্নানটান সেরে বড়মার ঘরে ঢুকলেন সুব্রতর ‘জেঠিমা’ মমতাবালা। প্রণাম করে আশীর্বাদ চাইতেই বড়মা বলেন, “ঈশ্বর তোমার সঙ্গে আছেন। জয়ী হও।” এর পরে মেয়ে চন্দ্রলেখাকে সঙ্গে নিয়ে গণনাকেন্দ্রের উদ্দেশে বেরিয়ে যান মমতাও।
মঞ্জুল অবশ্য এ দিন বাড়ি থেকে বেরোননি। উত্তেজনায় পায়চারি করতে করতে মাঝে মাঝেই উঠোনে, সেখান থেকে রাস্তায় চলে আসছিলেন। একটা চায়ের দোকানে টিভি চলছিল। সেখানে গণনার খোঁজখবর নিচ্ছিলেন। দোকানে বসে-থাকা লোকজন তাঁকে ভরসা জোগাচ্ছিলেন, “এখনও অনেক রাউন্ড বাকি। চিন্তা করবেন না।”
জয়ের পর বড়মার আশীর্বাদ মমতাবালা ঠাকুরকে। সোমবার নির্মাল্য প্রামাণিকের তোলা ছবি।
রাউন্ড যত এগোল, চিন্তা ক্রমশ দুশ্চিন্তার আকার নিল। ছেলে ক্রমাগত পিছিয়ে পড়ছেন দেখে নিজেকে ঘরবন্দি করে ফেললেন মঞ্জুল। ১০টা নাগাদ প্রথম রাউন্ডের গণনার পরে সুব্রতও গণনাকেন্দ্র থেকে বেরিয়ে আসেন। সময় যত গড়ায়, ততই ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে যান মমতা। হার নিশ্চিত বুঝে বেলা ১টা নাগাদ সুব্রত বাড়ি ফিরে আসেন।
তত ক্ষণে গোটা ঠাকুরবাড়ি চত্বর চলে গিয়েছে তৃণমূলের কমর্ীর্-সমর্থকদের দখলে। দূর-দূরান্ত থেকে মতুয়া-ভক্তরাও জড়ো হতে শুরু করেছেন। বেলা তিনটে নাগাদ শুরু হল সবুজ আবির খেলা। সঙ্গে নাচ। হাতে তৃণমূল এবং মতুয়াদের পতাকা নিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং মমতা ঠাকুরের নামে জয়ধ্বনি। নাটমন্দিরে তারস্বরে হরিসঙ্গীত। মাইকে ঘোষণা হল, “কিছু ক্ষণ বাদেই আমাদের মা মমতা ঠাকুর এখানে এসে পৌঁছবেন।” মাথায় তৃণমূলের পতাকা বেঁধে ভুভুজেলা বাজাতে বাজাতে ঠাকুরবাড়ির বাইরে তখন মোটরবাইকে চক্কর দিচ্ছেন এক দল যুবক। গণনাকেন্দ্রের মধ্যেই রাজ্যের মন্ত্রী, তৃণমূল নেতা জ্যোতিপ্রিয় মল্লিককে মিষ্টিমুখ করালেন মমতা।
বিকেল সাড়ে ৪টে নাগাদ ঠাকুরবাড়িতে পা রাখলেন বনগাঁর নতুন সাংসদ। মমতা গাড়ি থেকে নামামাত্র ভক্তদের সমবেত উল্লাস তুঙ্গে উঠল। ডঙ্কা, কাঁসির সঙ্গে ‘জয় হরিবোল’ ধ্বনিতে তখন ঠাকুরবাড়ি কম্পমান। ভক্তদের ভিড় থেকে বাঁচিয়ে কোনও রকমে মানববন্ধন করে মমতাকে ভিতরে নিয়ে যাওয়া হল। তাঁকে মালা পরিয়ে মাথায় ফুল ছেটাতে লাগলেন ভক্তরা। মমতাবালা প্রথমে হরিচাঁদ ঠাকুরের মন্দিরে এবং শ্বশুর প্রমথরঞ্জন ঠাকুরের স্মৃতিমন্দিরে প্রণাম করলেন। স্বামী কপিলকৃষ্ণের বেদীতে প্রণাম করতে গিয়ে চোখের জল চাপতে পারলেন না। তার পরে বড়মার ঘরে গিয়ে তাঁর পা ছুঁয়ে বললেন, “আমি জয়ী হয়েছি।” ঘরের বাইরে তখন শুরু হয়েছে মাতাম (মতুয়াদের প্রথাগত নাচ)। নাচতে নাচতেই ভক্ত শম্পা দাস মণ্ডল বললেন, “এত আনন্দ কোনও দিন পাইনি। ভোটে কারও জয়ে এমন আনন্দ করিনি।” আর সবাইকে রসগোল্লা খাইয়ে মমতার বক্তব্য, “এই জয় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রতি মানুষের ভালবাসার জয়।”
বাড়ির অন্য অংশে এর ঠিক উল্টো ছবি তখন। ছোট ছেলে শান্তনু এবং স্ত্রী ছবিদেবীকে নিয়ে উঠোনে চেয়ার পেতে বসে রয়েছেন বিমর্ষ মঞ্জুল। পরিচিত লোক দেখলেই জানতে চাইছেন, “কেন এমন ফল হল?” বাড়ির ভিতরে জয়ের উল্লাস যত বাড়তে থাকে, পাল্লা দিয়ে বাড়ে মঞ্জুলের বিরক্তিও। ভোটের দিনও সাতসকালে বড়মাকে দেখতে না পেয়ে বিরক্ত হয়েছিলেন। অভিযোগ করেছিলেন, তৃণমূলীরা বড়মাকে হাইজ্যাক করেছে! এ দিন একটা সময় আনন্দধ্বনি সহ্য করতে না পেরে সটান পুলিশের কাছে চলে গেলেন। বললেন, “দেখুন কী হচ্ছে এখানে!” তাঁর অভিযোগ, “ভোটে জিতে তৃণমূল ঠাকুরবাড়ির ভিতরে রাজনীতি শুরু করেছে। বাড়ির চারপাশে শব্দবাজি ফাটানো হচ্ছে। তৃণমূল কর্মীরা ঠাকুরবাড়ির কর্মীদের ভয় দেখাচ্ছে।”
এমন অভিযোগ অবশ্য ভিত্তিহীন বলে বলেই দাবি করলেন মমতাবালা। বললেন, “উনি (মঞ্জুল) নির্ভয়ে থাকতে পারেন। মতুয়া ভক্তরা এমন কিছু করবেন না, যাতে ওঁর সমস্যা হয়।” আর জ্যোতিপ্রিয় মল্লিকের প্রতিক্রিয়া, “ভোটের ফল বোঝা যেতেই মঞ্জুলের বাড়ির সামনে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে। তার পরেও এমন অভিযোগ সম্পূর্ণ মিথ্যা।” জ্যোতিপ্রিয়র কথা তাঁকে বলতেই ঝাঁঝিয়ে উঠলেন মঞ্জুল, “ওই লোকটার নাম আমার সামনে তুলবেন না! ঠাকুরবাড়ির মধ্যে যত্ত সব রাজনীতি আর ঝামেলার চক্রান্ত করা হচ্ছে!”
মঞ্জুল-পুত্র অবশ্য তখন ঠাকুরবাড়িতে নেই। আগেই বেরিয়ে গিয়েছেন কলকাতায় বিজেপির রাজ্য দফতরের উদ্দেশে। রাত ন’টা নাগাদ কলকাতা থেকেই জেঠিমাকে ফোন করেছিলেন। বেজে গিয়েছিল। অতএব অভিনন্দন জানাতে হল এসএমএস-এই। জেঠিমা পরে দেখেছেন সেই এসএমএস। বলেছেন, “এসএমএস পাঠানোর জন্য ওকে ধন্যবাদ।”