পিস্তল ঠেকিয়ে অফিসার বললেন, সই কর

মেগাস্টার শাহরুখ খান নন তিনি। বিমানবন্দরটাও আমেরিকার নয়। রূপককুমার নাগ বেলঘরিয়ার নিতান্ত ছাপোষা বাঙালি যুবক। এবং বিমানবন্দরটা হংকংয়ের!

Advertisement

সুনন্দ ঘোষ

কলকাতা শেষ আপডেট: ০৮ সেপ্টেম্বর ২০১৬ ০৩:২৬
Share:

রূপককুমার নাগ

মেগাস্টার শাহরুখ খান নন তিনি। বিমানবন্দরটাও আমেরিকার নয়।

Advertisement

রূপককুমার নাগ বেলঘরিয়ার নিতান্ত ছাপোষা বাঙালি যুবক। এবং বিমানবন্দরটা হংকংয়ের!

তবু দুঃসহ অভিজ্ঞতায় শাহরুখের পাশে চলে আসছে রূপকের নাম। মার্কিন বিমানবন্দরে তল্লাশির নামে বলিউডের বাদশাকে বারবার যে-ভাবে হেনস্থা করা হয়েছে, হংকং বিমানবন্দরে সেই নিগ্রহের মুখে পড়তে হয়েছে বাংলার রূপককে। বেড়াতে বেরোনো বাঙালি যুবকটিকে শেষ পর্যন্ত সে-দেশে ঢুকতে দেওয়া হয়নি। ফেরত পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। বিশ্বায়নের যুগে পর্যটনে বেরোনো এক ভারতীয় নাগরিককে কেন বিদেশি বিমানবন্দরে হেনস্থা করা হবে এবং তাঁকে ফেরত পাঠানো হবে, সেই প্রশ্ন পৌঁছে গিয়েছে দিল্লি পর্যন্ত।

Advertisement

ঠিক কী হয়েছিল?

কলকাতা থেকে রওনা হয়ে ২৯ অগস্ট বিকেলে হংকং বিমানবন্দরে নামেন রূপক। তার পরে ১৬ ঘণ্টা ধরে তাঁকে বিমানবন্দরে আটকে রেখে জেরা করা হয়। তল্লাশ করা হয় তাঁর দেহ ও ব্যাগ। তাঁর কপালে পিস্তল ঠেকিয়ে সই করিয়ে নেওয়া হয় কাগজে। এবং শেষ পর্যন্ত তাঁকে সে-দেশে ঢুকতে না-দিয়ে সোজা ফেরত।

বেসরকারি সংস্থার কর্মী রূপক টাকা জমিয়ে সিঙ্গাপুর-মালয়েশিয়া-ব্যাঙ্কক ঘুরে এসেছেন। কিন্তু এ বার হংকং ঘুরতে গিয়ে মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত হয়ে বাড়ি ফিরতে হয়েছে তাঁকে। ফিরেই ই-মেল করে পুরো বিষয়টি বিদেশমন্ত্রী সুষমা স্বরাজকে জানান তিনি। তার পরে হংকং থেকে ভারতীয় দূতাবাসের অফিসার বীরেন্দ্র শর্মা পাল্টা মেল করে তাঁকে জানান, বিষয়টি নিয়ে হংকং সরকারের সঙ্গে কথা বলছে বিদেশ মন্ত্রক।

‘‘হংকংয়ের অফিসারদের বারবার জিজ্ঞাসা করেছি, আমরা অপরাধটা কী? উত্তর পাইনি। শুধু নাগাড়ে জেরা। একই কথা বলতে হয়েছে একশো বার। এক অফিসার একটি কাগজে সই করতে বললেন। আমি বললাম, কাগজে কী লেখা আছে, তা পড়ে তবেই সই করব। শুনে ওই অফিসার কোমরে গোঁজা বন্দুক বার করে আমার কপালে ঠেকিয়ে বললেন, ‘সই কর’। আমি সই করতে বাধ্য হলাম।’’

কিন্তু কেন এই হেনস্থা?

বীরেন্দ্র শর্মা হংকং থেকে ফোনে জানান, রূপক একা নন। অনেক ক্ষেত্রে ভারতীয় দেখলেই এ ভাবে হেনস্থা করা হচ্ছে হংকং বিমানবন্দরে। কোনও ভারতীয় নামলেই চেপে ধরছেন অভিবাসন অফিসারেরা। প্রশ্নের পর প্রশ্ন। বারে বারে দেহ ও ব্যাগ তল্লাশি। ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসিয়ে রাখা হচ্ছে বিমানবন্দরে।

বীরেন্দ্র জানান, ভারতীয় পর্যটক বাড়াতে সম্প্রতি হংকং সরকার একটি নিয়ম চালু করে জানায়, ভারতীয়েরা শুধু পাসপোর্ট নিয়েই সে-দেশে নামতে পারবেন। আগে থেকে বা ও-দেশে গিয়ে ভিসা করাতে হবে না। শর্ত, হংকংয়ে নামার ১৪ দিনের মধ্যে সে-দেশ ছাড়তে হবে। অভিযোগ, অভিবাসনের এই নতুন নিয়মে প্রথম দিকে ভাল সাড়া পাওয়া গেলেও তা পরে নাকি ব্যুমেরাং হয়ে যায়!

‘‘হংকং সরকারের তরফে আমাদের কাছে অভিযোগ করা হয়েছে, এই সুবিধা নিয়ে বহু ভারতীয় ভিসা ছাড়া বেড়ানোর অছিলায় এ দেশে এসে পাকাপাকি ভাবে থেকে যাচ্ছেন। বেশ কিছু ভারতীয়কে গ্রেফতার করা হয়েছে, যাঁরা শুধু পাসপোর্ট নিয়ে এ দেশে এসে আর ফিরে যাননি। বলা হচ্ছে, এর জন্য হংকংয়ের অর্থনীতির উপরে অতিরিক্ত চাপ পড়ে যাচ্ছে,’’ বললেন বীরেন্দ্র। তিনি জানান, ধাক্কা খেয়ে হংকং সরকার শেষ পর্যন্ত ভিসা-হীন ভ্রমণের এই নিয়ম পরিবর্তন করতে চলেছে।

যাঁরা থেকে যাওয়ার অভিসন্ধি নিয়ে ওই ভিসা-হীন ব্যবস্থার সুযোগ নিচ্ছেন, তাঁদের নিয়ে হংকং সরকারের চিন্তা থাকতেই পারে। কিন্তু রূপকের মতো যাঁরা সত্যি সত্যি বেড়াতে যাচ্ছেন, তাঁদের হয়রান করে ফিরিয়ে দিলে তো হংকং সরকারেরও আর্থিক ক্ষতি। ভ্রমণ সংস্থা সূত্রের খবর, প্রতি বছর অন্তত পাঁচ লক্ষ ভারতীয় হংকংয়ে বেড়াতে যান। সেই সংখ্যা দুম করে কমে গেলে কী করে সামলাবে সে-দেশের সরকার? এই প্রশ্নের উত্তর নেই বীরেন্দ্রের কাছে।

২২ বছর ধরে হংকংয়ে আছেন নিরঞ্জন পাল। আদতে মধ্যমগ্রামের বাসিন্দা নিরঞ্জন এখন ওই দেশের নাগরিক। সেখানেই চাকরি করেন। রূপক আগে থেকে তাঁকে চিনতেন। হংকং বিমানবন্দরে বিপদে পড়ে তিনি যোগাযোগ করেছিলেন নিরঞ্জনের সঙ্গে। এই বিষয়ে ফোন করা হলে নিরঞ্জন বলেন, ‘‘আরে! আমিও তো হংকং বিমানবন্দরের অফিসারদের সঙ্গে কথা বলেছিলাম। রূপকের দায়িত্ব নেব বলেও জানাই। লিখিত ভাবেও কথা দিতে রাজি ছিলাম। কিন্তু ওঁরা রূপককে ছাড়েননি। কেন ছাড়েননি, আমি জানি না।’’

নিরঞ্জন জানান, তাঁর দুই আত্মীয়কে বিমানবন্দরে আটকে রাখা হয়েছিল। তবে শেষে তাঁদের ঢুকতে দেওয়া হয়েছিল হংকংয়ে।

তা হলে রূপকের এমন হেনস্থা কেন, সেটা এখনও রহস্যই। দিল্লি কী ভাবে সেই রহস্য ভেদ করে, বাঙালি যুবকটি তাকিয়ে আছেন সে-দিকেই।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন