‘ঘর’ ছেড়ে বিজেপিতে মনিরুল, সঙ্গে গেলেন গদাধরও

বুধবার নয়াদিল্লিতে বিজেপি-র সদর দফতরে মনিরুলকে দলে স্বাগত জানানো হয়। করা হয় সাংবাদিক বৈঠক।

Advertisement

অর্ঘ্য ঘোষ

লাভপুর শেষ আপডেট: ৩০ মে ২০১৯ ০০:৫৮
Share:

দলত্যাগী: গদাধর হাজরা (বাঁ দিকে) এবং মনিরুল ইসলাম (বাঁ দিক থেকে দ্বিতীয়)। ছবি: পিটিআই।

নিজের দলে কোণঠাসা হয়ে পড়েছিলেন অনেক দিন। ফলে দল বদলের একটা গুঞ্জন তাঁকে ঘিরে ছিলই। বাস্তবে তা-ই হল। তৃণমূল ছেড়ে বিজেপি-তে গেলেন লাভপুরের তৃণমূল বিধায়ক মনিরুল ইসলাম।

Advertisement

বুধবার নয়াদিল্লিতে বিজেপি-র সদর দফতরে মনিরুলকে দলে স্বাগত জানানো হয়। করা হয় সাংবাদিক বৈঠক। তাঁর সঙ্গে এ দিনই বিজেপিতে যোগ দেন নানুরের প্রাক্তন বিধায়ক তথা দলের জেলা যুব সভাপতি গদাধর হাজরা, পাড়ুইয়ের তৃণমূল নেতা নিমাই দাস এবং যুব নেতা মহম্মদ আসিফ ইকবাল। তৃণমূল সূত্রে খবর, গদাধরের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে দুবরাজপুরের বিধায়ক নরেশ বাউরিকে। নরেশবাবু বলেন, ‘‘২০১৪ থেকে ২০১৬ পর্যন্ত আমি জেলায় দলের যুব সভাপতির দায়িত্বে ছিলাম। আজ ফের কলকাতায় ওই দায়িত্ব আমার হাতে তুলে দিলেন অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়।’’

মনিরুল ও গদাধরের যোগদানে অসন্তোষ ছড়িয়েছে বিজেপি-র অন্দরে। দলের লাভপুর মণ্ডল কমিটির সভাপতি সুবীর মণ্ডল প্রকাশ্যেই বলেছেন, ‘‘মনিরুল ইসলাম তৃণমূলে থাকাকালীন আমাদের কর্মী-সমর্থকদের সঙ্গে যে আচরণ করেছেন, তাতে কিছুতেই দলে ওঁর অনুপ্রবেশ মেনে নেব না। কেউ যদি দিল্লি থেকে ওঁকে দলে ঢোকান, তা হলে তিনিই তাঁর কাজের ক্ষেত্র ঠিক করে দেবেন। লাভপুরে ওঁকে কাজ করতে দেব না!’’ নানুর মণ্ডল কমিটির সভাপতি বিনয় ঘোষের বক্তব্য, ‘‘গদাধর দলে ঢুকলে কর্মীরা কেউ মানতে চাইবেন না। এর পরেও শীর্ষ নেতৃত্ব যা ভাল বুঝবেন, তাই-ই করবেন।’’

Advertisement

এমনকি, মনিরুল, গদাধর যে দলে যোগ দিচ্ছেন, তা তিনি জানতেন না বলে দাবি করেছেন বিজেপি-র জেলা সভাপতি রামকৃষ্ণ রায়, তাঁর ম্নতব্য, ‘‘যা জানি না, তা নিয়ে কোনও মন্তব্য করব না।’’

লাভপুরে অবশ্য উজ্জীবিত মনিরুলের অনুগামীরা। কারণ মনিরুলের মতো তাঁরাও দলে কার্যত ব্রাত্য হয়ে পড়েছিলেন। তাঁদেরই কয়েক জনের দাবি, আগামী বিধানসভা নির্বাচনে মনিরুল ইসলামের ‘ক্ষমতা’ টের পাবে তৃণমূল। লোকসভা ভোটে এ বঙ্গে বিজেপি-ঝড়ের মধ্যেও জেলার দু’টি আসনই ধরে রাখতে পেরেছে তৃণমূল। কিন্তু, দু’টি আসনেই বিজেপি-র বিপুল ভোট-বৃদ্ধি উদ্বেগে রেখেছে তৃমমূল নেতৃত্বকে। এরই মধ্যে মনিরুল, গদাধরদরে বিজেপি-তে যোগদান অনুব্রতদের আরও চাপে ফেলবে বলে মনে করা হচ্ছে। অনুব্রত মণ্ডলকে ফোন করা হলে, তিনি ‘‘কিচ্ছু বলব না, কিচ্ছু বলব না’’ বলে ফোন কেটে দেন।

এক সময় লাভপুরের দাঁড়কা পঞ্চায়েতে ফরওয়ার্ড ব্লকের উপপ্রধান ছিলেন মনিরুল। ২০০৯ সালের লোকসভা নির্বাচনের পরে তৃণমূলের জেলা সভাপতি অনুব্রত মণ্ডলের হাত ধরে তৃণমূলে ঢোকেন। ২০১০ সালে নবগ্রামে, নিজের বাড়িতে বালিঘাটের সালিশি সভায় ডেকে সিপিএম সমর্থক তিন ভাইকে পিটিয়ে খুনের অভিযোগ ওঠে তাঁর বিরুদ্ধে। সেই অভিযোগে গ্রেফতার হন তিনি। তাঁর রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছিল বিভিন্ন মহলে। প্রকাশ্য সভায় ‘তিন ভাইকে পায়ের তল দিয়ে পিষে মারার’ কথা ঘোষণাও করেন মনিরুল।

কিন্তু সব জল্পনার অবসান ঘটিয়ে জেল থেকে বেরিয়ে তৃণমূলের বহু দাবিদারকে পিছনে ফেলে ২০১১ সালের বিধানসভা ভোটে লাভপুর কেন্দ্রের টিকিট পান তিনি। সিপিএমকে হারিয়ে বিধায়কও নির্বাচিত হন। তার পর থেকেই দলের জেলা সভাপতির আরও ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠেন মনিরুল। পরবর্তী কালে তাঁর রাজনৈতিক গুরু হিসাবে পরিচিত ফব-র রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য আব্দুল মান্নান এবং বহু বামকর্মীকে দলে ঢোকান। আব্দুল মান্নান বর্তমানে তৃণমূলের জেলা সহ সভাপতি।

২০১৬ সালেও লাভপুর থেকে বিধায়ক নির্বাচিত হন মনিরুল। কিন্তু তার পর থেকেই বিভিন্ন কারণে অনুব্রতের সঙ্গে তাঁর বিরোধ তৈরি হয়। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল, জেলা সভাপতির নির্দেশ অমান্য করে ‘স্বাধীন’ ভাবে চলতে শুরু করেন তিনি। তার জেরে জেলা তো বটেই, লাভপুরের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড থেকে মনিরুলকে ‘ব্রাত্য’ করে আব্দুল মান্নানকে গুরুত্ব দেওয়া হয়। এ বার লোকসভা নির্বাচনে মনিরুলকে ওই এলাকায় প্রচারে দেখা যায়নি। দলের তরফে অবশ্য এ জন্য মনিরুলের অসুস্থতার কথাই জানানো হয়েছিল। গদাধর হাজরার দলবদলের ইঙ্গিত অবশ্য মিলেছিল লোকসভা নির্বাচনের আগেই। মনিরুলের মতো তাঁকেও নানুর ব্লকের ‘কোর কমিটি’ থেকে সরিয়ে এলাকায় তৃণমূলের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড থেকে কার্যত ব্রাত্য করে দেওয়া হয়েছিল। যদিও দলীয় সূত্রে খবর, দু’দিন আগেই গদাধর বলেছিলেন, ‘‘প্রথম থেকে দলে রয়েছি, দল যত দিন থাকবে, তত দিন থাকব।’’ ২০১১ সালে তৃণমূলের টিকিটে জিতে নানুরের বিধায়ক হন গদাধর। দল সূত্রের খবর, গদাধর ও যুবনেতা কাজল শেখের দাপটে অনুব্রত-অনুগামীরা সেখানে কোণঠাসা হয়ে পড়েন। পরে অবশ্য কর্তৃত্ব কায়েম ঘিরে বিরোধের জেরে কাজলের সঙ্গ ছেড়ে জেলা সভাপতির হাত ধরেন গদাধর। ২০১৬ সালের নির্বাচনে কাজল গোপনে সিপিএমের সঙ্গে ‘হাত মেলান’ বলে অভিযোগ। তার ফলে নানুরে ২৬ হাজার ভোটে হারেন গদাধর। দলীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, এ বারের লোকসভা নির্বাচনে সেই ঘটনার পুনরাবৃত্তি যাতে না হয় সে জন্য গদাধরকে ব্রাত্য করে কাজলকে এলাকায় লিড রাখার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। কাজল প্রায় ১৭ হাজার ভোটের ব্যবধানে দলকে এগিয়ে দিয়েছেন। তারই ‘পুরস্কার’ হিসেবে তাঁকে ব্লক কার্যকরী সভাপতি পদে ফেরানো হয়। দলেরই অন্দরে তাঁকে গদাধরের স্থলাভিষিক্ত করার গুঞ্জন ওঠে। তৃণমূলের স্থানীয় কয়েক জন নেতার কথায়, ‘‘এতেই অনেকটা বোঝা গিয়েছিল, গদাধরের দলবদল সময়ের অপেক্ষামাত্র।’’

মনিরুল ও গদাধরের দলবদলকে অন্ত প্রকাশ্যে গুরুত্ব দিচ্ছে না তৃণমূল। তৃণমূলের লাভপুর ব্লক সভাপতি তরুণ চক্রবর্তীর দাবি, ‘‘কারও দলবদলে দলের কোনও ক্ষতি হবে না।’’ নানুর ব্লক তৃণমূলের সভাপতি সুব্রত ভটাচার্য বলেন, ‘‘গদাধরকে বাদ দিয়েই লোকসভায় ভাল ফল করেছি। ওঁর দল বদলে কিছু যায় আসে না!’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন